অশিক্ষা ক্ষতিকর। অশিক্ষার সহিত অভিসন্ধির যোগসাজশ ঘটিলে ক্ষতি দ্বিগুণ। ভারতের বর্তমান শাসকরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ লইয়া নব উদ্যমে যাহা শুরু করিয়াছেন তাহাতে অশিক্ষা এবং অভিসন্ধি, দুইই প্রকট। গত স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ছোট পরিবার সুখী পরিবারের পুরাতন মন্ত্র শুনাইয়াছিলেন। তাহার পর হইতেই ভারতীয় জনতা পার্টির বিবিধ নেতানেত্রীর বয়ানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আহ্বান ধ্বনিত হইয়াছে। নীতি আয়োগ এই বিষয়ে নীতি রচনার কাজ শুরু করিয়াছে। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্ণধার মোহন ভাগবত সঙ্ঘের বৈঠকে জানাইয়াছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই তাঁহাদের পরবর্তী কর্মসূচি। সঙ্ঘের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হইয়াছে, ১৯৫১ হইতে ২০১১ সাল পর্যন্ত জনশুমারিতে ভারতের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত ৯.৮ শতাংশ হইতে বাড়িয়া ১৪.২ শতাংশ হইয়াছে, পাশাপাশি ‘ভারতীয় বংশোদ্ভূত’দের অনুপাত ৮৮ শতাংশ হইতে ৮৪ শতাংশে নামিয়াছে। সংখ্যালঘুকে সমস্ত প্রকারে চাপে রাখিয়া সংখ্যাগুরুর সমর্থন এককাট্টা করিবার যে পন্থা বর্তমান শাসকরা একমনে অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে দেখিলে এই সব হিসাবনিকাশের অন্তরালে নিহিত অভিসন্ধিটি আর অন্তরালে থাকে কি?
অভিসন্ধিমূলক প্রচার সতত বিপজ্জনক। কিন্তু সেই প্রচারে যাঁহারা ভুলিতেছেন, তাঁহাদের অশিক্ষা দ্বিগুণ বিপজ্জনক। প্রথম কথা, ১৯৫১ হইতে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যাবৃদ্ধির হার কমিয়া আসিতেছে, ২০১১-র জনশুমারিতে সেই হার কমিয়াছে হিন্দুদের তুলনায় বেশি দ্রুত। অর্থাৎ, মুসলমানদের সংখ্যা এখনও হিন্দুদের তুলনায় বেশি দ্রুত বাড়িতেছে, কিন্তু দুইয়ের বৃদ্ধির গতি ক্রমশ সমতায় আসিতেছে। দ্বিতীয়ত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে তারতম্যের কারণ ধর্ম, জাতপাত বা অন্যবিধ ভেদ নহে, আর্থিক ও সামাজিক তারতম্যই তাহার প্রধান কারণ। বিশেষত, মেয়েদের শিক্ষা এবং জননী ও শিশুর স্বাস্থ্য, এই দুইটি বিষয়ে উন্নতি ঘটাইতে পারিলেই জন্মহার নিয়ন্ত্রিত হয়, এবং দ্রুত গতিতে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই কার্যকারণ সূত্রটি দুনিয়া জুড়িয়া প্রমাণিত, কার্যত ইহার কোনও ব্যতিক্রম নাই। ভারতেও জনসংখ্যাবৃদ্ধির সমস্যাটি এখন প্রধানত উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যের সমস্যা, শ্রীযুক্ত যোগী আদিত্যনাথ শাসিত রাজ্যটি তাহাদের অন্যতম। সংখ্যালঘু-সর্বস্ব ঠুলিটি চোখ হইতে সরাইয়া মোদীজি যদি একটি বার সত্যদৃষ্টিতে বাস্তবকে দেখিতে পারেন, তবে তিনি সর্বাগ্রে যোগীবরকে আপন রাজ্যে জনশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের প্রসারে মন দিতে বলিবেন, তাহা হইলেই জন্মহার নিয়ন্ত্রিত হইবে— হিন্দুরও, মুসলমানেরও, অন্যদেরও। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে তাহাই হইয়াছে।
তৃতীয়ত, সঞ্জয় গাঁধীর যুগ হইতে পৃথিবী এবং ভারত অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। ন্যূনতম শিক্ষাদীক্ষা থাকিলে আজ আর কেহ জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে প্রধান সমস্যা বলিয়া গণ্য করে না, দুনিয়ার বড় অংশ জুড়িয়া এখন কম জন্মহারই বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সমস্যার কারণ বলিয়া বিবেচিত হইতেছে, কারণ তাহার ফলে ক্রমশ জনসংখ্যায় তরুণের অনুপাত কমিবে, বয়স্কের অনুপাত বাড়িবে। জাপান সহ অনেক দেশ ইতিমধ্যেই সেই পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গিয়াছে, ভারতও— বিশেষত দক্ষিণ এবং পূর্ব ভারত— অচিরেই বৃদ্ধপ্রধান হইবে। কী ভাবে এই সমস্যার মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়া যায়, তাহাই এখন ভাবিবার বিষয়। বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে বিস্তর চর্চা করিতেছেন, বিভিন্ন দেশে আলোচনার আসর বসিতেছে, ‘শূন্য গ্রহ’ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ জানাইয়া বই লেখা হইতেছে। আর, ২০২০ সালে দাঁড়াইয়া ভারতের শাসকরা দাঁড়িপাল্লায় হিন্দু এবং মুসলমানের জন্মহার মাপিতেছেন। অশিক্ষা আকাশ ছুঁইলেই বোধ করি লজ্জাবোধ অতলে পৌঁছাইতে পারে।