কয়েক ঘণ্টার ঝড় সুন্দরবনের কথ্য পরিভাষাটা পাল্টে দিল। গত এক দশকে বহু বার সুন্দরবনে যাওয়ার সূত্রে জানি, সরকারি আধিকারিক থেকে শুরু করে রাস্তার ধারের পাটাতন ফেলা চায়ের দোকান, সর্বত্র আলোচনার চতুর্থ বা পঞ্চম বাক্যে এসে পড়বে ২০০৯ সালের আয়লা ঝড়; সুন্দরবনে, এমনকি কলকাতাতেও, যে কোনও যা ছিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শেষ মাপকাঠি। আয়লার এগারো নম্বর জন্মদিনের দিন পাঁচেক আগে গত ২০ মে আমপান এ বারে আয়লাকে সেই জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আয়লার তুলনায় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেশি গতিবেগ, আয়লার তুলনায় অনেক বেশি ক্ষণের দাপট, এমন মাপের ঝড় সুন্দরবনে শেষ কবে এসেছে তা নিয়ে চলছে ইতিহাসের অনুসন্ধান।
মারা গিয়েছেন ৮৬ জন, করোনার ভয়কে সঙ্গী করে ছয় লক্ষ মানুষ ত্রাণ শিবিরে, কত লক্ষ ঘর ভেঙেছে ইয়ত্তা নেই, দুই ২৪ পরগনা মিলে প্রায় ৯০ কিলোমিটার নদীবাঁধ হয় ধুয়েমুছে গিয়েছে, নয়তো সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত। নোনা জল চাষের জমিতে থই থই করছে, জল আর জমিকে আলাদা করা যাচ্ছে না। কয়েক ফুট অন্তর উপড়ে পড়া বিশাল মাপের গাছ আর হেলে বা ভেঙে পড়া বিদ্যুতের ল্যাম্পপোস্ট। কলকাতার এক বড় অংশে বেশ কয়েক দিন জল বা বিদ্যুৎ না থাকার পর খবরের কাগজের হেডলাইন আর রাস্তা আটকে বিক্ষোভ চলল, এ দিকে সুন্দরবন-সহ দক্ষিণ আর উত্তর ২৪ পরগনার এক বড় অংশে কবে বিদ্যুৎ আসবে তা কেউ জানে না। “আপনারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভের কথা ভাবছেন না”, এই প্রশ্ন করলে সাগরের এক প্রবীণ মানুষ হেসে বললেন, “রাস্তা থাকলে তো রাস্তায় নামব?”
পশ্চিম সুন্দরবনের যে অঞ্চলটা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত— সাগর, পাথরপ্রতিমা, নামখানা ও কাকদ্বীপ, সেই অঞ্চল গত নভেম্বর মাসেই সাংঘাতিক ভাবে ধাক্কা খেয়েছিল। সাইক্লোন বুলবুল ১৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কলকাতায় অবশ্য বুলবুল বিশেষ ঘা দেয়নি, হ্যাশট্যাগ পড়েনি, মিডিয়া কেন যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না এই অভিযোগেও সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল হয়নি। বুলবুলে কিন্তু সুন্দরবনের সার্বিক ক্ষতি যথেষ্ট ছিল। তাৎক্ষণিক ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি।
এমন পরিস্থিতিতে মূলত দুটি প্রশ্ন উঠছে। প্রথমত সুন্দরবনে ভবিষ্যৎ কী। দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনকে, তার অপার জীববৈচিত্র ও আধ কোটি মানুষের ন্যূনতম জীবনমান সমেত বাঁচিয়ে রাখার উপায় কী? বিজ্ঞান স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সুন্দরবনে বিপর্যয় আসবেই, কেননা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বিস্তৃত সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যতম এগিয়ে থাকা (না কি পিছিয়ে পড়া?) অঞ্চল। সুন্দরবনে সমুদ্রের তল ও জল বৃদ্ধির পরিমাণ পৃথিবীর গড়ের দ্বিগুণেরও বেশি। সুন্দরবনের গায়ে-লাগা এক বিস্তৃত উচ্চ জনঘনত্বের অঞ্চল। কলকাতা সমেত সেই দক্ষিণবঙ্গের স্থায়িত্ব অনেকটাই সুন্দরবনের বাঁচা-মরার ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবন ও তার ম্যানগ্রোভ দেওয়াল না থাকলে আগামী দিনে আরও বড় বিপর্যয় শহরের ঘাড়ে এসে পড়বে। কয়েক দিনের বদলে কয়েক সপ্তাহ বিদ্যুৎহীন বা জলমগ্ন হয়ে থাকতে হবে।
এ সব সত্ত্বেও প্রশাসনের নাকের ডগায় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ সাফ হয়। বাঁধের মাটি কেটে নেওয়া হয়। সুন্দরবন নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করার কথা শোনা গেলেও এখনও কিছু করে ওঠা যায় না। জল ২০ ফুট বা তার বেশি হতে পারে, জানলেও ভাবা হয় না কী ভাবে মাটির বাঁধকে শক্তপোক্ত উঁচু করে নেওয়া যায়, গোয়া বা আন্তর্জাতিক মডেলকে সামনে রেখে। ভঙ্গুর বাড়িগুলিকে পাকা করার কথা ভাবা হয় না, যেমন ওড়িশা করেছে সমুদ্র থেকে ৫০০ মিটার অবধি অঞ্চলে। ভাবা হয় না, স্থানীয় স্তরে কাজের বন্দোবস্ত করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জীবিকার খোঁজে অন্য রাজ্যে দৌড়নো থেকে কী ভাবে বিরত করা যায়।
কেউ কেউ বলছেন, সুন্দরবন থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ সরানোটাই একমাত্র উপায়। ঠান্ডা ঘরে বসে আলোচনা করা গেলেও, এটা বোধহয় সমাধান নয়। একেবারে বিপজ্জনক অঞ্চল থেকে কিছু মানুষকে না সরালে হয়তো তাঁরা নিজেরাই সরে যাবেন। কিন্তু সুন্দরবন ও তার মানুষকে বাঁচাতে হবে সুন্দরবনে রেখেই। বিপদ বেশি বলে সরিয়ে দেওয়াটাই যদি সমাধান হয়, তবে তো কয়েক দশক পরে কলকাতা শহর থেকেও মানুষ সরিয়ে ফেলতে হবে কেননা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সংস্থা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ২০৭০ সাল নাগাদ কলকাতা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জলবায়ুবিপন্ন শহর হতে চলেছে!
এই কাজে, রাজ্যের পাশে কেন্দ্রকে চাই। সঙ্গে বাংলাদেশকেও চাই। সুন্দরবন তো ভারত আর বাংলাদেশ, দুই দেশেরই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরখানেক আগে বলেছিলেন সুন্দরবন নিয়ে দুই দেশের একত্রে কাজ করা উচিত। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কথাটা ভাবতে হবে। নইলে বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়ে একই হেডলাইন ফিরে ফিরে আসবে, একই সুর কাটা রেকর্ডের মতো বাজবে, বিপন্নতার একই বৃত্তে আমরা ঘুরব, যত দিন না সুন্দরবন পুরোপুরি ইতিহাস হয়ে যায়।