কেন্দ্রীয় সরকারের চালকেরা শাহিন বাগের প্রতিবাদী মানুষদের কাছে যাননি। গিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত, সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো দুই আইনজীবী। সর্বোচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। এবং বলা দরকার, দুর্ভাগা সেই দেশ যেখানে নির্বাচিত শাসকের দাম্ভিক হৃদয়হীনতার ক্ষতিপূরণের দায় নিতে হয় বিচারপতিদের। আইনজীবীদের এই দৌত্যে সুফল ফলবে, তেমন আশায় বুক বাঁধবার মতো দেশে ও কালে আমরা বাস করছি না। তাঁরা শাহিন বাগে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন তার কতটুকু সত্য কথা, কতখানি কূটনীতির কৌশল, তা-ও জানা নেই। তবে সেই জল্পনার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবাদীদের নানা প্রশ্ন ও অভিমত, যা তাঁরা আদালতের প্রতিনিধিদের কাছে পেশ করেছেন। বহু মানুষের ক্ষোভ, যন্ত্রণা, উদ্বেগ মন্থনে উঠে আসা সেই উচ্চারণের মর্মকথা একটাই: আমরা কী চাইছি, কেন চাইছি, তা শোনার, জানার এবং বোঝার কোনও চেষ্টা না করে সরকারি কর্তারা আমাদের এমন গভীর সঙ্কটে ফেলছেন কেন? এ কেমন দেশ চালানো?
এটা যথার্থ গণতন্ত্রের অন্তরের প্রশ্ন। ভোটে জিতে সরকার গড়ে ফেললে গণতন্ত্রের অনুশীলন শেষ হয় না, শুরু হয়। নিরন্তর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে বলেই তার নাম ‘গভর্নমেন্ট বাই ডিসকাশন’। সেই আলোচনা আইনসভার নিয়মরক্ষায় সীমিত থাকবে, গণতন্ত্রের কোনও সুশাস্ত্রে এমন বিধান নেই। কথোপকথনের প্রয়োজন সব বিষয়ে, সমস্ত পরিসরে, সকলের সঙ্গে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাঁদের সঙ্গে কথা বলার, যাঁরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সব দিক দিয়ে দুর্বল। যেমন শাহিন বাগের প্রতিবাদীরা, বিশেষত প্রবীণারা। সব রকমের ক্ষমতার বলয় থেকে দূরবর্তী বলেই আলোচনার পরিসরে তাঁদের দাবি সবচেয়ে বেশি। এখানে কোনও দয়া বা অনুকম্পার গল্প নেই, এই দাবি সমতার, ন্যায্যতার।
যথার্থ আলোচনার প্রথম ও প্রধান শর্ত: শুশ্রূষা। যে শব্দের মৌলিক অর্থ: শোনার ইচ্ছা। এই অর্থটিই বলে দেয়, কেন শুশ্রূষা ছাড়া সত্যিকারের আলোচনা হয় না, হতে পারে না। আমি যদি কারও কথা শুনতে না চাই, তার মনকে জানতে না চাই, তা হলে অনিবার্য ভাবেই আলোচনার সারবস্তু অন্তর্হিত হয়, পড়ে থাকে তার খোলসটুকু। ক্ষমতায় যাঁরা অধিষ্ঠিত, তাঁদের মধ্যে এই গুণটি দুর্লভ। ক্ষমতা বলতে কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা নয়, যে কোনও ধরনের ক্ষমতা, যা কোনও না কোনও উচ্চাবচ সম্পর্কের মধ্যে নিহিত থাকে। ক্ষমতাবান শিক্ষক শিক্ষার্থীর কথা শুনতে চান না, ক্ষমতাবান মালিক কর্মচারীর মত জানতে চান না, ক্ষমতাবান পুরুষ সঙ্গিনীর মন বুঝতে চান না। তাঁরা সকলেই যে ব্যক্তি হিসেবে স্বৈরতন্ত্রী, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। সমস্যাটা ব্যক্তির নয়, ক্ষমতার। ক্ষমতা স্বভাবত বধির। স্বভাব জয় করা কঠিন, সেই কঠিন কাজে ক্ষমতাবানেরা সচরাচর আগ্রহী হন না। অপরকে জানার বিষয়ে এই অনাগ্রহই ক্ষমতাকে অনৈতিক করে তোলে। ক্ষমতাবান নায়ক যখন গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার করেন, ‘কারও কথা শুনব না, আমি যা বলেছি, তা-ই হবে’, কিংবা নির্মম নীরবতায় বুঝিয়ে দেন তাঁর নিটোল অবজ্ঞা, তখন শুশ্রূষার নৈতিকতা তাঁর অধরাই থেকে যায়।
অধরা থেকে যায় অ-জানাকে জেনে নেওয়ার সুযোগও। অন্যের কথা শোনা কেবল তার প্রতি সুবিচারের নৈতিক শর্ত নয়, নিজের প্রজ্ঞাকে প্রসারিত করার অপরিহার্য উপায়ও। অপরিহার্য, কারণ জ্ঞানের ভুবনে আমরা কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ নই, অপরে যা জানে আমি তার অনেক কিছুই জানি না, তাই অপরের কাছে আমার জেনে নেওয়ার সুযোগ কখনও ফুরোয় না। এই সুযোগ যদি কাজে লাগাতে চাই, তা হলে আগে নিজের না-জানা সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। সেই সচেতনতা থেকেই তৈরি হতে পারে অন্যের কাছে জেনে নেওয়ার তাগিদ। এ এক পারস্পরিক লেনদেন, যার কোনও শেষ নেই।
