কাণ্ডটা দেখুন! একটা গোটা কুম্ভমেলা, এই কোভিড’এর বাজারে!” আনন্দবাজারটা হাত থেকে টেবিলের উপর ফেলে বলল সূর্য। ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার লোকের সংক্রমণ হয়েছে, তবু মেলা চলবে, জানিয়ে দিয়েছে উত্তরাখণ্ড সরকার।
“কুম্ভমেলা তো তবু অনেক দূরে হচ্ছে। আজ সকালে বাজারে গিয়েছিলাম। দেখলাম, একটা লোকের মুখে মাস্ক নেই। কে বলবে, গত বছরের তুলনায় এ বার ঢের বেশি ছড়াচ্ছে কোভিড!” সূর্যর কথাটা ধরে নেয় শিশির। “গত বছর এপ্রিলে এই সময়ের অবস্থা মনে আছে? রাস্তাঘাট শুনশান, দোকানপাট বন্ধ— ও দিকে গোটা দেশে দিনে নতুন কেস হচ্ছে দেড় হাজার। এখন দিনে আড়াই লাখ কেস, আর লোকে মুক্তকচ্ছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“শুধু অন্য লোককে দোষ দিলে হবে? তুই আজ আড্ডা মারতে আসিসনি এখানে? দিনে কতগুলো নতুন কেস হচ্ছে, জানার পরও তো এসেছিস।” শিবুদা এত ক্ষণ একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে কাগজের পাতায় সুডোকু করছিলেন। শিশিরের কথাগুলো যে আদৌ শুনছিলেন, এত ক্ষণ সেটাই বোঝা যায়নি।
“আরে, গত বছর তো লকডাউন ছিল। আসতাম কী ভাবে?” আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করে শিশির।
“এখন লকডাউন নেই, তাই কোভিড এখন অনেক বেশি মারাত্মক জেনেও ঘুরে বেড়াচ্ছিস? এর পরও নিজেকে বুদ্ধিমান বলে দাবি করবি?” খোঁচা দেন বটে শিবুদা, কিন্তু তাঁর চোখের কোণে হাসি। “আসল কথাটা কী জানিস— শুকনো পরিসংখ্যান দেখে কোনও বিপদের গুরুত্ব বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। তোর, আমার, কারও না। আমরা বুঝতে পারি যে, পরিস্থিতি ঘোরতর— কিন্তু সেই বোঝাটা একটা স্তরে আটকে থাকে। আমাদের ছোঁয় না। ছোঁয়ার জন্য ঘটনাটা একেবারে ধরাছোঁয়ার মধ্যে ঘটতে হবে। আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কারও কোভিড হলেই দেখবি, আমরা অনেক বেশি সাবধান হয়ে যাই রোগটাকে নিয়ে।”
গত কয়েক দিন আড্ডায় এলেও শিবুদা একেবারে চুপচাপ ছিলেন— শিশিররা আনতাবড়ি বকে, খোঁচা দিয়েও কথা বলাতে পারেনি। আজ না চাইতেই শিবুদা আড্ডার সুতোটাকে ধরে ফেলায় বাকিরা গুছিয়ে বসল। শিশির আলগোছে সিগারেটের প্যাকেটটাকে ঠেলে দিল শিবুদার দিকে। দেখেও যেন দেখলেন না শিবুদা। বললেন, “কোভিডের মতো একটা অতিমারির পরিস্থিতি ঠিক কী, সেটা অবজেক্টিভলি বোঝার উপায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নেই। কিন্তু, বুঝব না বললেও তো মন মানে না— আমাদের মনের ধর্মই হল, চার পাশে যা ঘটে চলেছে, তার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাসমেত গোটা গল্পটাকে নিজের মতো করে বুঝে নেওয়া! কাজেই, এই রকম পরিস্থিতিতে, যেখানে আসল প্রশ্নের উত্তরটা আমাদের অজানা, সেখানে মন যা করার, তা-ই করছে। উত্তর জানা আছে, এমন একটা প্রশ্নকে বেছে নিচ্ছে, এবং সেটার উত্তরকে চাপিয়ে দিচ্ছে আসল প্রশ্নটার ঘাড়ে।”
“একটা বর্ণও বুঝলাম না, স্যর।” অনেক ক্ষণ বাদে মুখ খুলল তপেশ।
