মুষলপর্ব: ত্রিপুরার রাজনৈতিক হিংসার প্রতিবাদে রাজধানীতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভ, নয়া দিল্লি, ৯ অগস্ট। পিটিআই।
আগামী নির্বাচন কী ভাবে কোন দিকে মোড় নেবে, ত্রিপুরার, এখনই তা বলার সময় আসেনি। তবে অঙ্কুরে অনুমান করা যায়, বাংলার তৃণমূল ওই প্রতিবেশী রাজ্যে ডালপালা ছড়াচ্ছে। সেখানে ভোট হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। মধ্যবর্তী এই দু’বছরে যদি বিশেষ কোনও ওলোটপালট না হয়, তবে লোকসভা নির্বাচনের আগেই ‘মিশন ত্রিপুরা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আর একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
বাংলায় এ বারের ভোটে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ থেকে পঞ্চায়েত স্তরের চুনোপুঁটিরাও ‘পিসি-ভাইপো’ বলে মমতার সঙ্গে অভিষেককে রোজ তুলোধোনা করেছেন। কারণ, ওই নির্বাচনে অভিষেকের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ত্রিপুরাতেও কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের লড়াইয়ে সেই অভিষেক সামনের সারিতে। সোজা কথায়, মমতা তাঁর ভাইপোর উপরে আস্থা রেখে তাঁকেই এগিয়ে দিয়েছেন। কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অল্প দিনের মধ্যে ত্রিপুরার বিরোধী পরিসরে তৃণমূল কংগ্রেসের উঠে আসার লক্ষণ যথেষ্ট স্পষ্ট।
বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরাতেও মমতার দল যদি বাজি জেতে, তবে তো কথাই আলাদা। যদি তারা শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবেও সেখানে প্রতিষ্ঠা পায়, জাতীয় রাজনীতিতে তার তাৎপর্য উপেক্ষা করা যাবে না। বর্তমান প্রেক্ষিতে তৃণমূলের পক্ষে ত্রিপুরাকে পাখির চোখ করা তাই কিছুটা ‘উইন-উইন’ বিবেচনা বলা যেতে পারে।
বঙ্গ রাজনীতির ধারাপথের সঙ্গে ত্রিপুরার কিছু মিল আছে। এখানে যেমন সিপিএম নিয়ন্ত্রিত বামফ্রন্ট সাড়ে তিন দশক ধরে একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করেছে, ত্রিপুরাতেও তা-ই। তবে তা দু’দফায়। প্রথমে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮, তার পরে ১৯৯৩ থেকে একটানা ২০১৮ পর্যন্ত। মাঝখানের পাঁচ বছর শুধু কংগ্রেস রাজত্ব ছিল। অর্থাৎ, বাংলার তৃণমূলের মতো ত্রিপুরায় বিজেপি-ও প্রথম ক্ষমতায় এসেছে বামফ্রন্টকে হটিয়েই ।
আবার বাংলার মতো ত্রিপুরাতেও ক্ষমতা হারানোর পরে গুটিয়ে গিয়েছে সিপিএম। জোশ-জৌলুস, জনভিত্তি সবই কমেছে। কংগ্রেসও ক্ষয়িষ্ণু। ফলে, বাংলায় যেমন ২০১১-র পরে বিরোধী পরিসরের শূন্যতা ভরাতে দ্রুত উত্থান হয়েছে বিজেপির, ত্রিপুরাতে তেমন ভাবে তৃণমূল সেই রকম ফাঁক দিয়ে উঠে আসতে চাইছে। অন্তত এখনকার প্রবণতা সেটাই।
সেই কারণে, সূচনাতেই সেখানে শাসক পক্ষ বিজেপির সঙ্গে সরাসরি সংঘাত শুরু হয়েছে মমতার দলের। আক্রমণ, রক্তারক্তি, ভাঙচুর চলছে। বিরোধীদের জোর করে আটক করে রাখার অভিযোগও উঠছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। এ ভাবে একের পর এক ঘটনা কেন্দ্র করে বিজেপি বনাম তৃণমূল হয়ে উঠেছে ত্রিপুরায় এই মুহূর্তের সবচেয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি।
এ সব থেকে আরও একটি বিষয় বিলক্ষণ বোঝা যায়। তা হল, আগামী ভোটে মূল লড়াই যে তৃণমূলের সঙ্গে, তেমন ‘স্বীকৃতি’ ত্রিপুরার বিজেপি শাসকেরাই ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছেন! ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে বাংলায় আদাজল খেয়ে নেমে পড়া বিজেপিকে রুখে দেওয়ার পরে তৃণমূলের পক্ষে ত্রিপুরাতে রাজনৈতিক অঙ্কে এটা অবশ্যই কিছুটা এগিয়ে থেকে ‘খেলা শুরু’ করার সুযোগ।
যদিও তৃণমূলের সিলেবাসে ত্রিপুরা নতুন কিছু নয়। মমতা যখন বাংলায় বিরোধী নেত্রী হিসেবে শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তখন থেকেই পাশের এই রাজ্যে তৃণমূলকে ছড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তিনি। কারণ, তাঁর দিক থেকে সেটাও ছিল সিপিএমের-ই বিরুদ্ধে আর একটি আন্দোলন। তবে সেই উদ্যোগের শেষরক্ষা হয়নি।
অনেকের মনে থাকবে, ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত সুধীররঞ্জন মজুমদার, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মতিলাল সাহা, আরও এক প্রাক্তন মন্ত্রী এবং অধুনা বিজেপি রতন চক্রবর্তীর মতো নেতারা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন অন্তত দেড় দশক আগে। কংগ্রেসে থাকতেই সুধীরবাবুর সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক ছিল। তা এতটাই জোরালো যে, পরবর্তী কালে মহারাষ্ট্র নিবাস হলে তৃণমূলের সম্মেলনে কমিটি গঠনের সময় মমতাকে দলের সর্বভারতীয় প্রধান করার অন্যতম প্রস্তাবকও ছিলেন ত্রিপুরার সুধীর মজুমদার।
সুধীর-রতনের মতো প্রভাবশালী নেতাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করেও তৃণমূল সেই সময় সাফল্য পায়নি। তার পিছনে একটি কারণ হয়তো ছিল সুধীরবাবুর সঙ্গে রতনবাবুর সম্পর্কের জটিলতা। সে যা-ই হোক, অচিরে ত্রিপুরায় তৃণমূলের ভিত দুর্বল হয়ে যায়। নেতারা অনেকেই কংগ্রেসে ফিরে যান।
মমতা বাংলায় সিপিএম-কে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে ত্রিপুরায় ২০১৩-য় বিধানসভা ভোট হয়। সাংগঠনিক সমস্যায় তৃণমূল তখন সেখানে প্রার্থী দেয়নি। মুখে বলা হয়েছিল, সিপিএমের বিরুদ্ধে ভোট ভাগ তৃণমূল চায় না।
অবস্থা বদলায় ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে। তখন সুধীরবাবু প্রয়াত। রতনবাবুকে চেয়ারম্যান, সুরজিৎ দত্তকে সভাপতি করে আবার তৃণমূল গড়া হল। মমতা আগরতলায় আস্তাবল ময়দানে বিশাল সমাবেশ করলেন। সেই সময় কিছু জায়গায় পঞ্চায়েতও পেয়েছিল তৃণমূল।
প্রসঙ্গত, কয়েক দিন আগেই আমবাসায় তৃণমূলের নেতারা রক্তাক্ত হয়েছেন। তাঁদের উপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাচক্রে সেখানকার পঞ্চায়েতও এক সময় ছিল তৃণমূলের হাতে। ত্রিপুরার পার্বত্য ও জঙ্গল এলাকায় সংগঠন গড়ার সূত্রে কিছুটা প্রভাব তৈরির চেষ্টা তৃণমূল করেছিল।
