লোকস্বাস্থ্য মজবুত করতে হবে। তার জন্য সরকারি-অসরকারি সব মহলেই পরিত্রাহি কাতরতা, একই সঙ্গে তুমুল বাণিজ্যিক ব্যস্ততা। কিন্তু, কী ভাবে তা হবে?
অন্য এক ‘অতিমারি’কালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ কিছু অস্বস্তিকর খবর বেরিয়েছিল: বিশ্বের সরকারকুল অঢেল টাকা খরচ করে ইনফ্লুয়েঞ্জার একটি বিশেষ ওষুধ মজুত করেছে, অথচ তার কার্যকারিতা নিয়ে কোনও তথ্যপ্রমাণ বেরোয়নি। এই ওষুধটি নিয়ে যে ‘ট্রায়াল’ চলেছিল, তার অধিকাংশই ছিল ওষুধ কোম্পানিগুলোর বদান্যতায়। তারা এ কথা প্রমাণ করতে পারেনি যে, ওষুধটি সত্যিই ওই ব্যাধির প্রকোপে জটিলতা, হাসপাতালে ভর্তি বা এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি কমায়। ওষুধ কোম্পানিগুলো তথ্য প্রকাশের অনুরোধ সরাসরি খারিজ করে দেয়।
কথাগুলো জানিয়েছেন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এর বরিষ্ঠ সম্পাদক পিটার দোশী, মাসকয়েক আগে, এক সম্পাদকীয়তে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পত্রিকার প্রাক্তন ও বর্তমান সম্পাদকও। তাঁরা জানিয়েছেন, এক যুগ আগেকার বিরক্তিকর ঘটনাবলির একটা ভাল দিকও ছিল। ওষুধবিষুধ নিয়ে তথ্যপ্রমাণ যে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য হওয়া দরকার, কোম্পানির পক্ষে অস্বস্তিকর হলেও কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল যে লোকসাধারণ ও গবেষকদের কাছে চেপে রাখা যায় না, এ ব্যাপারটা নিয়ে সমাজে আলোড়ন উঠেছিল।
কিন্তু লোকস্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। তাই এক যুগ আগেকার ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আজ কোভিডকালে যে সব ‘টিকা’ (এবং ওষুধপত্র) নিয়ে ‘ট্রায়াল’ চলছে তার তথ্যে স্বচ্ছতা নেই— তথ্য দুর্লভ অথবা অনুপস্থিত, কিংবা বিকৃত। এই অনাচার দেখে পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উৎকণ্ঠা: সরকারকুল কি ওষুধ কোম্পানিগুলোর তাঁবেদার হয়ে উঠল?
কোভিড-টিকা নিয়ে ‘ট্রায়াল’ শুরু করেছিল ‘ফাইজ়ার’। তার যাবতীয় তথ্য জমিয়ে রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের, আর তাদেরই ভাড়া করা বিভিন্ন সংস্থার হাতে। তাতে যে নিয়মছাড়া নানা কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, কিছু ধরাও পড়েছে, সে কথা এই জার্নালেই কিছু কাল আগে প্রকাশিত। প্রতারণা ও জালিয়াতির দায়ে ২০০৯ সালে ‘ফাইজ়ার’কে গুনাগার দিতে হয়েছিল প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলার। অন্য অনেক বড় সংস্থাও এই একই দোষে দুষ্ট। তাতে অবশ্য লোকস্বাস্থ্য নিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ‘আগ্রহ’ কমেনি।