“জানি,” শিশিরের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরানোর ফাঁকে তপেশকে উত্তর দেন শিবুদা। “যেটার কথা বলছি, তার নাম ‘হিউরিস্টিক’। গ্রিক শব্দ— ‘ইউরেকা’ শব্দটার মূলে যা আছে, হিউরিস্টিকের মূলেও তা-ই আছে। কঠিন প্রশ্নের অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই অসম্পূর্ণ উত্তর খুঁজে পাওয়ার পথটিরই নাম হিউরিস্টিক। তোকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এই মুহূর্তে তোর জীবন নিয়ে তুই কতখানি খুশি— একেবারে তোকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন, তোর জীবন নিয়ে তোর খুশির মাপজোক— সেই প্রশ্নেরও যথার্থ উত্তর তোর জানা নেই। কিন্তু, প্রশ্নটা তোকে করলে তুই মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিয়ে দিবি। তোর অজানতেই তোর মন প্রশ্নটাকে পাল্টে নেবে— ‘এই মুহূর্তে আমার মেজাজ কেমন?’ এই প্রশ্নটা তো সহজ। ঝটপট উত্তরও পাওয়া যাবে। সেই উত্তরটাকেই তুই প্রথম প্রশ্নের উত্তর বলে ধরবি। এটাই হিউরিস্টিক। কোভিডের পরিস্থিতি কতখানি ভয়ঙ্কর, সেটা বোঝার কোনও উপায় তোর-আমার নেই। কিন্তু, কোভিড ঠেকাতে সরকার কতখানি কড়াকড়ি করছে, সেটা জানার উপায় আছে— লকডাউন হচ্ছে কি না, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কি না, আমরা দেখতেই পাচ্ছি। গত বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, অতিমারির প্রকোপ বাড়লে সরকারি কড়াকড়িও বাড়ে। কাজেই, কোভিড কতখানি মারাত্মক হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা মাপছি লকডাউন হচ্ছে কি না, সেটা দেখে। হিউরিস্টিক— কঠিন প্রশ্নের বদলে সহজ, জানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। এই যে লকডাউনের কড়াকড়ি দেখে সংক্রমণের মাত্রা বোঝার চেষ্টা, এটাকে বলে ইনটেনসিটি ম্যাচিং।”
“সরকার লকডাউন করে দিলেই আর মাস্ক ছাড়া কেউ রাস্তাঘাটে ঘুরত না? ভারতের জনতাকে এই চিনলেন আপনি!” তপেশের টিপ্পনী।
“সে তো গত বছর লকডাউনের সময়ও লোকে রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পুলিশের ডান্ডা খেয়েছিল। কিন্তু, এটাও ঠিক যে, এখন বহু মানুষই বিপদের মাপ বুঝতে পারছে না। কোভিডের বাড়াবাড়ির সঙ্গে লকডাউনের কড়াকড়ি অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছে অনেকের মনেই।” শান্ত ভাবে উত্তর দেন শিবুদা। “তবে, লকডাউন ছাড়াও এই বিপদের মাপ বুঝতে পারে মানুষ, যদি চেনা-পরিচিতের গণ্ডিতে কারও কোভিড হয়। সেখানেও হিউরিস্টিক। ‘অ্যাভেলেবিলিটি হিউরিস্টিক’— চোখের সামনে কোনও ঘটনা ঘটলে, অথবা কোনও ঘটনা স্মৃতিতে প্রকট হলে মানুষের মনে হয় যে, সেই ঘটনা তার সঙ্গে ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে ভাল রকম।”
