প্রতীকী ছবি।
হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ ও অ্যাম্বার হার্ডের মামলার রায় প্রকাশের পর এক সরকারি পদস্থের অভ্যুত্থানকারীতে পরিণত হয়েও আমেরিকার রিপাবলিকান দলের রাশ ধরে রাখার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর এবং ব্রিটেনের পলিতকেশ মিথ্যাভাষী এবং সম্ভাব্য চুক্তিভঙ্গকারী ব্যক্তিটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পর একটি সঙ্গত প্রশ্ন উঠতেই পারে— সামাজিক সুনামের কি আদৌ কোনও মূল্য রয়েছে?
এই সূত্র ধরে যদি সংস্থাগুলির দিকে তাকানো যায়, দেখা যাবে, গত ১৭ জুনের ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ কাগজের আন্তর্জাতিক পাতায় এই সংবাদগুলি প্রকাশিত হতে দেখা গিয়েছে— গুগলকে জরিমানা করা হয়েছে, একটি কর সংক্রান্ত মামলায় ম্যাকডোনাল্ডকে ১.৩ বিলিয়ন ডলার প্রদান করতে বলা হয়েছে, কার্টেলাইজেশন সংক্রান্ত এক মামলায় সোনি হেরে গিয়েছে এবং আইফোন ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করার জন্য অ্যাপলকে প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়েছে। এর পরেও রয়েছে ভ্রান্ত সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য এবং ঝুঁকিপ্রবণ ক্ষেত্রে জরিমানা দেওয়ার জন্য মেটা, গুগল ও টুইটারকে অঙ্গীকার করতে হয়েছে। মেটার ক্ষেত্রে এমন কথাও উঠেছে যে, অনলাইন বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ফ্রান্সের তোলা এক ‘বিশ্বাসজনিত’ ক্ষেত্রে সংস্থাটি ‘শপথ’ করতে বাধ্য হয়েছে।
বাণিজ্য জগতে এ কথা বলা হয়ে থাকে যে, কোনও সংস্থার ‘সুনাম’ই হল তার সব থেকে মূল্যবান মূলধন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, একের পর এক অপকর্মের পরেও বেশ কিছু সংস্থা তাদের আপাত-অনিবার্য ক্ষয়ক্ষতির ধারকাছ দিয়েও যায়নি। স্মর্তব্য, সংবাদমাধ্যম লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে পৌঁছনোর জন্য তাদের সংবাদ-কলামগুলি ‘বিক্রি’ করে, নামজাদা অ্যাকাউন্টিং সংস্থাগুলি প্রকাশ্য সঙ্ঘাত ঘটে যাওয়ার পরেও এই সব সংস্থার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য-সহযোগিতা চালিয়ে যায়। এ সবের ফলে দেখা যায় বিখ্যাত হিরে ব্যবসায়ী সংস্থা ‘ডি বিয়ার্স’ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা ‘রক্তাক্ত হীরক’ (আশির দশকে আফ্রিকার সমস্যাদীর্ণ দেশগুলির অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার সুযোগে সস্তায় হস্তগত করা হিরে) -এর মারাত্মক অভিযোগ সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত রমরমিয়ে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কদাচ ‘এনরন’-এর মতো সংস্থাকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু ‘ম্যাককিনসে’-র মতো বাণিজ্য পরিচালন বিষয়ে পরামর্শদাতা সংস্থার মহীরুহপ্রতিম আধিকারিকেরা এই সব কালিমালিপ্ত সংস্থার সঙ্গে কাজ করেন এবং বণিক জগতে পরামর্শদাতা হিসেবে এই সংস্থাটিরই নাম স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করে।
কর্পোরেট জগতের অনেক ক্ষেত্রেই কেলেঙ্কারি দিয়ে শুরু করে রূপকথায় পরিসমাপ্তি পাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। এর উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে বাণিজ্য সংস্থাগুলির ইতিহাসের পাতায় পাতায়, যেখানে আমেরিকার রবার ব্যবসার অধিপতিদের (যাঁদের মধ্যে একজন আবার পেনসিলভানিয়ার স্টেট লেজিসলেটরকে একটি রেলপথ বিস্তারের ব্যাপারে প্রভাবিত করেছিলেন বলে অভিযোগ) কাণ্ডকারখানা থেকে শুরু করে ধীরুভাই অম্বানীর প্রাথমিক জীবনের অপকর্ম এবং এই মুহূর্তে গৌতম আদানির ব্যবসার বহু অসঙ্গতি। ভারতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত লড়াই বা টেলিকম কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু এই সব কেলেঙ্কারির পিছনে ক্রিয়াশীল অপরাধীকে চিহ্নিত করা যায়নি। একই ভাবে আমেরিকার ধনকুবেরদের মধ্যে কেউই পণ্যবিক্রয় ঘটিত ইচ্ছাকৃত দুষ্কর্ম বা ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রে আর্থিক ধসের দায়ে জেলে যাননি। নিউ ইয়র্ক বা অন্যত্র কিন্তু মধ্যস্তরের বন্ড-ব্যবসায়ীদের হাতে হাতকড়া পড়তে দেখা গিয়েছে।