‘ফাইজ়ার’ জানিয়েছে, তাদের ‘ট্রায়াল’ প্রাথমিক ভাবে শেষ হতে হতে ২০২৩-এর মে মাস— তবে যত অনুরোধই আসুক, ২০২৫-এর মে মাসের আগে তারা কোনও তথ্যই প্রকাশ করবে না। ‘মডার্না’ জানিয়েছে, খুব অনুরোধ করলে তারা ২০২২-এর অক্টোবরে কিছু তথ্য জানানোর কথা ভেবে দেখতে পারে। ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা’ বলেছে, তথ্যের জন্য অন্তত এক বছর অপেক্ষা করতেই হবে। ওষুধবিষুধের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কম-বেশি প্রায় সব দেশেই আছে। আমেরিকায় এই ব্যবস্থা যাদের হাতে আছে তাদের কাছে তথ্য প্রচুর; কিন্তু নিজে থেকে তারা তা প্রকাশ করে না। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। মামলায় তারা জানিয়েছে, তেমন হলে তারা ‘ট্রায়াল’ থেকে পাওয়া অস্বস্তিকর তথ্যগুলো ঝাড়াই বাছাই করে, মাসে মাত্র পাঁচশো পাতার তথ্য জানাতে রাজি আছে; পুরোটা জানাতে কয়েক যুগ।
তাদের এই আবদার অবশ্য বিচারক মানেননি। জানিয়ে দিয়েছেন, মাসে ৫৫,০০০ পাতার তথ্য জানাতেই হবে, প্রকাশ্যে। এই রায়ে আমেরিকার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিরক্ত, তবে অন্যরা খুশি। তা সত্ত্বেও গবেষকরা অকূল পাথারেই। কারণ, বাদ-বিসংবাদের কলরোলে আপাতত বোঝা যাচ্ছে, ওষুধ বা টিকা কতটা উপকারী বা যথাযথ, তা জানার জন্য বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত রচনাগুলোর উপরেই নির্ভর করতে হবে। কিন্তু স্বাধীনচেতা গবেষকদের মতে, ওই ধরনের রচনাগুলো অসুখবিসুখ ও লোকস্বাস্থ্য নিয়ে কোনও বিজ্ঞানসম্মত দিকনির্দেশ দিতে পারে না, কোম্পানি বা তাদের আশীর্বাদপুষ্ট লেখাজোখার উপরে ভরসাও করা যায় না, তা সে যত নামকরা জার্নালেই প্রকাশিত হোক না কেন। তাই তথ্য দরকার, স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণ দরকার; এখানে দীর্ঘসূত্রতা অন্যায্য।
কিন্তু ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এর সম্পাদকীয় পড়ে আমাদের কী লাভ? আমরা জানি, টিকা, ওষুধ, সরঞ্জাম, সবই লোকস্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী হতে পারে, কিন্তু প্রথমেই দেখতে হবে, তাতে যেন কারও ক্ষতি না হয়। ডাক্তারি শাস্ত্রের এই বনিয়াদি কথাটি ভোলা যায় না, কেননা আমরা এও জানি যে, আধুনিক ডাক্তারি শাস্ত্রেই সুস্থ মানুষকে অকারণে ব্যস্ত করে তোলার বীজমন্ত্র লুকিয়ে আছে। ওষুধ সাম্রাজ্য আমাদের নৈতিকতা ভুলিয়ে দেয়; তারা সুস্থতা, ব্যাধি, টিকা বা ভাইরাস নিয়ে জনমানসে উৎকট উদ্ভট ধারণার বীজ বুনে দেয়। এ দিকে শতাধিক বছরের কসরতে আমাদের মন এমনই পরাধীন যে, ওষুধ কোম্পানিগুলোও যে উপনিবেশ নির্মাণ করতে পারে, তা বুঝে উঠতে দেরি হয়ে যায়।
