school

WB School Reopen: স্কুল তো খুলছে, কিন্তু পাঠশালায় আজহার, রানিদের কী ভাবে ফেরত আনব, সেটাই ভাবছি

তবে এত কিছুর পর শেষপর্যন্ত স্কুল-কলেজ খুলছে। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

Advertisement

নীহারুল ইসলাম

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:৫৬
Share:

অঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ।

জানুয়ারি মাসের শেষ দিনেও স্কুল গিয়েছিলাম। যেমন রোজ যাই। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি ছাড়াও অষ্টম শ্রেণি ছেড়ে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যদি কারও কিছুর প্রয়োজন পড়ে! রোজকার মতো ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে ১০টায়।
যথারীতি ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। কেউ বাড়ির দরজায় মা-মাসির সঙ্গে বসে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে। কেউ পথের পাশে খেলতে খেলতে— ‘‘স্যার, স্কুল কবে খুলবে?’’ প্রতি দিনের মতোই তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি তখন।

Advertisement

ক’দিন আগে দেখি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রানি খাতুন মার্কশিট-টিসি নিয়ে যায়নি। খোঁজ করতে জানলাম, তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পড়াশোনায় ভাল ছিল রানি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের নথি থেকে ফোন নম্বর খুঁজে ফোন করলাম। ধরলেন এক মহিলা। সম্ভবত মা। বললাম, আমি রানির স্কুল থেকে বলছি, মাস্টারমশাই। রানি ক্লাস এইট পাশ করেছে। সে কি নাইন ক্লাসে ভর্তি হবে না? মহিলা বললেন, ‘‘হবে নে কেনে, হবে।’’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কবে হবে? —খালার বাড়ি বেড়াইতে গেলছে। এলেই হবে।

খুব রাগ হল মহিলার মিথ্যা কথা শুনে। রাগ সামলে বললাম, স্কুলেই রানির নাইনে ভর্তির কাগজপত্র রয়েছে। এসে নিয়ে যান। মা আসেননি। পরের দিন রানি নিজেই এসেছিল। তাকে বললাম, জানি তোর বিয়ে হয়েছে। তুই আর পড়বি না। তবু যদি পড়িস, তা হলে এই কাগজগুলোর দরকার হবে। না হলেও নানা প্রয়োজনে এগুলো তোর কাছে থাকা দরকার। এগুলো নিয়ে যা। রানি নতমস্তকে নথিপত্র নিয়ে গেল।

Advertisement

আমাদের স্কুলের পাশের একটি বাড়ির সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আজহার ছাগল চরাতে নিয়ে যাচ্ছিল মাঠে। আমি স্কুলের গেটে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘‘স্যার, ইশকুল খুলে গেল?’’ তখন তো কোনও খবর ছিল না। তাই বললাম, না রে। এখনও কোনও খবর নেই। আজহার বলল, ‘‘তা হলে আপনি রোজ রোজ ইশকুলে আসেন কেন? লেখাপড়া যখন হয় না!’’ বললাম, আমি যে মাস্টার! আমাকে আসতেই হবে। এটাই নিয়ম। আজহার বলল, ‘‘আমি রোজ আপনাকে দেখে ভাবি, ইশকুল বুঝি খুলে গেল।’’ বলে মুখ বিষণ্ণ করে আজাহার ছাগল নিয়ে চলে গেল মাঠে। দেখে খুব কষ্ট হল।

এই আজহারের স্কুল নিয়ে খুব আগ্রহ। স্কুল খোলা ছিল যখন, স্কুলে আসত সবার আগে। তখন সবে সে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তার বড় ভাই সামির এ বার অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু স্কুল বন্ধের কারণে সে তার বাবার সঙ্গী হয়ে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে। রয়েছে বাবার সঙ্গে অন্য রাজ্যে। এরা একেবারে নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। মা সাধারণ গৃহবধূ হলেও সংসারের অভাব মেটাতে তাকেও বিড়ি বাঁধতে হয়। এক হাজার বিড়ি বাঁধলে ১৫০ টাকা মজুরি পায়। তা বাদে আর কোনও সুযোগসুবিধা নেই। যদিও তার সঙ্গে একদা স্থানীয় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে বাসন মাজার কাজটাও করত। করোনার কারণে সেটাও বন্ধ আজ প্রায় দু’বছর।

এ সব পরিবারের কথা ভাবতে ভাবতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম। হঠাৎ পকেটে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। ধরলাম। এক বন্ধুর ফোন। বলল, খবর দেখেছো? জিজ্ঞাসা করলাম, কী খবর? বন্ধু বলল, ‘‘এই মাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল খুলছে।’’

কিছু ক্ষণ চুপ করে রইলাম। স্কুল খুলছে সেই আনন্দে নয়, স্কুলে কাদের পড়াব, সেই দুশ্চিন্তায়। আজহার তো ছাগল চরাচ্ছে মাঠে। সামির তার আব্বার সঙ্গে ভিন্‌ রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ করছে। রানির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মা-খালার সঙ্গে বসে আমার যে ছাত্রীটি সারাদিন বিড়ি বেঁধে ১৫০ টাকা উপার্জন করছে, এদের আমি স্কুলে নিয়ে আসব কী ভাবে?

তবে এত কিছুর পর শেষপর্যন্ত স্কুল-কলেজ খুলছে। মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আমাদের মতো শিক্ষাকর্মীদের কথা নয়, আগামী প্রজন্মের সুন্দর জীবনের কথা ভেবে বিদ্যালয়গুলি খুলে দেওয়ার জন্য। আর একটা অনুরোধ রয়েছে। বাচ্চাদের স্কুলও খুলে দেওয়া হোক। একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকেই। ‘পাড়ায় পাঠশালা’ থেকে পাড়ার স্কুলটা খুব জরুরি।

(লেখক লালগোলার একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষা সম্প্রসারকমতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement