লী লা মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, তখন বর্ষা শেষ হয়ে আসছে। উদয়নের সামনের বারান্দায় ক্লাস। মাথার ওপর নীল আকাশ, ছেঁড়া মেঘ। কবি শেলির স্কাইলার্ক পড়াচ্ছেন। মূল কবিতাটি ইংরেজিতে পড়ার পর তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলায়। ‘আর কাউকে এমন কবিতা পড়াতে শুনিনি।’
রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি শিক্ষার জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন, এটা তার একটা নমুনা। তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজি বাঙালি ছেলেমেয়েদের কাজের ভাষার পাশাপাশি ভাবের ভাষাও হোক। তারাও বাংলাও শিখুক, ইংরিজিও জানুক।
রবীন্দ্রনাথের এই দ্বিভাষিক প্রবণতাকে একসময় এ পোড়া পশ্চিমবঙ্গের চিন্তকেরা স্বীকার করতে চাননি। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু লেখাকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ একমাত্রিক ভাবে বাংলাবাদী। মাতৃদুগ্ধের মতোই মাতৃভাষাকে তিনি নাকি সব সমস্যা সমাধানের উপায় বলে মনে করতেন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে যতটা সম্ভব ইংরেজির ভারকে লঘু করে দেওয়াই ভাল। এতেই রবীন্দ্রনাথের মত ও পথ অনুসরণ করা হবে। এ রবীন্দ্রনাথের মত-পথ নয়। তিনি বাংলা মাধ্যমের পক্ষপাতী, ইংরেজি নিধনের পক্ষপাতী নন। সংকীর্ণ বাংলাবাদী অভিমত পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষাকে জীর্ণ করেছিল, সরকারি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের ওপর সাধারণ মানুষ ভরসা হারিয়েছিলেন। আর তারই ফলে নানা রকমের ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। সাবেকি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি যদি ইংরেজি শিক্ষার পুরনো ধার-ভার বজায় রাখতে পারত তা হলে এ ভাবে বাঙালি ছেলে-মেয়েরা বাংলা মাধ্যম ছেড়ে নির্বিশেষে ইংলিশ মিডিয়ামের শরণ নিত না। বাংলা এখন হয় তাদের পড়তে হয় না, না হয় বাংলা তাদের দ্বিতীয় ভাষা। এতে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষতি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এমনটা কখনওই চাননি।
লীলা মজুমদারের বিবরণে দেখেছি, ইংরেজি কবিতার প্রতি পড়ুয়াদের আকৃষ্ট করার জন্য কবি বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। আবার, উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের জন্য ছিল অন্য উপায়। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ম্যাথু আর্নল্ডের ‘সোরাব অ্যান্ড রুস্তম’। এই কবিতা ক্লাসে পড়ানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ রীতিমতো হোমওয়ার্ক করছেন। ক্লাস এইটের পড়ুয়াদের পাঠ্য ছিল এটি। প্রথমে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে মূল কবিতাটি পড়ে শোনাতেন। তার পর ইংরেজিতে ধরে ধরে কবিতাটির গদ্য রূপান্তর করতেন। রূপান্তরিত বাক্যগুলি পড়ুয়াদের বলানো ও লেখানো অভ্যাস করাতেন। কবিতায় ব্যবহৃত অচেনা শব্দ দিয়ে বলাতেন লেখাতেন নতুন বাক্য। এই নতুন বাক্যটি যেন পড়ুয়াদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে সে দিকে খেয়াল রাখতেন তিনি। মূল কবিতায় ছিল ‘the men were plunged in sleep’ রবীন্দ্রনাথ যে নতুন বাক্য লেখালেন সেটি হল ‘herds of buffalos stood plunged in the water’. শান্তিনিকেতনে যে আশ্রম বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন রবীন্দ্রনাথ, সেই আশ্রম বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের কাছে গরু-মোষের এ ভাবে জলে নেমে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য খুবই চেনা। ইংরেজি কবিতার শব্দ তাদের কাছের চেনা ছবি হয়ে উঠত সন্দেহ নেই।
তবে শব্দকে কাছের ও স্থানীয় করে তোলার জন্য মূলের কাব্যত্বকে যে সংহার করতেন তা কিন্তু নয়। শান্তিনিকেতনের ছাত্র মুলুর অকাল প্রয়াণ হয়েছিল। মুলুকে মনে রেখে যে প্রয়াণলেখ লিখেছিলেন কবি তাতে জানিয়েছিলেন, ‘আমি নুম্যান, ম্যাথু আর্নল্ড, স্টিফেন্সন প্রভৃতি লেখকের রচনা হইতে যে-সকল অংশ উদ্ধৃত করিয়া তাহাকে পড়াইতাম, তাহার মধ্যে গভীরভাবে ভাবিবার কথা যথেষ্ট ছিল।’ বোঝা যায় কেবল কাজের ভাষাটি শেখাই যথেষ্ট নয়, ভাবার কথাও রপ্ত করা চাই। তা না হলে ইংরেজি বাঙালি পড়ুয়াদের আবেগের ভাষা হবে কেমন করে!
কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ পড়ুয়াদের জন্য লিখতেন মৌলিক ইংরেজি নাটক। এ ভাবেই লেখা হয়েছিল ইংরেজি নাটক কিং অ্যান্ড রেবেল। সন ১৯১২-১৯১৩, এই কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যন্ডে। বিলেতে বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত কবি, তাঁর ইস্কুলের পড়ুয়াদের কথা কিন্তু তখনও মোটে ভুলে যাননি। মৌলিক ইংরেজি নাটক লিখে পাঠাচ্ছেন। অজিত চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় শান্তিনিকেতনের পড়ুয়ারা এ নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। ‘ইংরেজি সোপান’, ‘ইংরেজি শ্রুতিশিক্ষা’র মতো ইংরেজি শেখার পাঠ্যবই লিখেই দায়-দায়িত্ব মিটিয়ে ফেলেননি শান্তিনিকেতনের গুরুদেব, সহজপাঠের লেখক। ইংরেজিতে নাটক করা যে ভাষাশিক্ষার কাজে খুবই সহায়ক, এ কথা মনে রেখেছিলেন। নাটকটিও ছেলেমানুষি নাটক নয়, বিষয় গভীর। রাজা ও রাজদ্রোহের কাহিনি নিয়ে লেখা এ নাটকটি পড়ুয়াদের মনে অধিকার ও জনমতের ধারণাকে স্পষ্ট করত।
বিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি শেখানোর এই সযত্ন আয়োজন কেন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? বুঝতে অসুবিধে হয় না তিনি বুঝেছিলেন শুধু বাঙালি হয়ে থাকলে বাঙালির মন-পেট কোনওটাই ভরবে না। শুধু কি ইংরেজি? শান্তিনিকেতনের দ্বার ভারতীয় ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার জন্যও ছিল উন্মুক্ত। বোঝা যায় এক ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ যাতে অন্য ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগী হন তাই ছিল কবির অভিপ্রায়। এই মনোযোগের জন্য নিজের ভাষা ছাড়তে হবে বা বিদ্যালয় স্তরে সমস্ত বিষয় বাধ্যতামূলক ভাবে ইংরেজিতে পড়তে হবে এমন ইংলিশ মিডিয়ামী দাওয়াই দিতে কবি নারাজ।
১৯১৭-তে শিক্ষাদীক্ষার হালচাল জরিপ করার জন্য স্যাডলার কমিশনকে নিয়োগ করা হল। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের বিদ্যালয়ের রুটিন দেখে খুব খুশি। যত ওপরের দিকে উঠছে পড়ুয়া তত ইংরেজি ক্লাসের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব এই কমিশনের সদস্যরা স্বীকার করতেন। ছোটবেলায় পড়ুয়াদের মাতৃভাষার স্বাদ-আহ্লাদ দিতে হবে। কিন্তু অপর ভাষার প্রতি বিমুখ করা যাবে না। সে জন্যই হয়তো তলার ক্লাসে বাংলায় শেলির কবিতা পড়াচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, উঁচু ক্লাসে ইংরেজি পড়ানোর পদ্ধতি আলাদা।
বেশ কয়েক বছর আগে ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ দ্য বাইলিঙ্গুয়াল ইন্টালেকচুয়াল’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন রামচন্দ্র গুহ। সারা ভারতেই যে নানা কারণে দ্বিভাষিকতার বদলে একভাষিকতাই মুখ্য হয়ে উঠছে, এই ছিল তাঁর আলোচ্য। এ কালে শিক্ষিতরা হয় ইংরেজি শিখছে, না হয় শিখছে স্থানীয় ভাষা, যে কোনও একটা ভাষা হয়ে উঠছে তাদের আবেগ ও মেধা প্রকাশের মাধ্যম। আর স্বভাবতই, যাদের ক্ষেত্রে সেটা ইংরেজি তাদের সুযোগসুবিধে বেশি। স্থানীয় ভাষার বাজার-প্রতিপত্তি ইংরেজি ভাষার থেকে কম। তাঁর মতে কাজের ব্যাপারে দ্বিভাষিক-এর অভাব এ কালে হয়তো নেই, কিন্তু মননে ও আবেগে দ্বিভাষিক এ কালে আর ক’জন হন! তাঁর মনে হয়েছিল বঙ্গভূমে এক সময় দ্বিভাষী চিন্তাবিদের প্রাচুর্য বাঙালিদের সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সুপ্রতিষ্ঠা দিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথও এই দ্বিভাষী বাঙালির গোত্রেই পড়েন। সাহিত্য আকাদেমি থেকে রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখাপত্রের যে চার খণ্ড সংকলন, অনেক দিন আগেই যা প্রকাশিত, তা রামচন্দ্রের সিদ্ধান্তকেই প্রমাণ করে। ইংরেজি রবীন্দ্রনাথের কাছে নিতান্ত কাজের ভাষা হয়ে থাকেনি, তা রবীন্দ্রনাথের মনন ও আবগের ভাষাও হয়ে উঠেছিল। বাংলার তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হলেও ইংরেজিতে মৌলিক নাটক, প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অথচ তাঁর নাম করেই বাঙালি শিশুদের লেখাপড়া থেকে ইংরেজিকে বিদায় করার আয়োজন হয়েছিল, যে আয়োজনের পরিণামে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে দ্বিভাষিকতার ধারাটাই দুর্বল হয়ে গেছে।
ক্ষতি তো যা হওয়ার হয়েছে। ইংরেজি ইংরেজি করে বাংলা ভাষাকে পশ্চিমবঙ্গে দুয়োরানি করে দেওয়া হল কিন্তু সেই দুয়োরানি-করণের পেছনে শুধু বাংলা ভাষাকে সুয়োরানি করতে চেয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের দায়ও কিছু কম নয়। আসলে কোনও ভাষাই দুয়ো বা সুয়ো নয়। পা মাটিতে রেখে ঘরের দরজা জানলাগুলো খুলে দিতেই হবে। সেই হাটখোলা দরজা-জানলার ভেতর দিয়ে অন্য ভাষা-সংস্কৃতির হাওয়া আসুক। এ পুরনো কথা, চেনা কথা, তবে মাঝে মাঝেই এ কথাগুলো আবার করে ঝালিয়ে নেওয়া ভাল।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক