প্রতীকী ছবি।
ভারতের বিজ্ঞান মহলে খুশির হাওয়া। দেড় হাজার ভারতীয় বিজ্ঞানী স্থান পাইয়াছেন বিশ্বের ‘শীর্ষ’ দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর একটি তালিকায়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের প্রকাশিত তালিকাটি মূল্যায়নের নানাবিধ সূচকের সমন্বয়ে নির্মিত। বিজ্ঞানের কাজের মূল্যায়ন নানা প্রকারে হইয়া থাকে, তাহার সকল পদ্ধতিই যে স্বচ্ছ, যুক্তিনির্ভর, এমন নহে। অথচ বিজ্ঞানীর নিয়োগ, পদোন্নতি, অনুদানপ্রাপ্তি, পুরস্কার সেই সকল পদ্ধতির উপরেই নির্ভরশীল। সেই কারণে বিজ্ঞানের সকল শাখাকে লইয়া একটি নিবিড় ও বিস্তৃত তালিকার প্রয়োজন অনুভূত হইতেছিল। এটি সেই প্রয়োজন মিটাইতে পারে, তবে এটিও ত্রুটিমুক্ত নহে। বস্তুত, তালিকা প্রকাশের একটি উদ্দেশ্য হইল স্বীকৃতির শর্তগুলি বিষয়ে বিতর্ক উস্কাইয়া দেওয়া। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকাগুলি এটিকে প্রধানত সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করিয়াছে। কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যমে তাহা অধিক আলোচিত হইয়াছে স্বীকৃতির সনদ হিসাবে। ইহা অপ্রত্যাশিত নহে। ভারতে বিজ্ঞানের আলোচনার সহিত জনপরিসরের সংযোগ কম। পুরস্কারপ্রাপ্তি অথবা বিশেষ পদপ্রাপ্তি না ঘটিলে বিজ্ঞানী অন্তরালেই থাকিয়া যান। গবেষণার পুষ্টি, গবেষকের স্বীকৃতি, জনকল্যাণে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ, এগুলি সাধারণের আলোচনার বিষয় হইতে পারে নাই। ফলে, প্রশাসন বিজ্ঞানীকে সহজে উপেক্ষা করিতে পারে।
মুখে সম্মান দেখাইয়া কাজে অবহেলা, ইহাতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা অভ্যস্ত। গবেষকের বৃত্তি হইতে গবেষণার অনুদান, সকল বিষয়ে অকারণ বিলম্ব এবং আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বহু বিজ্ঞানীকে ভারত ছাড়িতে বাধ্য করিয়াছে। যাঁহারা রহিয়াছেন, তাঁহারা বিবিধ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানীদের তালিকায় স্থান করিয়া লইয়াছেন, ইহা নিঃসন্দেহে আশ্বস্ত করিবে। আইআইটি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এবং অন্য শীর্ষ গবেষণা সংস্থাগুলিতে যে বিশ্বমানের গবেষণা চলিতেছে, ইহা তাহার স্বীকৃতি। অতি উচ্চ স্থানে আসিয়াছে এমন ভারতীয় বিজ্ঞানীদের নাম, যাঁহাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান সংশয়াতীত। পদার্থবিদ্যায় অশোক সেন, টি রঙ্গনাথন, বা রসায়নে গৌতম দেশিরাজু, সিএনআর রাও বিজ্ঞানীমহলে সুবিদিত। বাংলারও বেশ কয়েক জন বিজ্ঞানী স্থান পাইয়াছেন এই তালিকায়।
এই তালিকায় রহিয়াছেন আরও এক ভারতীয় বিজ্ঞানী— সুন্দরপান্ডিয়ান বৈদ্যনাথন। চেন্নাইয়ের এই কম্পিউটার বিজ্ঞানী ‘বিশিষ্ট’ এক বিচিত্র কারণে। যতগুলি গবেষণাপত্রে তাঁহার গবেষণার উল্লেখ (‘সাইটেশন’) হইয়াছে, তাহার ৯৪ শতাংশ তাঁহার নিজেরই লেখা। একটি গবেষণার মূল্য নির্ধারণের অন্যতম উপায়, অন্যান্য গবেষণাপত্রে তাহার উল্লেখ। স্ট্যানফোর্ড -প্রকাশিত তালিকাটি দেখাইল, স্ব-উল্লেখ (সেলফ-সাইটেশন) এই প্রচলিত পদ্ধতিকে অর্থহীন করিয়া দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের এক একটি গোষ্ঠী পরস্পরের কাজকে প্রচুর উল্লেখ করিয়া সেগুলির ‘দর’ বাড়াইতেছেন। স্ব-উল্লেখমাত্রেই দোষাবহ নহে, কিন্তু স্ব-উল্লেখ অথবা পরস্পর-উল্লেখ কত দূর অবধি গ্রহণযোগ্য, তাহার কোনও বিধি নাই। বিধি নির্মাণের প্রয়োজন নির্দেশ করাই এই তালিকার সার্থকতা। স্বীকৃতির শিরোপা বিতরণ তাহার প্রধান উদ্দেশ্য নহে।