শিবুদা থামলেন। গোপাল চা দিয়ে দিয়েছে বেশ খানিক ক্ষণ আগে। চুমুক দিয়ে মুখটা বিকৃত করলেন— ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তার পর বললেন, “তখন আমি শিকাগোয়। সেখানকার এক বাঙালি ছোকরা রিসার্চের কাজে কলকাতায় এসেছিল, ফিরে মহা উত্তেজিত— বললে, ‘কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান বিয়ে একেবারে জলভাত হয়ে গিয়েছে।’ বললুম, ‘বুঝলি কী ভাবে? ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে খোঁজ করলি নাকি?’ তো, ছোকরা বলল, এক দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে সে তিন জোড়া হিন্দু-মুসলমান দম্পতির দেখা পেয়েছে। প্রশ্ন করলাম, ‘আর, কলকাতার যত জন দম্পতির সঙ্গে তোর দেখা হল না, তাদের মধ্যে কত জন হিন্দু-মুসলমান জোড়া, সেটা ভেবে দেখেছিস?’ একটা ছোট স্যাম্পল সাইজ় পারে যে কোনও পরিসংখ্যানকে নাটকীয় করে তুলতে। তার মন্দ দিক যেমন আছে, ভাল দিকও আছে। চেনা-পরিচিতের গণ্ডিতে কোভিড হতে দেখেও যদি লোকে ভয় পায়,সাবধান হয়, মন্দ নয়। অন্তত, লকডাউনে অর্থনীতির সাড়ে সর্বনাশ করে মানুষকে সাবধান করার চেয়ে তো ভাল বটেই।
“চোখের সামনে যেটুকু দেখছি, সেটাকেই পুরো ছবি ভেবে নিলে— অজানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য শুধু সেই ছবিটুকুর দিকেই তাকালে— গোলমালও হয় অবিশ্যি। গেল মাস দুয়েকে অনেকগুলো জায়গায় ঘুরলাম, বুঝলি। একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম— কেন্দ্রে বিজেপি যতখানি অপশাসন করেছে; উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরা, দেশের হরেক প্রান্তে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার পরও যারা বিজেপিকে ভোট দেবে, তারা কেন দেবে? অনেকে ভোট দেবে শুধু মুসলমানরা শায়েস্তা হবে বলে— তাদের কথা বাদ দিচ্ছি। ঘৃণা যাদের চালিকাশক্তি নয়, তারা কিসের ভিত্তিতে তৃণমূলের বদলে বিজেপিকে বাছবে?
“দেখলাম, পুরোটা হিউরিস্টিকের খেলা। তৃণমূল কংগ্রেস কতটা খারাপ, এবং বিজেপির তুলনায় সার্বিক ভাবে তারা ভাল না মন্দ— এই প্রশ্নগুলোর বস্তুনিরপেক্ষ উত্তর দেওয়া কঠিন, হয়তো অসম্ভব। কিন্তু, আমাদের গ্রামে যে তৃণমূলের নেতা আছেন, তিনি ভাল না খারাপ— সেটা বলা সহজ। তিনি বিজেপি নেতার চেয়ে ভাল না খারাপ, সেটাও কঠিন প্রশ্ন নয়। বিজেপি নেতারা যে হেতু এখনও ক্ষমতায় নেই, ফলে ভাল হওয়া তাঁদের পক্ষে তুলনায় সহজ— রাবণ হওয়ার জন্য আগে লঙ্কায় যেতে হয়। হিউরিস্টিক বলছে, বিজেপি তুলনায় কম খারাপ। মানুষের মনও বিশ্বাস করে নিচ্ছে সেই কথায়। সেই বিশ্বাসের পরিণতি কী হবে, না ভেবেই।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শিবুদা। ভোটের ফল নিয়ে রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে তাঁর, আরও অনেকের মতোই।
“সে নাহয় হল, কিন্তু লকডাউন না করলে মানুষ বিপদ বুঝবে না, বলছেন?” খানিক আত্মগত ভঙ্গিতেই প্রশ্ন করে শিশির।
“তা বলছি না, কিন্তু সেটার জন্য লকডাউন আর কোভিডের মধ্যে যে সম্পর্ক মানুষের মাথায় তৈরি হয়ে গিয়েছে, সেটা ভাঙতেই হবে। কুম্ভমেলাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে হয়তো হত। অথবা, রাজ্যে বাকি দফার ভোটগুলোকে এক দিনে সেরে ফেললে। মানে, এমন কিছু একটা করে, যাতে মানুষের মনে জোরালো ধাক্কা লাগে। তেমন সম্ভাবনা দেখছিস কিছু?” পাল্টা প্রশ্ন করেন শিবুদা।
শিশিররা কী করে, তাদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।