এই ধরনের খবরের ক্ষেত্রে আসল ছবি প্রকাশে আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকে। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এক নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। জুলাই মাসে সে একটি সন্তানের জন্মও দেয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানান টালা থানায়। পুলিশ তদন্ত করে বিষয়টি জানায় স্থানীয় থানার পুলিশকে। নাবালিকাকে বিয়ে করার অভিযোগে তারা ছাব্বিশ বছরের এক যুবককে গ্রেফতার করে পকসো আইনে মামলা করে। মামলাটি জেলার একটি পকসো আদালতে বিচারাধীন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১৫ সালে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। পরে তারা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে। এরপরে অন্যত্র ঘর-সংসার পাতে। ওই পকসো আদালতের বিশেষ সরকারি আইনজীবী সমীর দাস বলেন, ‘‘মেয়েটি নিজের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে অস্বীকার করেছিল। পরে তাকে মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষায় যদি প্রমাণিত হয় বাচ্চার জন্মদাতা ওই যুবক, তা হলে বিচারে কড়া শাস্তির সম্মুখীন হবে।’’ সমীর বলেন, ‘‘নাবালিকা যদি নিজের ইচ্ছে বিয়ে করেছে বলে জানায়, তা হলেও তার সম্মত্তির কোনও মূল্য আইনের চোখে নেই। কারণ, সে নাবালিকা। পকসো আদালতে খুব দ্রুত মামলাটির শুনানি শুরু হবে।’’
নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে এই ধরনের পদক্ষেপ খুবই কার্যকর হতে পারে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। তাঁরা জানান, সমাজে এই বার্তা পৌঁছে যাবে, নাবালিকা বিয়ে করে সন্তানের জন্ম দিয়েও পার পাওয়া যাবে না। সমীর বলেন, ‘‘নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে রাজ্য সরকার খুবই কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজ্যের যে কোনও হাসপাতালে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা ভর্তি হলেই মামলা করা হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।’’
এই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন নয়। ওই ব্লকেরই এক নাবালিকাকে এক যুবক পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে গিয়েছিল। নাবালিকা বাজারে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় ডায়েরি করা হয়। পুলিশ অপহরণের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে। পরে পোর্ট ব্লেয়ারের একটি প্রাথমিক হেলথ সেন্টারে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে জননী সুরক্ষা কার্ড করার সময়ে বিষয়টি জানাজানি হয়। সেখানকার পুলিশ ‘জিরো এফআইআর’ করে উত্তর ২৪ পরগনার সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা পাঠায়। পুলিশ অভিযুক্ত যুবককে গ্রেফতার করে। নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ করা হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনও নিয়মিত পদক্ষেপ করছে। নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে স্কুলগুলিতে কন্যাশ্রী ক্লাব তৈরি করা হয়েছে। এই ক্লাবের সদস্যেরা স্কুলের কোনও সহপাঠীর বিয়ের খবর পেলেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জানাচ্ছে। এরপরে পুলিশ-প্রশাসন গিয়ে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করছে। এত কিছুর পরেও অবশ্য ফাঁকফোঁকর গলে নাবালিকাদের বিয়ে হয়েই যাচ্ছে বলে জানা যায় মাঝে মধ্যেই। কখনও অভিভাবকেরা জোর করে বিয়ে দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয়, আর্থিক অবস্থা খারাপ, ভাল পাত্র পাওয়া গিয়েছে বলে তড়িঘড়ি বিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, করোনার সময়ে বা তার পরবর্তী সময়ে নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।
তবে অনেক ক্ষেত্রে এমনও ঘটছে, নাবালিকাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে তারা বিয়ে করছে। বিয়ের পরে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ফলে তাদের খোঁজ অনেক সময়ে পুলিশ পায় না। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য পুলিশ বিয়ের পরেও নাবালিকাকে উদ্ধার করছে। নাবালিকাকে বিয়ে করার অভিযোগে যুবককে গ্রেফতারও করা হচ্ছে।
যারা আইনের চোখ এড়িয়ে নাবালিকা অবস্থায় বিয়ের পরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছে, তাদের বিরুদ্ধেও কড়া আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোনও নাবালিকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে এলেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানিয়ে দিচ্ছেন। পুলিশ আইনি পদক্ষেপ করছে। এমন ধারণা ছিল, এক বার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলে হয় তো তারা আইনের হাত থেকে বেঁচে গেল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য সরকার কড়া হাতে এই ঘটনা বন্ধ করতে চাইছে। যাতে নাবালিকা বিয়ে নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে নাবালিকা সন্তান প্রসব করলে পরিবারের লোকজনও মেনে নেন। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা কমছে।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে আমরা কড়া পদক্ষেপ করছি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও খবর পেলে নাবালিকাকে উদ্ধার করা হচ্ছে। যে বিয়ে করছে, তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করা হয়। তারপরেও কিছু বিয়ে গোপনে হয়ে যায়। তবে নতুন এই পদক্ষেপ নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে সাহায্য করবে।’’