পৃথিবীর ধনীতম নাগরিকদের একটি তালিকায় দেখা যায়, ভারতের অবস্থান বিশ্বে ১৪ নম্বরে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ক্রমবর্ধমান কোটিপতিদের, বিশেষত ডলার-কোটিপতিদের সংখ্যাবৃদ্ধির এই যুগে একটি প্রশ্ন অবধারিত ভাবে জাগে। সেটি এই যে, ‘ক্রেডিট সুইস’, ‘দ্য হরন রিচ লিস্ট’ বা ‘ফোর্বস’-এর মতো বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রাহক সংস্থাগুলি তাঁদের সম্পর্কে, তাঁদের সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে যে তথ্যগুলি প্রতি বছর প্রদান করে, সেই সব তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা ঠিক কতখানি।
সাংবাদিক ক্যাথারিন বেলটন তাঁর সাড়া জাগানো বই 'পুতিন'স পিপল'-এ দেখিয়েছেন যে, মাত্র সাত থেকে আট জন গোষ্ঠীপতি একটি স্তরে রাশিয়ার মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-র অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। এমন স্বল্পসংখ্যক মানুষের দ্বারা পরিবেষ্টিত গণশাসকের উদাহরণ আজকের বিশ্বে বিরল। ভারতে যে দুই ‘আনি’ (আদানি এবং অম্বানী) সম্পর্কে বিবিধ কথা চালাচালি হয়, তাঁদের একেকজনের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। তলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হবে যে, রাশিয়ার কোনও গোষ্ঠীপতির থেকে আদানি এবং অম্বানীরা অনেক বেশি বিত্তশালী। কারাগারে যাওয়ার আগে রাশিয়ার গোষ্ঠীপতি মিখাইল খোদোর্কোভ্স্কির সম্পদের মোট পরিমাণ ছিল ১৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এবং এই মুহূর্তে রাশিয়ার ধনীতম ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার বলেই জানা যায়।
এ সত্ত্বেও কেউ ভারতের এই দুই ধনী পরিবার সম্পর্কে এমন দাবি তোলেন না যে এরা সেই পরিমাণ প্রাধান্য এবং রাষ্ট্রশক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ফলিয়ে থাকে, যা একদা রাশিয়ার গোষ্ঠীপতিরা ফলিয়ে এসেছেন। রুশ গোষ্ঠীপতিরা কার্যত দেশের শাসক কে হবেন, তা পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিতেন। যত দূর জানা যায়, ভারতে প্রায় ১৪০ জন ডলার-বিলিয়নেয়ার রয়েছেন (সংখ্যাটি রাশিয়ার তুলনায় সামান্য বেশি)। ‘ক্রেডিট সুইস’-এর হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালে ভারতে ৭৬৪,০০০ জন ডলার-মিলিয়নেয়ার ছিলেন। অর্থাৎ, যাঁদের সম্পদের পরিমাণ ৭.৫ কোটি টাকা বা তার থেকে বেশি। এই সংখ্যাটি রাশিয়ার ডলার-মিলিয়নেয়ারদের তুলনায় আড়াই গুণ বেশি। কিন্তু সেই সময় ভারতের অর্থনীতি ছিল বৃহত্তর এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের সংখ্যাও সেখানে বেশি ছিল।
শিল্পপতিদের সঙ্গে মোদী। ফাইল ছবি।
পৃথিবীর ধনীতম নাগরিকদের একটি তালিকায় দেখা যায়, ভারতের অবস্থান বিশ্বে ১৪ নম্বরে। এর কারণ শুধু এই নয় যে, ভারত বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতি। এর কারণ আসলে এই, যেহেতু এ দেশে সম্পদ বা উত্তরাধিকারের উপরে কোনও কর নেওয়া হয় না, সেহেতু এই তথ্য সমর্থনের পিছনে ক্রিয়াশীল কোনও সরকারি পরিসংখ্যান নেই।
