ভারতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়ে লানসেট পত্রিকায় (সেপ্টেম্বর সংখ্যা) প্রকাশিত একটি সমীক্ষা বেশ শোরগোল ফেলেছে। নভেম্বরের শেষে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ একটি নির্দেশিকা জারি করেছে, অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে রাশ টানার জন্য। এই উদ্বেগ নতুন নয়। কোভিডের সময়ে ‘অ্যাজ়িথ্রোমাইসিন’ অ্যান্টিবায়োটিকটির ব্যবহার যথেচ্ছ ভাবে হয়েছে। ওষুধে প্রতিরোধ জন্মে যাওয়ার জন্য বিশ্বে বছরে সাত লক্ষ মানুষ মারা যায়, বলছে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর তৈরি একটি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ল্যাবরেটরি থেকে বাজারে আসতে প্রায় দেড়শো কোটি ডলার খরচ হয়। লাভ কম বলে ওষুধ কোম্পানিগুলো নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে আর উৎসাহী নয়। দীর্ঘ দিন হল নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে না। বরং নতুন নতুন ক্যানসারের ওষুধ তৈরিতে লগ্নি বাড়ছে।
এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। এক দিকে প্রায় তিরিশ বছর কোনও নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়নি, অন্য দিকে যে অ্যান্টিবায়োটিক আছে, তার লাগামছাড়া ব্যবহারে সেগুলো কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। ল্যানসেট-এর সমীক্ষায় ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে। প্রথম, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ তৈরির সবচেয়ে বড় কারণ অযথা বিপুল পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার। দ্বিতীয়, যদিও বিশ্বের মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, তবু ভারতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের উপরে কোনও সার্বিক নজরদারি নেই। পৃথিবীর ৬৫টি দেশের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিস্তৃত তথ্য থাকলেও, ভারতের মতো এত বড় অ্যান্টিবায়োটিকের বাজারের কোনও তথ্য নেই আন্তর্জাতিক মহলে। যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা বলে দেয়, নতুন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক, যেগুলি বাজারে নতুন এসেছে, সেগুলির ব্যবহার ভারতে সামঞ্জস্যহীন ভাবে বেশি।
কিন্তু এ রকম এক অবস্থায় কী ভাবে পৌঁছল অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার? মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য। এ রকম এক পরিস্থিতিতে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার। দোকান থেকে ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে যে কেউ খেতে পারছেন কেন? তার পিছনে এক ধরনের সামাজিক মানসিকতা কাজ করে, রোগী ও ডাক্তার উভয়ের ক্ষেত্রেই। সংক্ষেপে, ১) স্বাস্থ্যের সার্বিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মধ্যে ভেদ, ২) রোগ-কেন্দ্রিক ভাবনা বনাম সমাজ-কেন্দ্রিক স্বাস্থ্যভাবনা, ৩) বেঁচে থাকার প্রতিটি ক্ষেত্রকে চিকিৎসা-বিষয়ক করে তোলার (‘মেডিক্যালাইজ়েশন’) চেষ্টা।
প্রসঙ্গত, ফুটবল, পপ গান, চলচ্চিত্রের তারকারা সর্বসমক্ষে আসতে নাকি অকারণ ভয়ের (‘সোশ্যাল ফোবিয়া’) শিকার হচ্ছেন বলে টিভির পর্দায় জানাচ্ছেন, এবং এর প্রতিকারের জন্য বিশেষ একটি ওষুধ কোম্পানির তৈরি একটি নতুন অবসাদ-বিরোধী ওষুধ ফলদায়ী বলে প্রচার করছেন। এমনকি আগে ওষুধ তৈরি হয়, পরে রোগের লাগসই নামকরণ হয়, এমনও জানা গিয়েছিল। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে এ কথাগুলি হুবহু প্রযোজ্য না হলেও, বাজার ও বিজ্ঞাপনের প্রভাবে যে কোনও অসুস্থতাকেই মানুষ ‘ইনফেকশন’ হয়েছে মনে করেন, এবং ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়েই ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে ব্যবহার করেন। অবশ্য অপ্রশিক্ষিত ‘ডাক্তার’রা মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন। এমনকি ডিগ্রিধারী ডাক্তাররাও প্রয়োজনের বেশি অ্যান্টিবায়োটিক লেখেন, তাই ‘প্রেসক্রিপশন অডিট’ করার প্রস্তাব এসেছে বার বার, কিন্তু শেষ অবধি কোনও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা তৈরি হয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে ২০২০ সালে বলা হয়, ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ বিশ্ব স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম বৃহৎ ঝুঁকি’। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিপুল সংখ্যক মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক-জনিত নানা প্রতিক্রিয়ায় মারা গিয়েছেন। একটি অ্যান্টিবায়োটিক-এর প্রতি প্রতিরোধ অন্য গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক-এর প্রতিও প্রতিরোধ তৈরি করতে পারে। চরিত্র বদলাচ্ছে ব্যাক্টিরিয়াও, কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করবে না, এমন ‘সুপারবাগ’ তৈরি হচ্ছে। কোভিডের সময় ‘মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি’-তে দেড় কোটি মানুষ মারা গিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই সামাজিক উন্নয়ন হিসেবে ধরা হলেও শেষ অবধি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকে সকলের জন্য সুলভ করার নীতি থেকে সরে এসে ‘নির্বাচিত পরিষেবা’-র ধারণা আন্তর্জাতিক মান্যতা পেয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির চাপে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যনীতি প্রভাবিত হয়, চিকিৎসার নির্দেশিকা এবং ডাক্তারদের বিচারপদ্ধতিও প্রভাবিত হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ অপরিমিত ব্যবহার আসলে প্রকৃত রোগ নয়, গভীরতর রোগের একটি উপসর্গ মাত্র।