সরের রাধাবল্লভ জীউমন্দির। ছবি: কাজল মির্জা
চৈতন্য ও চৈতন্যযুগ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন অখণ্ড বর্ধমান জেলায় গড়ে উঠেছিল অনেকগুলি শ্রীপাট। এই সব শ্রীপাটের অধিকাংশই ছিল ভাগীরথীর তীরে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে নিত্যানন্দের শিষ্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দাঁইহাটের শ্রীপাট, শ্রীখণ্ড, অম্বিকা-কালনার শ্রীপাটের কথা। এ ছাড়া, কাঁদরা, ঝামটপুরের মতো এলাকাতেও অনেক শ্রীপাট ছিল। ভাগীরথীর তীর থেকে পশ্চিম দিকে পিছোতে থাকলে দেখা যাবে, এই অঞ্চলে বর্তমানে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব ক্রমশ কমছে। আউশগ্রামের মতো স্থানে এই প্রভাব প্রায় নেই বললে চলে। অথচ, কাটোয়া থেকে প্রায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সর-এর শ্রীপাট। কী ভাবে এই শ্রীপাট এখানে গড়ে উঠেছিল সেটাই বর্তমানে গবেষণার বিষয়। আর এই বৈষ্ণব তীর্থটি নানা দিক থেকে স্বাতন্ত্র্য লাভ করেছে।
এই শ্রীপাটের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সারঙ্গদেব ও মুরারি গোস্বামীর নাম। ইতিহাস থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এঁরা কেউই চৈতন্য বা নিত্যানন্দের বা তাঁদের শিষ্যদের কাছে দীক্ষিত নন। সে কারণে প্রায় চারশো বছরের পুরনো এই বৈষ্ণবকেন্দ্রকে রাঢ়বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শ্রীপাট হিসেবে গণ্য করা হয়। কুলীন গ্রাম ও শ্রীখণ্ড ছাড়া, শ্রীপাট সরের মতো প্রাচীন শ্রীপাট পূর্ব বর্ধমান জেলায় কমই আছে। এ সত্ত্বেও বৈষ্ণব ধর্ম সংক্রান্ত কিছু পুরনো আকর গ্রন্থে এই শ্রীপাটের উল্লেখ বিক্ষিপ্ত।
হরিদাসের লেখা ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান’-এর তৃতীয় খণ্ডে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে পরিবেশিত হয়েছে সারঙ্গ মুরারি সম্পর্কিত অতি সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য। এই গ্রন্থের বর্ণনা থেকে জানা যায়, শিষ্যত্ব গ্রহণের পরে, মুরারি সারঙ্গদেবের সেবায় জীবন কাটানোর পণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইনিই ‘শ্রীঠাকুর মুরারি’ নামে পরিচিত হন। এই গ্রন্থেই সরের শ্রীপাটের অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে, বর্ধমানের থেকে কিছুটা দূরে গলসি থেকে এক ক্রোশ দূরে এই স্থান অবস্থিত। আবার কিছু গ্রন্থ থেকে জানা যায়, সারঙ্গ দেবের মূল শ্রীপাট ছিল নবদ্বীপের নিকটস্থ একটি স্থানে। হরিদাসের গ্রন্থে এই স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং রাধা গোপীনাথের পুজোর কথা বলা হয়েছে। নবদ্বীপের নিকটস্থ ওই এলাকায় এখনও গোপীনাথ-রাধার সেবা করা হয়।
এ ছাড়া, সর শ্রীপাটের সঙ্গে বৃন্দাবনের যোগসূত্রের কথাও উল্লেখ করা রয়েছে। বৃন্দাবনের শ্রীগোপীনাথবাগে আজও রয়েছে ঠাকুর মুরারির কুঞ্জ এবং এখানে গোপীনাথ জিউয়ের নিয়মিত পুজো করা হয়। অনেকে এর সঙ্গে নবদ্বীপের নিকটস্থ জাননগরের শ্রীপাটের গোপীনাথ বিগ্রহের সূত্র খুঁজে পান।
এই শ্রীপাটের উল্লেখ রয়েছে গৌড়ীয় মঠ (বাগবাজার) থেকে প্রকাশিত ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের একাদশ পরিচ্ছেদে। বলা হয়েছে সারঙ্গদেবের নাম সম্ভবত ছিল শার্ঙ্গ। তিনি নবদ্বীপের নিকটবর্তী মোদদ্রুম বা মাউগাছি গ্রামে এসে ‘সারঙ্গ মুরারি চৈতন্যদাস’ নাম গ্রহণ করেন। এই জায়গার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব কিছু কম নয়। খড়ি নদীর কাছে সারঙ্গ মুরারি প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভের মন্দির আজও রয়েছে। মূল মন্দিরটি কিছুটা সংস্কার করা হলেও, তার মূল কাঠামো এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। নির্মাণ উপকরণ এবং গঠনশৈলী বিশ্লেষণ করে অনুমান করা হয় কয়েকশো বছর আগে এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল। রয়েছে সুপ্রশস্ত নাটমন্দির এবং দরদালান।