লোকসাধারণের উপকার-নিমিত্ত এই ঔপনিবেশিক কর্মযজ্ঞে আমাদের দেশের ডাক্তারি জগতের কেষ্টবিষ্টু, ওষুধ শিল্পের মাতব্বর আর প্রয়োগকুশলীদের সম্মিলিত স্তবগান নজর এড়ানোর নয়। তাঁরা অতি বিদ্বান, তবে বিদ্যায় অনেক সময় আলোর চেয়ে তাপ থাকে বেশি। লোকসমাজ বারংবার বিধ্বস্ত অতি তপ্ত বিদ্বানদের হাতেই, ‘অশিক্ষিত’দের হাতে নয়। আমাদের ঔপনিবেশিক মনোভঙ্গি এ কথাও বুঝতে দেয়নি যে, লোকস্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকে জনস্বাস্থ্যবিদদের হাতে। তাঁরাও অতি বিদ্বান, কিন্তু বিদ্যার গরিমাবিহীন, তাই চক্ষুষ্মান। লোকস্বাস্থ্যের উন্মুক্ত আকাশটি তাঁদের চোখেই যথাযথ ধরা দেয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই যে বছরের বিভিন্ন সময়ে মরসুমি ফ্লু-এর উৎপাত বাড়ে, এ কথা তাঁরা ভোলেন না। তাঁরাই আমাদের বলছেন, অতিমারি নিয়ে ভ্রান্তিবিলাসে মগ্ন না থেকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
যে শক্তিগুলো প্রকৃতির দান, তা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী— ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সহজাত কবচকুণ্ডল যে কোনও কারিগরি কৌশলের চেয়ে অনেক গুণ বেশি টেকসই। জনস্বাস্থ্যবিদদের কাছেই চিররুগ্ণ লোকস্বাস্থ্যের ঘরকন্নার সংবাদ মজুত থাকে। তাঁরা জানিয়েছেন, সংক্রমণের হার দিয়ে কিছুই বোঝা যায় না, বুঝতে হয় মৃত্যুর হার দিয়ে। আর আমাদের দেশে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর হার সব মিলিয়ে, ০.০৫ শতাংশ মাত্র। মৃত্যু নিয়েই আমাদের কাতরতা— তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানে, কোভিডকাল শুরুই হয়েছিল মৃত্যুর হাহাকার শুনিয়ে। কিন্তু অভিযোগ, এই সংস্থাও স্বনির্ভরতা জলাঞ্জলি দিয়ে সন্তর্পণে কর্পোরেট-রঞ্জিত হয়েছে।
ইদানীং তাদের রব: ‘এক বিশ্ব এক স্বাস্থ্য’। অথচ, সারা বিশ্বের এক স্বাস্থ্য বলে কিছু হয় না। স্বাস্থ্যের কোনও নিখুঁত সংজ্ঞাও হয় না। লোকস্বাস্থ্যের শাসনপদ্ধতি লোকেই রচনা করে নেয়— বিশ্বের নানা অংশের উদ্ভিন্ন পরিবেশ, প্রয়োজন, রুচি আর ইচ্ছা অনুযায়ী। এখানে তারই স্বাধীনতা, স্বাস্থ্যরক্ষার নামে কোনও ঔপনিবেশিক সেই অধিকার হরণ করতে পারে না। যদি তা পারে তা হলে বুঝতে হবে সে আমার স্ব-ক্ষমতা, সার্বভৌমত্বকেই হরণ করল। সেই ঔপনিবেশিক গোষ্ঠীর সঙ্গে এখন সরকারের যৌথ পরিবার। অতএব তোড়জোড় চলছে, ভারত সরকার লোকসভায় স্বাস্থ্যের ‘নতুন বিল’ আনতে সক্রিয়। সরকার নাকি নাচার, আয়োজনও যথাযথ, এখন শুধু শর্বরী পোহানোর অপেক্ষা।
এ দিকে স্বাস্থ্যরক্ষার নামে উদ্ধত, আত্মম্ভরী বিশ্বাস, আনাড়ি প্রচেষ্টা দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। তাই বুঝেছি, এদের পক্ষে লোকস্বাস্থ্যের নীতিমালা, নৈতিকতা ও ন্যায্যতা রক্ষা করা অসম্ভব। এমতাবস্থায় প্রস্তাবিত চুক্তি ও প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে স্রেফ ‘না’ বলা ছাড়া আমাদের কাছেও অন্য কোনও উপায় রইল কি?