যদি কেউ এর মধ্যে কোনও গূঢ়ার্থ খোঁজেন, তা হলে তার চেহারা হবে এমন— যদি একজন ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত হন এবং আপনার ওস্তাদি প্রকাশ্যে চলে আসে, তা হলে ক্ষতি নেই। যেমন কেউ ‘হিন্দুত্ব’ প্রচারের (যা অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের আহত করতে পারে) জন্য অভিযুক্ত হন, তবে কিছুই হবে না। কিন্তু যদি আপনার সংস্থা গণমানসে মহাকায় অবতারের ভূমিকা নিয়ে থাকে এবং কোনও কেলেঙ্কারি যদি ‘ফক্সভাগেন’, ‘টয়োটা’ বা অন্যান্যদের মতো প্রকাশ্যে চলে আসে (কিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্যে সেই ক্ষতি পূরণের সম্ভাবনা থাকলেও), তা হলে সমস্যা রয়েছে। সেই সঙ্গে যদি কোনও সংস্থা গোড়া থেকেই নড়বড়ে ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এক বিয়োগান্তক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যায়, তা হলেও সমস্যা থেকে যাবে। এমন সব ক্ষেত্রে ভিত্তিগত দিক থেকে প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই কেলেঙ্কারি সংস্থাটির অথবা সংস্থার অধিপতির অথবা রাজনৈতিক দলের গণমানসে প্রতিষ্টিত ভাবমূর্তির ক্ষতিসাধন করছে কি করছে না। যদি না করে, তা হলে আপনি বা আপনার সংস্থা ডোনাল্ড ট্রাম্প বা বরিস জনসনের মতো স্থায়িত্ব পেয়ে যেতেই পারেন।
এমন সব ক্ষেত্রে অনেককেই পাওয়া যাবে, যাঁদের ‘সুনাম’ প্রকৃতপক্ষে বেশ খানিকটা জগঝম্প। বিনিয়োগকর্তা, উপভোক্তা, চাকুরে, তাদের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী, তাদের পণ্যের বিপণনকারী, শেয়ারহোল্ডার প্রভৃতি বিভিন্ন বর্গের মানুষজন সংস্থার এক ভিন্ন চেহারা দেখতে পাবেন। একজন নিয়োগকর্তার কাছে এমন অভিজ্ঞতা কি বাঞ্ছনীয়? এমন ‘সুনাম’ কি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাওনা মেটাতে সমর্থ? সেই সব সংস্থার বিপণি কি ভোক্তাদের বাসস্থানের নিকটবর্তী বা তাঁদের পক্ষে সুবিধাজনক অবস্থানে বিরাজ করছে? এই সব সংস্থা কি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পগুলিতে অর্থের যোগান দেয়? এমন সংস্থা কোনও বিষয়ে সব থেকে উপযোগী সমাধানের পথ বাতলায়? সে দিক থেকে দেখলে ‘সুনাম’ এক অতি জটিল বিষয়। আমেরিকান রাজনৈতিক কর্মী র্যালফ নাডের যখন বলেছিলেন। ‘‘গাড়ি যে কোনও গতিবেগেই বিপজ্জনক’’ অথবা আমেরিকারই সমুদ্র-জীববিজ্ঞানী র্যাচেল কারসন তাঁর আদৃত গ্রন্থ ‘সায়লেন্ট স্প্রিং’-এ কীটনাশক শিল্পকে ভয়ঙ্কর ভাবে আক্রমণ করেছিলেন বা মাঝে মধ্যেই যখন সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন খবর প্রকাশ্যে নিয়ে আসে, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যবসার ‘সুনাম’ বিপন্ন হলেও পুরো সংস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে না।
পাশাপাশি, কোনও সংস্থা যদি ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বিলয়সাধনের মতো কাজে লিপ্ত হয়, তা হলে আপনার নিজস্ব স্বার্থ না থাকলে আপনি সেটি উপেক্ষা করবেন। মনে রাখা দরকার, একটি অর্থ তছরূপ-সহ বহু কেলেঙ্কারিতে দীর্ঘ এক দশক ধরে লিপ্ত থাকার পরে কিন্তু ডয়েশ ব্যাঙ্ক তার শেয়ারের বাজারদরের সাত- অষ্টমাংশ হারিয়েছে। যদি গুগলের ‘সার্চ অ্যালগরিদম’ সর্বোৎকৃষ্ট হয়ে থাকে, তবে তা কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের ভাবনার খোরাক হতে পারে। সংস্থাটি সংবাদ-ব্যবসার বারোটা বাজাচ্ছে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার উদ্রেক কিন্তু হবে না। উপযোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখলে মনে হতে পারে, কোনও সংস্থা কর ফাঁকি দিচ্ছে কি না অথবা কোনও জনজাতির পরম্পরাগত জীবনধারাকে বিঘ্নিত করছে কি না— এগুলিই মূলত ভাবনার খোরাক হয়ে ওঠে। সেই কারণেই ইএসজি (এনভায়রনমেন্টাল, সোশাল, গভর্নমেন্টাল)-এর মাপকাঠিতে কিছু কিছু বিনিয়োগের রেওয়াজ আজ বিবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বাস্তবমুখীন এই যুগে কোনও রাষ্ট্রশক্তি আপনার ধর্মীয় চৈতন্যে আঘাত করল কি না, তা বিচার্য নয়। যদি না সেই রাষ্ট্র আপনার দেশের গ্যাস বা জ্বালানি তেলের বড় মাপের ক্রেতা হয়ে থাকে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।