বস্তুত, এ এক সমবেত অভিযাত্রা। যেন আমরা সবাই নিজের নিজের প্রদীপ হাতে নিয়ে পথ চলেছি, প্রত্যেকেরই নিজের প্রদীপের আলোটুকুর বাইরে বিস্তীর্ণ এলাকা, অন্ধকার, কিন্তু আমরা সেই অন্ধকার এলাকা সম্পর্কে সচেতন, ওই আলোটুকু আছে বলেই সচেতন। সচেতন বলেই, যদি চাই, একে অন্যের প্রদীপে আলোকিত এলাকাগুলিকেও দেখে নিতে পারি, আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়েই প্রসারিত হতে পারে আমাদের যৌথ আলোকায়ন, সমৃদ্ধ হতে পারে আমাদের সমবেত জ্ঞানের ভুবন।
আর তাই, ক্ষমতার বৈষম্য এই আদানপ্রদানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে শুধু নৈতিকতার দাবিই অপূর্ণ থাকে না, বাধা পড়ে জ্ঞানের প্রসারেও। ক্ষমতাহীনের কথা না শোনার অভ্যেস ক্ষমতাবানের জ্ঞানকেও অগভীর, অসম্পূর্ণ করে, বাস্তবের মোকাবিলায় তাকে ব্যর্থ করে দেয়। এই ব্যর্থতার অগণিত দৃষ্টান্ত আমাদের চার পাশে ছড়িয়ে থাকে, আমরা চিনতে পারি না, কারণ আমাদের দৃষ্টিপথ নিজের প্রদীপের আলোতেই সীমিত থাকে। প্রসঙ্গত, নোবেল পুরস্কারের সূত্রে অধুনা বিশ্রুত ‘পুয়োর ইকনমিক্স’-এর প্রবক্তারা এক অর্থে এই সত্যের দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন যে, দারিদ্রের মোকাবিলা করতে চাইলে দরিদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, তাঁদের কথা শুনতে হবে। তাঁরা কী ভাবে পৃথিবীকে দেখেন, কী ভাবে জীবন নামক দৈনন্দিন যুদ্ধ চালিয়ে যান, সেটা বুঝতে পারলে আমাদের জানার পরিধি প্রসারিত হবে, তার ফলে দারিদ্রের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই কিছুটা জোরদার হতে পারে।
এই ব্যবহারিক পরামর্শের সঙ্গে যোগ করতে পারি একটি সমতার সূত্রও। কিছু লোকের অনেক জ্ঞান আছে আর বহু জনের জ্ঞানের ঘোর অনটন— এই প্রচলিত ধারণায় যে বৈষম্য প্রকট, তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি। আপন ‘প্রজ্ঞা’র অহঙ্কারী ঘেরাটোপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সেই মানুষদের কাছে জ্ঞান-প্রার্থী হতে পারি, যাঁদের বরাবর অজ্ঞ মনে করে জ্ঞান দিয়ে এসেছি। জ্ঞানের পরিসরে দাতা এবং গ্রহীতার এই ভূমিকা-বদলের মধ্যে স্পষ্টতই নিহিত আছে এক ধরনের জাস্টিস বা ন্যায়ের ধারণা।
ন্যায়ের সন্ধানকে জ্ঞানের পরিসরে বেঁধে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। ওই পরিসরটি আকাশ থেকে পড়েনি। সমাজের চোখে কে জ্ঞানী এবং কে অজ্ঞ, সেই ধারণা সামাজিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসেরই সৃষ্টি। অতএব, কারা জ্ঞান দেবে এবং কারা জ্ঞান নেবে, তার প্রচলিত ছক ভেঙে দেওয়ার সূত্র ধরেই আমরা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারি সেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থাটিকে, যা ওই ছকটিকে সৃষ্টি ও লালন করে। আর, এই প্রতিস্পর্ধার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যেতে পারি বৃহত্তর ও গভীরতর সামাজিক ন্যায়কে প্রসারিত করার অভিযানে। এই ভাবে দেখলে, সামাজিক ন্যায়ের লক্ষ্য পূরণের একটি প্রাথমিক শর্ত হয়ে ওঠে শুশ্রূষা। বিশেষত, ক্ষমতাবানের শুশ্রূষা।
শাহিন বাগ ক্ষমতার কাছে এই শুশ্রূষা দাবি করেছে। একা শাহিন বাগ নয়, দেশ জুড়ে বহু পরিসরে বহু নাগরিক এই দাবিতে মুখর। যাঁরা এখন দেশের সরকার চালাচ্ছেন তাঁরা গণতন্ত্রের এই মৌলিক দাবিতে কান দেবেন বলে কিছুমাত্র ভরসা নেই। কিন্তু ক্ষমতার অধিষ্ঠান তো সরকার নামক বিগ্রহটিতে সীমিত নয়। সে সর্বত্র বিরাজমান, ভক্ত প্রহ্লাদের ভগবান নারায়ণের মতো। শুশ্রূষার দাবিও তাই সমস্ত পরিসরে প্রাসঙ্গিক। সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই দাবিকে আমরা যত বেশি মর্যাদা দিতে শিখব, ক্ষমতাহীনের কথা যত বেশি শুনব, রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের জোর তত বাড়বে। সে জোর নৈতিকতার, ন্যায্যতার।
ঋণ: ‘কেয়ার এথিক্স অ্যান্ড এপিস্টেমিক জাস্টিস: সাম ইনসাইটস ফ্রম দ্য মহাভারত’, বৃন্দা ডালমিয়া। প্রবন্ধটি অরিন্দম চক্রবর্তী ও শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত মহাভারত নাউ: ন্যারেশন, এসথেটিক্স, এথিক্স গ্রন্থে (রাউটলেজ, ২০১৪) অন্তর্ভুক্ত।