—ফাইল ছবি
এর আগে এমনটা ঘটেছে মাত্র চার বার। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, ১৯৭৩, ১৯৮৩ এবং ২০০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে। গ্লোবাল কার্বন প্রোজেক্ট প্রকাশিত পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এই চার বারের পর পঞ্চমবার বিশ্ব জুড়ে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমেছে পাঁচ শতংশেরও বেশি। কারণ, করোনা অতিমারির প্রকোপে গোটা বিশ্ব কার্যত স্তব্ধ। সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকার প্রথম দুইয়ে থাকা চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের একাধিক দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে ব্যাপক হারে। এই দেশগুলির শিল্পাঞ্চল বন্ধ, লকডাউনের কারণে রাস্তায় গাড়িও চলছে না। স্বাভাবিক ভাবেই দূষণকারী গ্যাস, কণার মাত্রা কমেছে। কেপলার কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ইটালি ও ফ্রান্সের শিল্পাঞ্চলের গ্যাস নিঃসরণের ছবি তুলে ম্যাপের আকারে প্রকাশ করেছে কার্বন ব্রিফ অ্যানালিসিস প্রকল্পের একটি দল। এই দল করোনা আক্রান্ত বিশ্বে পরিবেশের সুস্থ হয়ে ওঠায় নজর রাখছে প্রতিদিন।
ভারতীয় উপমহাদেশেও চিত্রটা অনেকটা একই রকম। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার বা ক্রিয়া-য় কর্মরত গবেষক সুনীল দাহিয়ার প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, লকডাউন শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের বহু শহরের বাতাসে দূষণকারী নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে। দূষণ সংত্রান্ত খবরে সর্বদাই লাইমলাইটে থাকে দিল্লি। সেখানকার বাতাসেও পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫ কমে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া বিপদসীমারও নীচে নেমে গিয়েছে। ভারতীয় শহরগুলির বাতাসে দূষণের মাত্রা মাপা হয়েছে সেন্টিনেল ফাইভ পি ট্রেপোমি কৃত্রিম উপগ্রহের সংগ্রহ করা তথ্য থেকে। বিশ্লেষিত তথ্য থেকে তৈরি পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ।
বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শুদ্ধ বাতাস টেনে নেওয়ার এমন সুযোগ তো পাওয়া যায়নি বহু বছর।
তবে এ সুযোগ নিতে গিয়ে একটি প্রশ্ন রয়েই যায়। এ দেশে কত জনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ত্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠা উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে? উত্তর খুঁজতে গেলে বরং সামনে আসে আরও বেশ কয়েকটি প্রশ্ন। ভারতের মতো দেশে যখন এখনও বহু মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন, তাঁদের বাসস্থানের পরিবেশটা কেমন? দীর্ঘ লকডাউনে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক এখন রাস্তায় হাঁটছেন। কাজের জায়গা ছেড়ে তাঁরা মরিয়া বাড়ি ফিরতে। কেমন ছিল তাঁদের কাজের জায়গার পরিবেশ? সেখানেও কি প্রকৃতির সুস্থ হয়ে ওঠাটা একই রকম অনুভূত হয়? যেখানে ব্যালকনি তো দূর অস্ত্, ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাসের ঘরে ঢুকতেও অনুমতি প্রয়োজন, সেখানে দূষণটা ঠিক কেমন?
২০০৬ সালে মুম্বই আইআইটির দুই গবেষক চন্দ্র ভেঙ্কটরামন ও গাজালা হাবিব সায়েন্স পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখিয়েছিলেন দূষণের এক অন্য ছবি। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, কলকারখানার ধোঁয়া বা গাড়ির ধোঁয়া ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশে পরিবেশ দূষণে বড় ভূমিকা পালন করে বাড়ির আভ্যন্তরীণ দূষণ-হাউসহোল্ড পলিউশন।
কেমন সে বাড়ি? যে বাড়িতে রান্নাঘরের জন্য আলাদা জায়গা নেই, যে রান্নাঘরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কাঠ, ঘুঁটে, গুল, কেরোসিন। ঘরের ভিতরকার বাতাসে তাই কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের মাত্রা অত্যন্ত বেশি। এ ছাড়াও জ্বালানি হিসেবে অনেক সময়ই থার্মোকল বা প্লাস্টিকের প্যাকিং বাক্স। ফলে, তৈরি হয় পলিসাইলিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন ও ফর্ম্যালডিহাইডের মতো বিষাক্ত পদার্থ। এ ছাড়াও রয়েছে ঘরের ভিতরের বাতাসে অ্যাসবেসটস, সিলিকার কণার উপস্থিতি। একটা ছোট ঘরেই গাদাগাদি করে থাকার ব্যবস্থা। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা অসহনীয়। তার মধ্যে জল সরবরাহ ব্যবস্থা, শৌচাগার ও বর্জ্য ফেলার জায়গা অপ্রতুল। ফলে, মশার উৎপাত। যথেচ্ছ কয়েলের ব্যবহার। সে থেকেও বিষাক্ত গ্যাসের আধিক্য।
