প্রতীকী চিত্র
কৃষি নিয়ে যে আইন কেন্দ্রীয় সরকার আনতে চাইছে, তা অত্যন্ত নির্মম। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ যাঁরা কৃষির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের উপরে সরাসরি এই আইনের মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এই প্রসঙ্গে নীল বিদ্রোহের কথা মনে আসছে। ১৮৫৯ সালে কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামে ব্রিটিশ শাসকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু নীলচাষিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
বর্তমান কৃষি বিল আদ্যোপান্ত অসাংবিধানিক। কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এমন আইন প্রণয়ন করতে কেন্দ্রীয় সরকার পারে না। সংবিধানের সপ্তম শেডিউলের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কৃষি নিয়ে অধ্যয়ন বা গবেষণা-সহ কৃষিভিত্তিক আইন প্রণয়ন রাজ্যের তালিকাভুক্ত বিষয়। আমাদের রাজ্যে কৃষি সংক্রান্ত আইন রয়েছে (ওয়েস্ট বেঙ্গল এগ্রিকালচার প্রডিউস মার্কেটিং রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৯৭২)। এই বিলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে।
এই বিলে বড় বড় সংস্থা এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা গরিব, স্বল্পশিক্ষিত প্রান্তিক চাষিকে দিয়ে জোর করে চুক্তি করিয়ে নিতে পারবে। চুক্তি হবে দু’টো অসম পক্ষের মধ্যে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পক্ষ অর্থাৎ কর্পোরেট সংস্থার তৈরি করা শর্তে দুর্বল পক্ষ অর্থাৎ গরিব, প্রান্তিক চাষি চুক্তি করতে বাধ্য হবেন। চাষির পছন্দের বালাই থাকবে না। তাঁকে চোখ বুজে শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় সই করতে হবে। আইনকে হাতিয়ার করে কর্পোরেট সংস্থা পুরো ব্যবস্থাকেই কুক্ষিগত করে ফেলবে। সভ্য দেশে অর্থনীতির নিরিখে চরম বৈষম্যের এই রাস্তাই খুলে যাবে।
কর্পোরেট সংস্থার জন্য বেআইনি মজুতদারি, অসাধু উপায়ে লাভজনক ব্যবসার রাস্তা উন্মুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু রাজ্যের হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণের উপায় থাকবে না। কারণ, ১৯৫৪ সালের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনে রাজ্যের হাতে থাকা ক্ষমতা ঘুরপথে কেড়ে নেওয়া হবে। কৃষিপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হবে। তাতে ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে। অথচ রাজ্যকে নীরব দর্শক হয়ে থাকতে হবে। সামগ্রিক ভাবে কৃষি ব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা এই বিল। বেসরকারি হাতে গোটা কৃষি ব্যবস্থা বিক্রি হয়ে যাবে।
চাষির প্রয়োজন ফসলের দামের নিশ্চয়তা। বিশেষত বন্যা, খরা, খারাপ আবহাওয়া, রোগের প্রাদুর্ভাব, মহামারি বা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় চাষির এই রক্ষাকবচ প্রয়োজন। কিন্তু এই সমস্ত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি হলে চুক্তিপত্রের নির্ধারিত দাম কর্পোরেট সংস্থা দিতে বাধ্য থাকবে না। অর্থাৎ, নয়া এই মহাজনি ব্যবস্থা চালু হলে চাষির লাভের কথা ভাবার দায় বড় বড় সংস্থার থাকবে না। তা হলে লাভ কার? চাষি অন্ধকারে তলিয়ে যাবেন।
লাভবান হবে কর্পোরেট সংস্থা। তাদের মুনাফা নিয়েই যে কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় ভাবনা, এই বিল তারই প্রমাণ।বিল থেকেই এটাও পরিষ্কার, চাষিরা আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত তা গড়াতে পারে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ চুক্তিভঙ্গ করলে গরিব চাষির পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে মামলা-মোক্কদমার খরচ বহন করা সম্ভব হবে? এটা মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে অসংখ্য শ্রমিক আইনি লড়াইয়ের খরচ বহন করতে না পারায়, সময়ে বিচার পান না। নতুন আইন এলে দেশের ৬০% জনগণকে একই অবস্থার শিকার হতে দেখব আমরা। এই যে মডেল, তার বিরোধিতা করে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছিল। কারণ, এতে গরিব এবং প্রান্তিক চাষিদের ক্ষতিসাধন হবে, উপকার নয়। এই বিলে রাজ্য সরকার চলতি ব্যবস্থায় থাকা ‘মার্কেট ফি’ বা লেভি আদায় করতে পারবে না। ফলে, রাজ্যের ব্যাপক রাজস্ব ক্ষতি হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে বার্ষিক ২০ কোটি টাকায়। মোদ্দা কথা, শুধুমাত্র বৃহৎ পুঁজির হাতই শক্তিশালী হবে। দরিদ্র মেহনতি কৃষক থেকে সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হবেন।
(মতামত ব্যক্তিগত)