সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রতি দিন ৮ জন দলিত নারী ধর্ষিত হন। অবশ্যই এই সংখ্যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি, কারণ অনেক দলিত মেয়ের ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয় না। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী, দলিত নির্যাতনে সারা দেশের মধ্যে প্রথম উত্তরপ্রদেশ। সারা দেশের ২৫.৬% দলিত মানুষের ওপর নির্যাতন উত্তরপ্রদেশে ঘটেছে এবং এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই দলিত নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন।
উত্তরপ্রদেশের বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মেয়েটির গণধর্ষণ ও মৃত্যুর ঠিক এক মাস আগে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরি জেলায় ১৩ বছরের আর একটি দলিত মেয়েও প্রায় একই ভাবে ধর্ষিত ও খুন হন। দু’টি অভিযোগেই যে আশ্চর্য মিল চোখে পড়ার মতো সেটি হল, দুষ্কৃতীরা দু’জনেরই জিভ কেটে দিয়েছে। এই জিভ কেটে দেওয়া কি শুধুই কাকতালীয়? না কি, দলিত মেয়ের মুখ বন্ধের চেষ্টা? একে দলিত, তার ওপর মেয়ে, তাঁর আবার কথা বলার কী দরকার!
হাথরসের ঘটনায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ভূমিকা ন্যক্কারজনক বললে কম বলা হয়। বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মেয়েটি নিম্নবর্ণের এবং গরিব। এ দেশে উঁচু জাতের, অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল মেয়ের ধর্ষণ হলেও রাষ্ট্র প্রায়শই অভিযোগ নিতে অস্বীকার এবং তদন্তে অবহেলা করে— আর নির্যাতিতা যদি দলিত, সংখ্যালঘু অথবা দরিদ্র হন, তা হলে তো পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা চরমে পৌঁছয়। হাথরসের ঘটনাটিতে যত ক্ষণ পর্যন্ত আঞ্চলিক মিডিয়া চেঁচামেচি শুরু করেনি, তত ক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ অভিযোগে ধর্ষণের ধারা লাগায়নি, মেয়েটির মৃত্যুর পরও পুলিশ বলেছে, ধর্ষণ হয়নি, শিরদাঁড়ায় আঘাত লাগেনি, জিহ্বা অক্ষত, ইত্যাদি।
হাথরস ধর্ষণের ঘটনায় ভারতের তথা উত্তরপ্রদেশের শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের অবস্থান বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। প্রথমে তাঁরা বললেন, এটি একটি ‘ফেক’ প্রচার। তার পর বললেন, ‘নারীর ওপর অত্যাচারে রাজনীতি এনো না, জাতপাত এনো না, চলো সবাই মিলে সুবিচার চাই!’ এই সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান, আমাদের সমাজের জাতপাত এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে তৈরি ক্ষমতার সোপানতন্ত্রকে অদৃশ্য করে রাখে। ভাবখানা এই যে, আমাদের সমাজে অপরাধের ক্ষেত্রে কোনও জাতপাতের বৈষম্য নেই। এই অস্বীকার প্রকারান্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রশ্রয় দেয়।
‘মেয়েকে মেয়ে হিসেবেই দেখো, তার অন্য পরিচিতিগুলো তেমন জরুরি নয়’— যুক্তি হিসেবে এটি ভয়ঙ্কর। এই যুক্তিতেই আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র উচ্চবর্ণের, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মেয়েদের কিছু সুযোগ পাইয়ে দিয়ে ভারতে খুব নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে দেশে-বিদেশে প্রচার করে এবং দলিত, মুসলমান মেয়েদের বঞ্চনা, তাঁদের ওপর ঘটে চলা নির্যাতনের মান্যতা দেয়। ঠাকুর সম্প্রদায়ের পুরুষের হাতে দলিত মেয়ের যৌন নির্যাতন আমাদের এতই গা-সওয়া যে, এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ, তা এ দেশের উচ্চবর্ণের পুরুষ প্রায়শই ভুলে যান অথবা জানেন যে, তাঁদের সম্প্রদায়ের পুলিশ-প্রশাসন তাঁদের বাঁচিয়ে দেবে। হাথরসে অভিযুক্তরা তাদের উঁচু জাতের দম্ভের কারণেই বাল্মীকি সম্প্রদায়ের মেয়েটির ওপর অত্যাচার করার সাহস পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মেয়েটির ভাইয়ের বয়ান অনুযায়ী, ১৫ দিন ধরে মেয়েটি যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন, তখন গ্রামের উচ্চবর্ণের কেউ মেয়েটির খোঁজ নিতে তাঁদের উঠোন মাড়ায়নি।
উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনের কাছেও হাথরসের মেয়েটির দলিত পরিচয় প্রাধান্য পেয়েছে। দলিত মেয়ে বলেই মিডিয়া সরব না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেফতার করেনি। প্রশাসন মেয়েটিকে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স-এ নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সফদরজং হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। মেয়েটি যদি উচ্চবর্ণের হতেন, তা হলে পুলিশ-প্রশাসনের ভয় থাকত যে, মেয়েটির পরিবার তাঁদের জাতের যোগাযোগ খাটিয়ে হয়তো কোনও বড়সাহেবের কাছে পৌঁছে যাবেন, তখন আইনি পদক্ষেপ এবং চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের শাস্তি জুটবে। এই বাল্মীকি পরিবারটির যে সেই সামাজিক মূলধনের কানাকড়িও নেই, এ কথা পুলিশের জানা, তাই এঁদের কথা কানে তোলেনি।
হাথরসের ঘটনার সবচেয়ে মারাত্মক দিক হল— গণতন্ত্রের সব ক’টি স্তম্ভের, সব ক’টি স্তরের হাতে হাত মিলিয়ে চলা। অনেক সময় থানা স্তরে অথবা প্রশাসনের কোনও একটি/দু’টি বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ, উচ্চবর্ণের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মেয়েদের নির্যাতনের ঘটনা চেপে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হাথরসে দেখলাম স্থানীয় থানা থেকে জেলা পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট, জেলা আধিকারিক, লুকিয়ে শব পোড়ানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার, মৃতদেহ পাহারারত কনস্টেবল— সবাই একই সুরে কথা বলছেন। ডিএম যখন পরিবারকে বয়ান বদলানোর হুমকি দিচ্ছেন এবং পুলিশ জেলা সুপার যখন বলছেন ধর্ষণ হয়নি; মাঝরাতে লুকিয়ে শব পোড়ানোর সময় ফোন কানে অফিসার যখন বলছেন কিছু পুড়ছে না— তখন অবাক হয়ে দেখতে হয়, সব পুলিশের এক রা। ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্রের কাছে রাষ্ট্রশক্তির এমন প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণের উদাহরণ চরম শঙ্কাজনক।
আগেই যা জানা হয়েছিল, হাথরসের ঘটনা তা প্রমাণ করে দিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। এই যৌথ রাষ্ট্রব্যবস্থা মনুবাদী মূল্যবোধ সম্পূর্ণ আত্মস্থ করেছে। রাষ্ট্রের পুরো সিস্টেম আজ সেই মূল্যবোধের পায়ে ভূলুণ্ঠিত।