অনুমান করা হয়, প্রায় আড়াইশো বছর আগে মূলমন্দির লাগোয়া এই নির্মাণগুলি করা হয়েছিল। রাধাবল্লভের মন্দিরপ্রাঙ্গণের প্রবেশদ্বারের (সিংহদ্বার) দু’পাশে যে প্রাচীন অট্টালিকাগুলি ছিল তার ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। সেগুলির বয়সসীমা সম্ভবত তিনশোর কাছাকাছি। এই ভগ্নপ্রায় গৃহগুলি ছিল বর্তমান গোস্বামী বংশের পূর্বপুরুষদের বাসগৃহ। মূল মন্দির থেকে কয়েকশো গজ দূরে উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ ও সুদৃশ্য গোলাকৃতি দোল মন্দির।
শ্রীপাট সরকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা জনশ্রুতি ও কিংবদন্তিও। এই জনশ্রুতির কিয়দংশ লিপিবদ্ধ রয়েছে গৌরগোপাল ঘোষের ‘শ্রী শ্রী চৈতন্য লীলাগাথা’ গ্রন্থের সারঙ্গের শিষ্যলাভের অধ্যায়ে। এই কাহিনি থেকে জানা যায়, উপনয়নের পরে, মুরারি সর্পদষ্ট হন। তাঁর আত্মীয়েরা কলাগাছের ভেলায় তাঁকে খড়ি নদীর জলে ভাসিয়ে দেন। ভাসতে ভাসতে মুরারি নবদ্বীপের কাছে ভাগীরথীর তীরে এসে পৌঁছন। সেখানে ধ্যানরত সারঙ্গদেবের হাতের স্পর্শে তিনি সংজ্ঞা ফিরে পান। সারঙ্গেদেবের কাছে দীক্ষা নিয়ে মুরারি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার পরে তাঁকে নিয়ে সারঙ্গদেব বৃন্দাবনে যান। সেখানে এক দিন, নদীতে স্নানের সময়ে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি মুরারির হাতে আসে। সারঙ্গদেব এবং মুরারি স্বপ্নাদেশ পান, সরগ্রামের গোস্বামীপাড়ায় তাঁর নিত্যসেবার বন্দোবস্ত করতেন। তার পর তাঁরা দু’জন সরগ্রামে এনে তাঁর পুজো ও সেবার ব্যবস্থা করেন।
শ্রীপাট সরে পূজিত হয় সুসজ্জিত রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি। স্থানীয় মানুষজনের কাছে এই দেবতা রাধাবল্লভ নামে পরিচিত। আর মন্দির-সহ সমগ্র স্থানটির নাম ‘রাধাবল্লভের থান’। নিকষ কালো কষ্টিপাথরে তৈরি কৃষ্ণমূর্তি ও রাধামূর্তি অষ্টধাতুতে নির্মিত। সারা বছর নিত্যসেবার পাশাপাশি, আয়োজিত হয় সারঙ্গ-মুরারির তিরোধান দিবসও। তবে সব থেকে বেশি জাঁকজমক হয় দোলযাত্রায়।
‘পশ্চিমবঙ্গের পূজাপার্বণ ও মেলা’ নামক গ্রন্থে শ্রীপাট সরের দোলযাত্রা ও মুরারি মহোৎসবের উল্লেখ রয়েছে। এখানে দোলযাত্রা উদ্যাপিত হয় প্রথাগত দোলের পরের দিন। দোলের আগের দিন ‘চাঁচর’ বা ‘নেড়াপোড়া’ হয়। ‘চাঁচর’-এর পর দিন দোল পূর্ণিমার দিন বিকেলে মন্দির থেকে বাইরে নিয়ে এসে রাধাবল্লভের যুগলমূর্তিকে চাতালে রাখা হয়। তার পরে নামাবলি ও পট্টবস্ত্র পরিহিত গোস্বামীরা রাধাকৃষ্ণের পায়ে নিবেদন করেন আবির। এর পরে ভক্তেরা রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি পৃথক ভাবে কোলে নিয়ে শুরু করেন দোলযাত্রা। কয়েকশো গজ দূরের দোলমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয় বিগ্রহ। আবির উড়িয়ে নৃত্য, সঙ্গীতের মাধ্যমে মূর্তি নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে বাজতে থাকে শ্রীখোল, কাঁসর, করতাল, ঢোল, বাঁশির মতো বাদ্য।
মিছিল দোলমন্দিরে পৌঁছনোর পরে, দোলনায় বসানো হয় যুগলমূর্তিকে। তার পরে ফেরার পালা। দোলমন্দির থেকে রাধাবল্লভের থান— একই পথ ধরে ফিরে আসেন ভক্তেরা। ফেরার সময়ে তাঁরা গান বাঁধেন ‘আর খেলাতে কাজ নাই,/ চলো ঘরে যাই।/ ঘামিছে চাঁদ মুখখানি’। এ ছাড়া, মুরারিদেবের তিরোধান উপলক্ষেও এখানে এগারো দিনব্যাপী উৎসবও আয়োজিত হয়।
লোকসংস্কৃতি গবেষক ও ক্ষেত্রসমীক্ষক