ভারতীয় সংসদ ভবন।
হঠাৎ ‘নীতিপঙ্গুত্ব’ কথাটি কানে আসিলে মনে হইতে পারে, গত জন্মের বিস্মৃত স্মৃতি। একদা যে সংসদ দিনের পর দিন বিকল থাকিত, একটিও বিল পাশ হইত না, অধিবেশন কাটিয়া যাইত সচলতার আকাঙ্ক্ষায়, এই বাজেট অধিবেশনে সেই সংসদেই কাজ হইল ২৮১ ঘণ্টা। নির্ধারিত সময়ের ১৩৫ শতাংশ। ৩৬টি বিল পাশ হইল। সাংসদরা উপস্থিত থাকিলেন, জোরালো বিতর্ক হইল। ভারতীয় গণতন্ত্রের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে এই স্বাভাবিকতার পথে ফিরাইয়া আনিবার জন্য নরেন্দ্র মোদীর অভিনন্দন প্রাপ্য। এই অধিবেশনে যে ৩৬টি বিল পাশ হইল, তাহার অনেকগুলিই গুরুত্বে বিপুল। তিন তালাক বিল, ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির বিল, ইউএপিএ ও এনআইএ সংশোধনী বিল, তথ্যের অধিকার সংশোধনী বিল— ভারতীয় গণতন্ত্রে এই বিলগুলির তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। লোকসভার ইতিহাসে গত ৬৭ বৎসরে কখনও এক অধিবেশনে ৩৬টি বিল পাশ হয় নাই, এতগুলি গুরুত্বপূর্ণ বিলও নহে। ফলে, এই অধিবেশনটি ব্যতিক্রমী, ইতিবাচক অর্থেই।
তবে, সভার এই জঙ্গম হইয়া উঠিবার মধ্যেই একটি বিপজ্জনক সম্ভাবনার বীজও আছে। এই অধিবেশনে বিরোধীরা বারংবার অভিযোগ করিয়াছেন, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই যথার্থ সাংসদীয় প্রক্রিয়াকে এড়াইয়া বিল পাশ করাইয়া লইতেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলির সংসদীয় পর্যালোচনা হওয়া জরুরি ছিল, সভায় যথেষ্ট আলোচনা বাঞ্ছিত ছিল— সরকারপক্ষ তাহা করে নাই। বিরোধীদের অভিযোগ, লোকসভায় বিজেপি একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকিলেও অন্য দলের সহিত সমঝোতার ফলে ভোটের ব্যবস্থা হওয়ায় বিজেপি বিরোধীদের সহিত ঐকমত্য স্থাপনের চেষ্টামাত্র করে নাই। অভিযোগটি গুরুতর। বর্তমান অধিবেশনের পক্ষে, গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের পক্ষেও। বিল পাশ করাইয়া লইবার ক্ষমতা যদি থাকেও, বিরোধীদের সম্মতি আদায়ের চেষ্টাটি গণতন্ত্রের স্বার্থেই জরুরি। কারণ, বিরোধী সাংসদরাও শাসকপক্ষের সাংসদদের ন্যায় দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁহারাও ভোটে জয়ী হইয়াই সংসদে প্রবেশ করিয়াছেন। অতএব, বিরোধীপক্ষের বক্তব্য শুনিবার পরিসরটিই যদি না থাকে, তবে গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যটিই খর্ব হয়। এই পরিসর তৈরি করিবার দায়িত্ব শাসকপক্ষের। বিশেষত, সংখ্যার হিসাবে বিরোধীরা যখন ক্ষীণবল, তখন তাঁহাদের মতপ্রকাশের অধিকারটিকে আরও তৎপরতার সহিত রক্ষা করা প্রয়োজন। বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাহাদের পিছনে জনসমর্থনের প্রমাণ। কিন্তু, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাঁহাদের ঔদ্ধত্যে পৌঁছাইয়া দিবে, না কি গণতন্ত্রের সম্মানার্থে বিনয়ী করিবে, তাহাই দেখিবার। এই অধিবেশনে শাসকপক্ষের জোর এবং লক্ষ্যের প্রতি অবিচলতার প্রমাণ মিলিয়াছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আগামী অধিবেশন অবধি অপেক্ষা বই গতি নাই।
সাম্প্রতিক অতীতে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীরা খুব ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন নাই। ইউপিএ-র দ্বিতীয় দফায় নীতিপঙ্গুত্বের পিছনে বর্তমান শাসকদের ভূমিকা কম ছিল না। আজও সামর্থ্য থাকিলে বিরোধীপক্ষ সংসদ অচল করিয়া রাখিতেন, এমন আশঙ্কা ভিত্তিহীন নহে। তবুও, বিরোধীদের লইয়াই চলিতে হইবে। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে শশী তারুর বলিয়াছেন, যে প্রসঙ্গে বিরোধীপক্ষ হইতে কোনও ইতিবাচক সমালোচনা আসিবে, কোনও বিকল্প প্রস্তাব আসিবে— তাহাকে যথার্থ গুরুত্ব দিতে হইবে। যদি সেই প্রস্তাবের সারবত্তা থাকে, প্রয়োজনে সরকারকে নিজের অবস্থান সংশোধন করিতে হইবে। কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। এমন একটি প্রত্যাশা নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের পক্ষে অবান্তর নহে। কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার গৌরবে পৌঁছাইলে চলিবে না। উদারতা ও গ্রহণশীলতার গৌরবে পৌঁছাইতে হইবে।