ভারতের কাছে কোণঠাসা রাশিয়া আসলে এক দুঃস্বপ্ন-বিশেষ! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
পঁচিশ বছর আগে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার পুর্ব এশিয়ার বৈদেশিক বিনিময়ের ঘাটতিতে ভোগা দেশগুলিকে এক ভুল ওষুধ গিলতে বাধ্য করেছিল। এর ফলে ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের অর্থনীতির প্রায় ভেঙে পড়ার দশা হয়। তিক্ত স্বাদ মুখে নিয়ে ভুক্তভোগী আঞ্চলিক শক্তিগুলি নাক-কান মুলে ‘আর না’ বলে সরে আসে এবং বৈদেশিক বিনিময়ের জন্য সঞ্চয়কে প্রাধান্য দেয়।
তারও তিন দশক আগে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন দুর্ভিক্ষ-পীড়িত ভারতকে গম সাহায্যের বিষয়টিকে এক অস্ত্রের মতো ব্যবহার করেন। কারণ, ভারত সে ক্ষেত্রে গ্রহীতা দেশ হলেও নয়াদিল্লি ভিয়েতনামে সংঘটিত আমেরিকান নিষ্ঠুরতার মুক্তকণ্ঠে নিন্দা করেছিল। ইন্দিরা গাঁধী দৃঢ় স্বরেই বলেছিলেন, “আর কোনও দিনই নয়।” এর পরেই ভারত সবুজ বিপ্লবের পথে পা বাড়ায় এবং সেই পরিমাণ শস্য উৎপাদনে সমর্থ হয়, যা কালক্রমে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডলার-স্তূপের অতিরিক্ত পরিমাণে প্রতিফলিত হয়।
যে সব দেশ এই ধরনের ব্ল্যাকমেলের খপ্পরে পড়েছে, শান্তির সময়ের সুবিধাগুলিকে নজর এড়িয়ে যাওয়ার এক প্রবণতা তাদের মধ্যে থেকেছে। যে সুবিধাগুলি থেকে স্বনির্ভরতা-সঞ্জাত নিরাপত্তার বোধ এবং তার সঙ্গে জড়িত অন্তর্নিহিত বিষয়গুলিকে তারা দেখতে পায়নি। ঠিক এই কারণেই পশ্চিমের দেশগুলি বিমানের যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে অর্থনীতি— প্রায় সব কিছুকেই ‘অস্ত্রায়িত’ করে ভ্লাদিমির পুতিনকে নতজানু করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যার ফল কিন্তু ভবিষ্যতে ভাল দাঁড়াবে না। পশ্চিম যা করেছে, তা আসলে বিশ্বায়নের পরিকাঠামোর উপরে এক ঝাঁক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ। যে কোনও বৃহদায়তন দেশের পক্ষে বিষয়টির স্বরূপ উপলব্ধি করা দুরূহ নয় এবং সেই উপলব্ধি থেকে এর নিদান তৈরিও খুব কঠিন নয়।
ভারতের কাছে কোণঠাসা রাশিয়া আসলে এক দুঃস্বপ্ন-বিশেষ। কারণ, এমতাবস্থায় রাশিয়া চিনের বাহুডোরে বাঁধা পড়তে পারে এবং বেজিং ও ইসলামাবাদ নিয়ে এক সামরিক অক্ষ নির্মাণ করে ফেলতে পারে। এক ক্ষমতাবান প্রতিবেশীকে খোঁচাতে গেলে কী ফল দাঁড়াতে পারে, তার শিক্ষা এই মুহূর্তে ইউক্রেন গ্রহণ করছে। তার দেশবাসীর সেই প্রতিবেশী সম্পর্কে তেমন প্রীতি না থাকলেও সে সামরিক সহায়তা পেতে পারত। কিন্তু তাকে এখন একাই লড়তে হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে এই পরিস্থিতির তুলনা টানলে দেখা যাবে, পরিস্থিতি খুব কিছু পৃথক নয় এবং বেজিং তার সংবেদ কমিয়েই রেখেছে।
আবার এ-ও সত্য যে, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বন্ধনের জায়গাটিও শিথিল হয়ে গিয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বাণিজ্যক্ষেত্রে ভারতের বৃহত্তম সঙ্গী ছিল। কিন্তু এখন ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও তেল ছাড়া আর কিছুই কেনে না। তবু রাশিয়া এখনও ভারতকে সেই জিনিসটির যোগান দেয়, যা আর কেউই দেবে না। সেটি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সরঞ্জাম। ফলে ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধনসূত্র থেকেই গিয়েছে।
কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ ও তার প্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান এ দেশকে দুর্বল করে ফেলতে পারে এবং তার ফলে এ দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প তার স্বমহিমা বজায় রাখতে সম্ভবত ব্যর্থ হবে। রাশিয়ার ‘স্যাংশন-হিট’ অর্থনীতি (এক বা একাধিক দেশের অন্যের প্রতি প্রযুক্ত ক্ষতিকারক চরিত্রের অর্থনীতি, যা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যন্ত বদলে যেতে পারে) তার সরবরাহকারী হিসেবে নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিতে পারে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার ‘ভেটো’ খুব সহজলভ্য হবে না। বিশেষত যদি তা চিনের বিরুদ্ধে প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে। নিরাপত্তার কম্বলের তলায় নিশ্চিন্ত ওমের ঘুমের দিন ভারতের জন্য বহুকাল আগেই বিগত।
যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেন। ছবি: রয়টার্স
এ বিষয়ে আর একটি মত হল, পশ্চিমের সঙ্গে খেলায় অবতীর্ণ হও এবং তারই নির্ধারিত নিয়মে সেই খেলা চালিয়ে যেতে থাকো। এই নিয়মও কিন্তু অ-পশ্চিমী যাবতীয় দেশের প্রতি প্রযোজ্য হয়নি। সেক্ষেত্রে একটি বাছাই কাজ করেছে। ভারত সেই ‘সম্মানিত সাদা চামড়া’-র দলে পড়ে না। এ দেশের জাতপাত, ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ স্মৃতি এবং এর আয়তন ও সাংস্কৃতিক স্বরাটত্ব তাকে ভিন্ন গোলার্ধে নির্ধারিত খেলার নিয়মে খেলতে নামতে প্রথমেই বাধা দেবে। ভারতের পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও জগৎসভায় সমস্যা দেখা দেবে। এমন ক্ষেত্রে কোনও অঙ্গীকার থেকে দূরে থাকার কূটনৈতিক সিদ্ধান্তই হয়তো অধিকতর বুদ্ধিমত্তার কাজ হত।
এইখানেই আত্মনির্ভরতার দায় নিয়ে দ্রুততম প্রতিক্রিয়ার পথটি উন্মুক্ত। এটি অবশ্য একটি আংশিক সমাধানসূত্র, যাতে অন্তর্মুখী অর্থনীতিগুলি খুব লাভবান হয় না। পাশাপাশি, ডলারের কোনও বিকল্প না থাকায় সরবরাহ-শৃঙ্খলের বিষয়টিও বিরাজ করতে থাকে। প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহের জন্য দেশটিকে আমদানি-নির্ভর হয়ে থাকতে হয়। এবং এ ক্ষেত্রে পশ্চিমী বিশ্বই প্রত্যেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। এক মাত্র উত্তর কোরিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ না করলে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন। দেশের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র দেশেই তৈরির বিষয়টি শুনতে যতই ভাল লাগুক, তার বাস্তবায়ন কিন্তু তত সহজ নয়। যদি আমদানি বন্ধ হয়ে যায় আর দেশজ উৎপাদন না ঘটে, আমরা এক স-সে-মি-রা অবস্থায় পৌঁছব। কারণ, প্রায় প্রতিটি অস্ত্রের উৎপাদনের পিছনে আমদানির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যেমন, তেজস বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করে জেনারেল ইলেকট্রিক, নৌবাহিনীর জাহাজের ইঞ্জিন আসে ইউক্রেন থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোদী-পুতিন। ছবি: পিটিআই
এর দ্বারা অবশ্য দেশীয় সংস্থার দ্বারা গঠিত ‘ইন্ডিয়া স্ট্যাকস’-এর মতো উদ্যোগকে ছোট করে দেখানো হচ্ছে না। যা দিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিগত ক্ষেত্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এ থেকে লভ্য সাফল্যের উজ্জ্বলতম উদাহরণ হল ইউনাইটেড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই), যা আমেরিকা-ভিত্তিক জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম)-এর সদ্যোজাত দেশি বিকল্প। যার ব্যবহার মোবাইল ফোন থেকে জাহাজ পর্যন্ত প্রসারিত। যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিরর ভিত শক্ত থাকে, তা হলে তথ্যপ্রযুক্তির বহির্গমন বন্ধ করে ‘ফোর্সড ডেটা লোকালাইজেশন’-ও সম্ভব। নির্মাণভিত্তিক শিল্পের ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতি উৎপাদন-সম্পর্কিত দুর্বল উদ্দীপকগুলিকে পিছন থেকে সমর্থন যুগিয়ে প্রধানতম শিল্পগুলিকে দেশজ পরিসরে নিয়ে আসতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কোন শিল্পটি প্রকৃতই প্রয়োজনীয়, তা খুঁজে বার করা এবং কোনগুলির পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন, তা আগে ঠিক করা দরকার।
আসল কাজটি হল এই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা বুঝে কেল্লা নির্মাণ। নিজেকে পোক্ত জমিতে দাঁড় করানো। ২০১৪ থেকে রাশিয়া ‘স্যাংশন’-এর প্রত্যুত্তরে এক ‘দুর্গের অর্থনীতি’ গড়ে তুলতে চেয়েছে। কিন্তু কার্যত দুর্বল থেকে গিয়েছে। এমন ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিসর বেছে নিয়ে পারস্পরিক নির্ভরতার ব্যবস্থা গড়ে তুললে অধিক ফল দেবে বলেই মনে হয়।