অবশ্যই ভারতের আয় সংক্রান্ত পরিসংখ্যান রক্ষিত হয়। সেই ২০১৯ সালেই এ দেশে ৭৫,০০০ আমেরিকান ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় বাৎসরিক ৫০ লক্ষ টাকা আয়ের উপরে ঘোষিত ভাবে করপ্রদানকারীর সংখ্যা ছিল ৩,১৬,০০০ জন। সম্পদ এবং আয়— এই দুইয়ের মধ্যেকার ফারাকটি অনিবার্য। এ কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে, বিপুল পরিমাণে আয়কর ফাঁকির ঘটনা এখনও ঘটে চলেছে বা উল্লেখযোগ্য ভাবে হিসেবের বাইরে থাকছে। সেই সঙ্গে কথাও মানতে হবে যে, মুদ্রাস্ফীতি রোধে মূলধনী মুনাফার ব্যাপারে করের ছাড় রয়েছে এবং সেই কারণেই প্রকৃত আয়ের সাপেক্ষে ঘোষিত আয় সর্বদাই কম করে দেখানো হয়।
যদি কেউ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং অর্থসম্পদকে পৃথক ভাবে বিবেচনা করেন, তবে ভাল হয়। ‘ক্রেডিট সুইস’ এবং ‘হরন’ এগুলিকে একত্র করেই দেখে। সাধারণত স্থাবর সম্পত্তিকে সামগ্রিক সম্পদের অর্ধাংশ হিসেবে দেখা হয়। নীচের ধাপের ধনী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে তা ৭৫ শতাংশ। ছড়িয়ে-থাকা সম্পদের প্রকৃত হিসেব নিতে গেলে কোনও ব্যক্তির আদিতম বাসভূমির হদিশ করতে হয় (যা আয় দেয় না এবং যার কোনও তাৎক্ষণিক বাণিজ্যমূল্য নেই)। এই বাসভূমি বাদ দিয়ে সামগ্রিক ভাবে রিয়্যাল এস্টেটের বৃহত্তর অংশকে যদি দেখা যায়, তবে মিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসবে।
রিয়্যাল এস্টেটের এই অংশটি কত বড়? এ ক্ষেত্রেও কোনও কেন্দ্রীভূত পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত খতিয়ান থেকে জানা যায়, ৫ কোটি টাকা বা তার বেশি মূল্যের বাসযোগ্য সম্পত্তি একক ভাবে কিনছেন বা অগ্রিম দিয়ে বেঁধে রাখছেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বছরে ৩০০০-এর আশেপাশে। যদি কেউ এই একক মূল্যের বিষয়টিকে তুলেও নেন, তা হলে দেখা যাবে যে মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা কিন্তু কমছেই। এই সব বিচার করেই বলা যায়, ডলার-মিলিয়নেয়ারদের পরিসংখ্যান-তালিকাগুলিতে খুব সাবধানেই চোখ বোলানো উচিত।
মাত্র সাত থেকে আট জন গোষ্ঠীপতি একটি স্তরে রাশিয়ার মোট জিডিপি-র অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন। ফাইল ছবি।
আরও একটি বিষয় হল খরচের হিসেব। দামি গাড়ি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রথম তিন জার্মান বিলাসবহুল গাড়িনির্মাতাদের বিক্রিবাটা ২০১৭-এ ৩২,৫০০-র সূচক ছুঁয়েছিল। তার পর থেকে সংখ্যাটি কিন্তু পড়তির দিকে। ২০২১-এ সংখ্যাটি দাঁড়ায় মাত্র ২২,৫০০-য়। সেই সময় অতিমারি বহাল ছিল এবং মাইক্রোচিপের আকাল চলছিল। এর সঙ্গে যদি জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার এবং লেক্সাসের মতো উঁচুদরের জাপানি গাড়িগুলিকে হিসেবের মধ্যে আনা যায়, তবে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ৪০,০০০। যা এ দেশের ডলার-মিলিয়নেয়ারদের প্রস্তাবিত সংখ্যার সঙ্গে মোটেও খাপ খায় না।
এই হিসেবের বাইরেও যে ধনী ব্যক্তি নেই, এমন নয়। বহু কোটিপতি রয়েছেন, যাঁরা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে নির্বাচিত ৪,৮০০ ব্যক্তি সম্ভবত ডলার-মিলিয়নেয়ার। অন্তত তাঁদের সাম্প্রতিক সম্পদের পরিমাণ তো সেই দিকেই ইঙ্গিত করে।। কিন্তু শেষমেশ একটি প্রশ্ন থেকেই যায়— এই সব মিলিয়নেয়ারদের গন্তব্যটি ঠিক কোথায়?