এ ধরনের ব্যবস্থাপনা যে প্রথমে হাউসহোল্ড পলিউশন ও তা থেকে সমগ্র অঞ্চলের দূষণ বাড়ায়, ভেঙ্কটরমন ও হাবিবের এই তত্ত্বকেই মান্যতা দিয়ে বছরচারেক আগে একটি রিপোর্ট ছেপেছিলেন পুণের চেস্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশনের দুই গবেষক কোমলক্রিতি আপ্তে ও সন্দীপ সালভি। তাঁরা এক ধাপ এগিয়ে মানুষের উপর এই দূষণের প্রভাব দেখিয়েছিলেন। হাউসহোল্ড দূষণ ডেকে আনে ফুসফুসের একাধিক সমস্যা, অনাক্রম্যতার অভাব, হাড়ের সমস্যা এবং ক্যানসার।
হাউসহোল্ড পলিউশনের আঁতুড়ঘর হিসেবে যে ধরনের বাড়ি ও ব্যবস্থাপনার উল্লেখ করা হল, তেমন বাসস্থান দেখা যায় কোথায়? বসতি বা স্লাম অঞ্চলের এক কামরার ঘরে, বড় কোনও স্থায়ী বাজারের গুদামঘরে ও ফ্ল্যাটবাড়ির বেসমেন্টে। এখানে থাকেন কারা? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিযায়ী শ্রমিক এবং অন্য অসংগঠিত শ্রমের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরাই এমন পরিবেশে থাকতে বাধ্য হন। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স ও অক্সফোর্ড পোভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিসিয়েটিভস প্রকল্পের যৌথ গবেষণায় প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং অ্যান্ড কোর্লেটস ইন স্লাম’ তেমনটাই বলছে। কলকাতায় ৬৮.৩, মুম্বইয়ে ৫৩.৯ এবং দিল্লি ও সংলগ্ন অঞ্চলে ৮৩.৬ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিকের বাসস্থানে হাউসহোল্ড পলিউশন ছড়ানোর সব ক’টা কারণই বর্তমান। দেশের অন্য রাজ্যেও অবস্থা আলাদা কিছু নয়।
কোনও শহরের দূষণের মাত্রা যখন কোনও গবেষণাপত্র বা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়, তখন গড় মাত্রাই প্রকাশ পায়। হাউসহোল্ড পলিউশনের তথ্য নিয়ে পৃথক গবেষণা হাতে গোনা। অসংগঠিত শ্রমের সঙ্গে যুক্ত ও পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসস্থানের দূষণ নিয়ে রিপোর্ট আরওই কম। তবে গত কয়েক মাসে যে ভাবে ভারতে এই ধরনের শ্রমিকদের অবস্থার নগ্নসত্য ফুটে উঠেছে, তাতে তাঁরা কেমন দূষণের শিকার হন প্রতিনিয়ত— সে প্রশ্ন তোলা আবশ্যিক।
এখন অবশ্য শহরে কাজের জায়গা ছেড়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন এঁরা। তবে লকডাউন উঠে গেলে পেটের তাগিদেই ফের শহরে ফিরতে হবে অনেককেই। তখন তাঁরা ব্যালকনি থেকে দেখা ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠা পরিবেশের স্বাদ পাবেন? এমনিতেই বিজ্ঞানীরা বারেবারে সাবধান করছেন, প্রকৃতির এই সুস্থ হয়ে ওঠা সাময়িক। লকডাউন উঠে গেলেই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শিল্পের চাকা ঘোরাতে হবে জোরের সঙ্গে। বাড়বে প্রকৃতি নিধন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের করোনা মোকাবিলায় অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণার বক্তৃতায় প্রকৃতি নিধনের ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। কয়লাখনির বেসরকারিকরণে অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এ ছাড়াও তাঁর ঘোষণায় নির্মাণকারী সংস্থাগুলিকে সুবিধা করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তো রয়েছেই। নির্মাণ ক্ষেত্রগুলি দূষণ ছড়ানোয় সিংহভাগ ভূমিকা পালন করে। সেই দূষণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন কর্মরত শ্রমিকেরা। বড় নির্মাণক্ষেত্রে শ্রমিকদের থাকার জায়গাও কনস্ট্রাকশন সাইটেরই অস্থায়ী চালা ঘরে, যেখানে হাউসহোল্ড পলিউশন মারাত্মক।ফলে, লকডাউন উঠে গেলে ব্যালকনি রয়েছে যাঁদের, শুদ্ধ বায়ুসেবনের সুযোগ ফের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে চাপ বাড়বে অর্থনৈতিক পিরামিডের নীচের ধাপে থাকা মানুষজনের উপর। তাঁদের অর্থনৈতিক ভাবে সাবলীল করার প্রচেষ্টা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর নিদানে নেই। বরং লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ চেন রিয়্যাকশনের মতো তৈরি করবে আরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিক, আরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক। যাঁদের মাথা গোঁজার ঠাই হবে হাউসহোল্ড পলিউশনের আঁতুড়ঘরেই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)