অতন্দ্র: ভারত-চিন যুদ্ধের সময় লাদাখে একটি অস্থায়ী ঘাঁটি আগলাচ্ছেন এক ভারতীয় সেনা। ১৯৬২। ছবি: গেটি ইমেজেস
অনেক প্রাচীন সভ্যতাগত ঐতিহ্য এবং ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী মনোভাবের সাদৃশ্যের কারণে ভারত এবং চিন— এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র একে অপরের মিত্র হওয়াই প্রত্যাশিত ছিল। জওহরলাল নেহরু ১৯৬০ সাল পর্যন্ত অন্তত এমনটাই বিশ্বাস করতেন। কিন্তু নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের ধারণার বিপরীতে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন তার জন্মলগ্ন থেকেই ভারত-বিরোধী নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভারতীয় বৈদেশিক নীতি প্রণয়নকারীরা এই কথা উপলব্ধি করেছেন অনেক দেরিতে। উদারনৈতিক এবং মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এখনও বিশ্বাস করেন যে, চিন-ভীতির ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় রাষ্ট্রনির্মিত, যা দারিদ্র বা বেকারত্বের মতো আর্থ-সামাজিক সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে সাহায্য করে।
ভারত এবং চিনের মধ্যে সম্পর্কের এই অবনতির কারণ কী? চিন কোনও দিনই ম্যাকমোহন রেখাকে দুই দেশের মধ্যেকার সীমান্ত হিসেবে মেনে নিতে চায়নি। বেজিং-এর মতে, ব্রিটিশরা ১৯১৪ সালে চিনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই সীমান্তরেখা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। ১৯৫১ সালে চিন তিব্বত দখল করে। অথচ চিনের প্রায় আড়াই হাজার বছরের লিখিত ইতিহাসে এমন নজির পাওয়া যায় না। ছিং বংশের অধীনে চিন সাম্রাজ্য তার সর্বোচ্চ বিস্তার লাভ করে, এবং সে সময় তিব্বত চিনের সামন্তরাজ্য ছিল।
আধুনিক কালে সমস্যা আরও ঘোরতর হয়ে ওঠে যখন তিব্বত দখলের পর চিন, নেপাল, ভুটান এমনকি সিকিমকেও তাদের এলাকা বলে দাবি করতে থাকে। বাস্তবে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের এই রাজ্যগুলি কোনও দিনই চিনের অংশ ছিল না। মধ্যযুগে যখন লাসা, পেকিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত, তখন নেপাল ছিল তিব্বতের একটা সামন্তরাজ্য। নেপাল, তিব্বতের থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ভুটান এবং সিকিমকে অস্থায়ী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। অন্য দিকে লাদাখ কোনও দিনই চিনের অংশ ছিল না, বরং তা সাময়িক ভাবে রঞ্জিত সিং-এর খালসা রাজত্বের অংশ হয়েছিল। আবার অরুণাচল প্রদেশ ছিল অস্থায়ী ভাবে অহম রাজত্বের অংশ। সুতরাং এই সমস্ত এলাকার উপর চিনের কোনও আইনগত অধিকার নেই।
আরও পড়ুন: তাঁদের কর্মী ভাবা হয়নি বলেই
নেহরু থেকে শুরু করে মনমোহন সিংহের অধীনে ভারত আলোচনার সুবিধার্থে বারংবার চিনকে একটা চূড়ান্ত সীমা নির্ধারণের দাবি জানায়। কিন্তু চিন তা কোনও দিনই করতে চায়নি। উপরন্তু, তারা ভারতীয় সীমান্তে অনুপ্রবেশ করতে থাকে (যেমন ১৯৬৭ সালে নাথু লা এবং চো লা গিরিপথ এলাকা আর ১৯৮৬ সালে অরুণাচল প্রদেশের সুমদরং চু এলাকা)।
উনিশশো আশি এবং নব্বইয়ের দশকে চিন এমনকি হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের উপর তাদের দাবি সম্প্রসারিত করে। বস্তুত, চিনের নীতি হল সীমান্তবর্তী উত্তেজনাকে ব্যবহার করে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। ভারতের ক্ষমতাকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে চিন সমগ্র এশিয়ার প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে চায়। এই বৃহত্তর নীতির অংশ হিসেবে চিন ১৯৫৬ সাল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে।
১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের কারণে পরবর্তী কালে সীমান্ত বরাবর চিনের আগ্রাসী কার্যকলাপ সফল হয়েছিল। প্রচলিত ধারণা হল যে নেহরুর ভারতীয় সামরিক নেতৃত্বের পরামর্শ উপেক্ষা করা উচিত হয়নি। সত্যি বলতে কী, সরকারপক্ষ এবং সামরিক বাহিনী, উভয়ই কিন্তু ভুল করেছিলেন। চিনের তিব্বত অধিকারের পরও নেহরুর সরকার এবং ভারতীয় সেনাধ্যক্ষরা হিমালয়কে একটি প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর হিসেবে মনে করতে থাকেন। নেহরুর বাকপটু প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন দাবি করেছিলেন যে, তিনি একাই ভারতীয় সেনাবাহিনী ছাড়া চিনের মোকাবিলা করতে পারবেন। এবং সেনাধ্যক্ষগণ ইসলামাবাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। কিন্তু বল্লভভাই পটেল ছিলেন ব্যতিক্রমী। তিনি নেহরুকে চিনের সামরিক আগ্রাসনের বিষয়টিতে সতর্ক করেন।
