বায়না: অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে ক্যাম্পাসের সামনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের বিক্ষোভ, ২৩ মে। পিটিআই
খবরটা শুনে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল; কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক স্তরের পরীক্ষা অফলাইন হবে, এই সিদ্ধান্তে হতাশ এক ছাত্র আত্মহনন করেছেন। সেটা ছিল ৪ জুন। মুহূর্তে অনলাইন পরীক্ষার দাবিতে বিক্ষোভ-অনশনরত ছাত্রদের ছবি ভেসে এসেছিল চোখে। কলেজ স্ট্রিট জুড়ে ছাত্ররা বিক্ষোভে উত্তাল। আত্মহত্যার খবরটা পরে ভুল বলে জানা গেলেও প্রশ্নটা মাথায় ঘুরেই যাচ্ছে— ছাত্ররা অনলাইন পরীক্ষা দিতে এত মরিয়া কেন?
কয়েক মাস আগে যখন স্কুল-কলেজ খুলে গেল, বেশির ভাগ স্কুল অফলাইনেই বার্ষিক পরীক্ষা নিয়েছিল। এত দিন পর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণত ছাত্ররা যখন অনলাইন পরীক্ষার দাবি তোলেন, তখন বুঝতেই হয় যে, এই ব্যবস্থা তাঁদের বিশেষ কিছু সুবিধা দিচ্ছে। সেটা অবশ্য গত দু’-তিনটে সিমেস্টারের নম্বরের বন্যাতেই বোঝা গিয়েছে। না হলে নিয়মিত ক্লাস না হওয়া ইত্যাদি কারণে পরীক্ষা পিছোতে বলা যায়, কিন্তু অনলাইন পরীক্ষার দাবি কেন?
আসলে ব্যাপারটা ‘ওপেন সিক্রেট’। অনলাইন পরীক্ষা মানেই পরীক্ষকের নজর এড়িয়ে সর্বপ্রকার অসাধু উপায় অবলম্বন। যাঁরা পরীক্ষা দিচ্ছেন আর যাঁরা নিচ্ছেন, দু’পক্ষই সেটা জানেন। অনলাইন পরীক্ষায় তাই সবাই ভাল ছাত্র; সব প্রশ্নের উত্তর নিখুঁত ভাবে নেমে আসে প্রায় প্রত্যেক অনলাইন খাতায়। কী ভাবে আসে, জানা থাকলেও নিরুপায় অনলাইন পরীক্ষক নম্বর দিতে বাধ্য। তাই ছাত্ররা যখন বলেন যে, অফলাইন ক্লাস করলেও পরীক্ষা তাঁরা অনলাইনই দিতে চান, তখন প্রকারান্তরে তাঁরা অসাধু উপায়টির উপর তাঁদের নির্ভরতার কথা স্বীকার করেই নেন। না হলে, দু’বছর আগেও পরীক্ষা মানে অফলাইন পরীক্ষাই বোঝাত।
শিক্ষাক্ষেত্রে কোভিডের সবচেয়ে বড় অবদান অনলাইন পড়াশোনা। অনলাইন ব্যবস্থার কল্যাণেই করোনা পর্বে কিছু ছেলেমেয়েকে অন্তত কিছুটা লেখাপড়া করানো গিয়েছে, সেটা ঠিক। সহায়ক ব্যবস্থাগুলো ঠিকঠাক কাজ করলে লেখাপড়া অনলাইনে করিয়ে দেওয়া সম্ভব। তাকে অস্থায়ী উপায় হিসেবে তবু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু, অনলাইন পড়াশোনা আর অনলাইন পরীক্ষা এক কথা নয়। পরীক্ষা বলতে আমরা এখনও যে ব্যাপারটা বুঝি আর পরীক্ষার নম্বর আমাদের কাছে যে পরিমাণ গুরুত্ব পায়, সে বিচারে অনলাইন পরীক্ষা আসলে কোনও পরীক্ষাই নয়। সেই কথাটাই আরও পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ছাত্রদের আচরণ থেকে। খাঁ-খাঁ রাস্তা, বন্ধ স্কুল-কলেজ-অফিস-দোকানপাট— এমন ভাবেই অতিমারির কবলে আমাদের দুটো বছর কেটেছে। সেই দু’বছরের প্রভাবকে কাটিয়ে ওঠারই চেষ্টা করছি। কিন্তু শয়তান থাবা গুটিয়ে নিলেও যেমন কিছু আঁচড় থেকে যায় শরীরে, তেমনই অতিমারিও জোরদার আঁচড় রেখে গিয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে। যত দিন যাচ্ছে, তত নতুন নতুন আঁচড়ের দাগ ফুটে উঠছে, যার একটা হল ছাত্রদের এই আচরণ।
আসলে হওয়া উচিত ঠিক উল্টোটা; পড়াশোনা যে ভাবেই হোক, পরীক্ষাটা হবে অফলাইন। কারণ পড়াশোনা যতটুকুই হয়ে থাক, তা আয়ত্ত হয়ে যাওয়ার পর আর অনলাইন-অফলাইন ভেদাভেদ থাকে না। কিন্তু পরীক্ষকের সামনে বসে বই বন্ধ করে যে পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তা আড়ালে বসে দেওয়া মানে পদ্ধতির মূল শর্তটাকেই অস্বীকার করা। তাতে ক্ষতি বহুমাত্রিক। প্রথমত, ছাত্রদের মেধার বিচার হচ্ছে না, পরীক্ষার নম্বরেরও কোনও গুরুত্ব থাকছে না— ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই টুকলি রাজত্বে’। মুড়ি-মিছরির এক দর হওয়ার দরুন ভাল ছাত্ররা গভীর ভাবে পড়াশোনা করার উৎসাহ হারাচ্ছেন। এমনকি শিক্ষকেরা, যাঁরা অতিমারি কালে সর্বশক্তি দিয়ে লড়েছিলেন, অনলাইন পরীক্ষার প্রহসনে তাঁরাও পড়াবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষা বিষয়ে ছাত্রদের (এবং অভিভাবকদেরও!) নীতিবোধ একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। ভাবখানা যেন— সবাই টুকছে, আমি কেন টুকব না! আর অনলাইন পরীক্ষার দাবির মধ্যে দিয়ে তাঁরা যে আসলে টুকে পাশ করার দাবি করছেন, সেটা প্রকাশ করতেও তাঁরা আর লজ্জা পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে পড়াশোনার সামগ্রিক মানের যে অবনতি হচ্ছে, তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী। তাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বরাবর লড়ে যাচ্ছেন, যাতে পরীক্ষাটা ঠিকঠাক হয়। কেউ কেউ মরিয়া হয়ে সমাজমাধ্যমে সামান্য হুমকিমূলক পোস্টও দিচ্ছেন এই মর্মে যে, পরবর্তী কালে কোনও সাক্ষাৎকারে অনলাইন পরীক্ষার নম্বরকে তাঁরা আর গুরুত্ব দেবেন না। কিন্তু এই ব্যবস্থায় ছাত্ররা আসলে বোড়ে মাত্র। পরীক্ষা পদ্ধতির পরিচালনায় যাঁরা আছেন, অনলাইন পরীক্ষার যাবতীয় কুফলের কথা তাঁদেরও নিশ্চয়ই জানা; সব জেনেশুনেও তাঁরা কেন ছাত্রদের এই অন্যায় দাবিকে তোল্লাই দিচ্ছেন, সে প্রশ্নের উত্তর বোধ হয় একমাত্রিক নয়।
অনলাইন পরীক্ষা যদি একটি ভারী শিল্প হয়, তা হলে তার বেশ কিছু অনুসারী শিল্প রমরমিয়ে উঠেছে গত দেড় বছরে যার একমাত্র পণ্য হল ‘উত্তর’। যাঁদের উত্তর চাই আর যাঁরা উত্তর লিখে দেবেন তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ করা, বিভিন্ন অ্যাপে তাঁদের জুড়ে ‘গ্রুপ’ তৈরি করা, প্রশ্নপত্র সংগ্রহ, উত্তর লেখা, পৌঁছে দেওয়া— অনলাইন পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ভাগে ভাগে এই সব কাজ হয়ে চলে নির্দিষ্ট চক্রে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একটা দুর্দান্ত গল্পে দেখিয়েছিলেন, একটা সাইকেল থাকলে জীবনে কত কিছুই করা যায়। সাইকেলের বদলে স্মার্টফোন বসিয়ে গল্পটা এখন অনায়াসে নতুন করে লেখা যায়। যেমন পাঁচিল বেয়ে ওঠা, ঢিল বেঁধে প্রশ্ন বা উত্তর ছুড়ে দেওয়া ইত্যাদি পরিশ্রমসাপেক্ষ ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের বদলে এখন যে যার ঘরে বসেই কাজ হাসিল করতে পারেন স্মার্টফোনের সাহায্যে। এবং নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে। এই শেষের কথাটাই আসল, যা গোটা ব্যবস্থাটাকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে, আর সম্ভবত তার জোরের কাছেই গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নতিস্বীকার করছে। অনলাইন পরীক্ষা বন্ধ হলে এই সব অনেক হাত খালি হয়ে যাওয়ার, অনেক লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই হয়তো ছাত্রদের বোড়ে বানিয়ে আসলে সেই সব স্বার্থরক্ষার দাবা খেলা চলছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই অনলাইন পরীক্ষার কথা জানিয়ে দিয়েছে। না হলে যে কঠোর নজরদারির মধ্যে এখনও আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হয়, তাতে অনলাইন পরীক্ষার দাবি এক কথায় নাকচ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা সব সময়ই ক্ষতিকর। এই সঙ্কট মুহূর্তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে শেষ পর্যন্ত অফলাইন পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। ছাত্ররা এবং অভিভাবকরাও যদি বুঝতে পারেন যে, ঝুড়ি ভরা নম্বরের লোভ দেখানো অনলাইন পরীক্ষা আসলে তাঁদের বা সন্তানদের ক্ষতিই করছে, তা হলেই মঙ্গল। বহু বছরের চিন্তাভাবনা-পরিশ্রমে গড়ে ওঠা একটা ব্যবস্থা রাতারাতি বদলে ফেলাটা ভাল নয়।
পরীক্ষাব্যবস্থা অবশ্য অন্য ভাবেও বদলে ফেলা যায়। বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রশ্নপত্র হতে পারে ‘ওপেন বুক’ পরীক্ষার উপযোগী। বই-খাতা-গুগল সব কিছু দেখে লেখার অনুমতি থাকবে। তবে, তেমন কিছু নমুনা প্রশ্নপত্র ছাত্রদের আগে দেখিয়ে নিলে বোধ হয় তাঁরা আর অনলাইন পরীক্ষার কথা মুখে আনবেন না!
সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।