২০১৪-র লোকসভা ভোটে রতনবাবু এবং ভৃগুরাম রিয়াংকে তৃণমূল প্রার্থী করে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা গিয়েছিলেন প্রচারে। আগরতলা থেকে গাড়িতে কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে শান্তির বাজার। সেখানে তাঁর নির্বাচনী সভা হয়। এলাকাটি, শোনা গিয়েছিল, খুব ‘শান্তির’ নয়। তা সত্ত্বেও দেখেছিলাম, মমতার সভায় প্রচুর ভিড়। তাতে বাঙালি, উপজাতি সবাই আছেন। তৃণমূল জেতেনি। তবে ভাল ভোট পেয়েছিল।
বছর দুয়েকের মধ্যে ছবি আবার বদলাল। এ বার কংগ্রেস থেকে ভাঙিয়ে প্রভাবশালী সুদীপ রায়বর্মণ-সহ ছ’জন বিধায়ককে নিজেদের দলে নিয়ে এল তৃণমূল। নেপথ্যের কারিগর মুকুল রায়। রতন চক্রবর্তী, সুরজিৎ দত্তেরা তৃণমূল ছেড়ে গেলেন। আবার মুকুলবাবু তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার পরে সুদীপ বর্মণেরাও মমতার সঙ্গে থাকলেন না।
এখন তো রতন-সুরজিৎ-সুদীপেরা সবাই পদ্ম-দলে বিধায়ক। তবে বিজেপি সরকারের মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিয়েছেন সুদীপ। তাঁর সঙ্গে দলের টানাপড়েন চলছে বলে জোরদার গুঞ্জন।
এই আবহে আরও এক বার ত্রিপুরার ময়দানে তৃণমূল। আজ পরিস্থিতিতেও অনেক বদল ঘটে গিয়েছে। মোদী-শাহের মোকাবিলা করে বাংলায় বিপুল ভোটে মমতার দলের সদ্য ফিরে আসা যদি তার একটি হয়, অন্যটি তবে এই রাজ্যের মতো পেশাদারি কায়দায় ছক সাজানোর উদ্যোগ।
যেমন, ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের তৈরি সংস্থাকে এ বার বাংলায় তৃণমূলের জন্য কাজে লাগিয়েছিলেন অভিষেক, যার ‘সুফল’ মিলেছে। ত্রিপুরায় তাদেরই তিনি ‘জল মাপতে’ দায়িত্ব দেন। সেই সমীক্ষক দলকে আটকানোর অভিযোগ থেকে পরবর্তী সংঘাতের সূত্রপাত। শোনা যাচ্ছে, সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট যাচাই করেই নাকি তৃণমূল এ বার ত্রিপুরায় পা রেখেছে। তারা মনে করে, বাংলায় চৌত্রিশ বছর পরে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া সিপিএম-কে রাজ্যের মানুষ যেমন এখন ‘ভরসা’ করতে পারছেন না, ত্রিপুরার বেলাতেও সেই যুক্তি প্রযোজ্য হবে। বিকল্পের দৌড়ে তৃণমূলের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা তাই উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
তবে মানতেই হবে, ‘গণতন্ত্র’-এর ফলিত প্রয়োগে বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার চেয়ে মমতার বাংলা এখনও অনেক পিছিয়ে! এখানে ‘রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে’ উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকলেও গত পঞ্চায়েতে ৩৪ শতাংশের বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারেনি শাসক তৃণমূল। আর ত্রিপুরায় বিজেপি একতরফা দখল করেছে ৮৬ শতাংশ!
বিধানসভা ভোট কী ছবি দেখাবে, সময়ই বলবে। শঙ্কা হল, ত্রিপুরেশ্বরীর রাজ্যে এখন থেকেই প্রশ্ন উঠছে, ‘এত রক্ত কেন?’