পঞ্চাশের দশক জুড়ে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ক্রমাগত ম্যাকমোহন রেখার ভারতীয় দিকে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। বর্তমান সময়ের মতো তখনও বিরোধীপক্ষ এবং গণমাধ্যমগুলি বিক্ষোভ প্রকাশ করে এবং দাবি করে যে নেহরুর অধীনে দুর্বল সরকার কোনও রকম পদক্ষেপ করতে ব্যর্থ। জনগণের অজ্ঞতা অনেক ক্ষেত্রেই জ়েনোফোবিয়া-র রূপ নিতে পারে, তাই চিনকে উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিতে না পারলে নেহরুর কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজয়ের মুখ দেখতে পারত। কিন্তু এই অবস্থাতেও নেহরু এবং তাঁর সেনাধ্যক্ষগণ চিনের সামরিক ক্ষমতাকে ভাঁওতা বলেই মনে করলেন। এর মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন ছিল ভারত-নির্মিত একটি ভাঁওতা। ১৯৬১ সালে নেহরু সামরিক ক্ষেত্রে ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’ গ্রহণ করেন, যার ফলস্বরূপ ম্যাকমোহন রেখা বরাবর ভারতীয় সেনাবাহিনী ছোট ছোট সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করতে থাকে। নেহরু তাঁর দুর্বল ভাবমূর্তি সংশোধনের জন্য পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে চিনা অনুপ্রবেশকারীদের ভারতের মাটি থেকে পদাঘাত করে বের করে দেওয়া হবে।
অন্য দিকে, পিএলএ অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর মোকাবিলা করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর থেকে ২১ নভেম্বরের মধ্যে চলা ৩১ দিনের ভারত-চিন যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী খুব খারাপ ভাবে লড়াই করেছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনীর রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল না এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পিছু হটতে হচ্ছিল। লেফটেন্যান্ট জেনারেল বি এম কল যুদ্ধ চলাকালীন মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে হাসপাতালে ভর্তি হন। পিএলএ কোরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর মোকাবিলা করেছিল এবং তাদের অভিজ্ঞতার সামনে ভারতীয় বাহিনী উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।
দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় গণতন্ত্রে সামরিক বাহিনীর অবদানের সমালোচনামূলক নিরীক্ষণ সম্ভব নয়। ফলত জনগণের প্রবণতাই হল শাসনক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করা। অন্য একটি প্রচলিত ধারণা হল— নেহরু তিব্বতে পিএলএ-কে আক্রমণের জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নির্দেশ না দেওয়ায় একটি বড় মাপের সাফল্য ভারতীয় বাহিনীর হাতছাড়া হয়। বাস্তবে কিন্তু এই ধারণার কোনও সত্যতা নেই। ভারতের তুলনায় চিনের বিমানবাহিনী ছিল অনেক বড় এবং তিব্বতে তাদের বহু সংখ্যক সামরিক বিমানঘাঁটি ছিল। ভারত তার বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করলে দিল্লির আরও অনেক বড় পরাজয় হতে পারতে।
এই মুহূর্তে ভারতের কী করণীয়? সামরিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা ভারত প্রতিবেশী চিনা ড্রাগনকে শুধুমাত্র প্রতিরোধ করার আশাই রাখতে পারে। তাকে সম্পূর্ণ ভাবে হারানো ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। এই অবস্থায়, বিতর্কিত সীমান্তে ভারতের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের সঙ্গে চিনের বিরোধী শক্তিজোট তৈরি করাই একমাত্র উপযোগী কৌশল। অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে গৃহীত লুক-ইস্ট নীতির প্রকৃত রূপায়ণের মাধ্যমে চিনকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে এই নীতি সফল হবে কি না, তা কেবল সময়ই বলতে পারবে।
ইতিহাস বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়