এক অচেনা মিলনের সাক্ষী কুস্তিগিরদের এই আন্দোলনভূমি। ছবি: পিটিআই।
হলুদ গুলমোহর ফুল পড়ে আছে যন্তর মন্তরের রাস্তায়, দুপুরের গরম ‘লু’ উড়িয়ে আনছে শিমুল তুলো। সাদা বড় পাঁচিল টপকে, গোলাপি কাগজ ফুল উপচে পড়ছে ফুটপাথ জুড়ে। চোখ বন্ধ করে ভাবলে এ ছবি বড় রুমানি, সদ্য কৈশোর পেরোনো প্রেমিকের খাতার শেষ পাতার মতো। আশাবাদী, স্বপ্নালু। অথচ এ ছবি আদতে মাহমুদ দারুইশ-এর কবিতার মতো। রুমানি এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত। গত এক মাস যাবৎ যন্তর মন্তর-কে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে রেখেছে বিজেপি সরকার। বড় রাস্তায় ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড। উর্দিধারীরা বন্দুক হাতে ঘিরে ফেলেছে গোটা চত্বর। ওরা সতর্ক, জিজ্ঞাসাবাদ করছে পথ চলতি মানুষদের থামিয়ে। চোখ রাঙাচ্ছে, একটু নরম মানুষ দেখলে রাস্তা ঘুরিয়ে দিচ্ছে। কুস্তিগিরদের আন্দোলনে যাতে বেশি কেউ পৌঁছতে না পারে, সেই চেষ্টায় তারা সচেষ্ট।
এক মাস ধরে সাক্ষী, ভিনেশ, বজরংরা ধর্নায় বসেছে। কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অপহরণ, দুর্নীতি-সহ একাধিক অভিযোগ। হেলদোল নেই সরকারের, একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের পরও কেস ফাইল হয়নি, একটা এফআইআর দর্জ করাতে ছুটতে হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট অবধি। আন্দোলন থামানোর জন্য বাড়ানো হচ্ছে মানসিক চাপ। প্রলোভন দেওয়া হয়েছে অর্থের, প্রতিপত্তির। অথচ মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে খেলোয়াড়রা, তাদের সাথে যোগ দিয়েছে কৃষক ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন, মহিলা ছাত্র যুব সংগঠন। পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন ডান বাম রাজনৈতিক দল এবং খাপ পঞ্চায়েত।
শেষ শব্দ দুটো পড়েই অনেকে নাক কুঁচকেছেন, যে ‘খাপ’ অনার কিলিংকে মান্যতা দেয়, ধর্ষণের জন্য জিন্স প্যান্ট, মোবাইল, চাউমিনকে দোষ দেয়, তারা কি লিঙ্গ সাম্যের লড়াইয়ে সঙ্গী হতে পারে? আপাতদৃষ্টিতে না-পারারই কথা। তবে পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলে রাখা উচিত, এই খাপ পঞ্চায়েতই কিন্তু ২০২০-২১ সালে সর্বশক্তিমান মোদী সরকারের পাতলুন ঢিলে করে দিয়েছিল। পিছু হটতে বাধ্য করেছিল কৃষি আইন প্রণয়নে। এবং ওই একটা বছর খাপ পঞ্চায়েত অনেক কিছু দেখেছে, শিখেছে এবং বদল আনতে বাধ্য হয়েছে। যে জাগমতি সাংওয়ানরা সারা জীবন এই খাপের দাদাগিরির বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন, সেই জাগমতিকেই মহা পঞ্চায়েতে বলতে ডেকেছিল ওরা। মহিলাদের সমান হকের কথা, কৃষক আন্দোলনে আরও সামনে এগিয়ে আসার কথা শুনিয়ে এসেছেন জাগমতি। পাগড়ি মাথায় চেয়ারে বসা প্রধান থেকে শুরু করে ঘোমটায় মুখ ঢাকা মেয়েদের দল চুপ করে শুনেছে সেই কথা, হাততালিতে ফেটে পড়েছে দর্শক আসন। সবিতা আর ভগবান রামকে জানে মারার হুমকি দিয়েছিল খাপ, নিজের জাতে বিয়ে না করার অপরাধে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে বহু দিন। আজ তাদের মেয়ে পিহু মায়ের হাত ধরেই ওই পঞ্চায়েতে গিয়েছে। সবিতা মহিলা সমিতির কর্মী হয়ে বক্তব্য রেখেছে দরাজ গলায়।
খাপ পঞ্চায়েতের এই বদল আসলে উৎপাদনের সম্পর্ক বদলের উত্তর। যে কৃষি সমাজে জমির মালিকানাই ছিল সমস্ত রকম সামাজিক এবং আর্থিক ক্ষমতায় উৎস, নয়া উদারবাদের চক্করে পরে, ক্ষমতার সেই বিন্যাসে পরিবর্তন এসেছে। ‘আগ্ররিয়ান ডিস্ট্রেস’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষির ‘কর্পোরেটাইজেশন’। নয়া পুঁজির আবির্ভাবে ক্রমশ অচল হতে চলেছে গতকালের উৎপাদন সম্পর্ক, এবং সেই সমস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা এই সম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে। ফলে নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে খাপ পঞ্চায়েতর স্বতঃস্ফূর্ত লড়াই আসলে তাঁদের নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াইও।
ভিনেশ ফোগটরা শুধু মাটি কামড়ে পড়ে নেই, মাথা উঁচিয়ে তাঁদের নজরও স্থির। ছবি: পিটিআই।
ভিনেশ, সাক্ষীরা এই কৃষক পরিবারের সন্তান। যে হরিয়ানায় মায়ের পেটেই খুন হয়ে যেত কন্যাভ্রুণ, সেই হারিয়ানার মাটি মেখেই কুস্তির আখারায় নেমেছিল মেয়েরা। পদক জিতে বাড়ি ফেরার পর, খবরের শিরোনামে লেখা হয়েছিল ‘জাঠভূমির সোনার মেয়েরা’। জিন্দ, ভিওয়ানি বা হিসারের মতো জনপদ থেকে উঠে আসা এই মেয়েদের কাছে, খাপ পঞ্চায়েত কোনও ভিনগ্রহী নয়, বরং গ্রামীণ সামাজিক কাঠামোর প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজ সমাজ পরিচলনা করা। ফলে যখন ফেডারেশনের সঙ্গে লড়তে লড়তে ওদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে, যে নেতামন্ত্রীরা এত দিন সেলফি তুলত, আমাদের বাড়ির মেয়ে বলে পরিচয় দিত, তারাই যখন সস্নেহে ব্রিজভূষণের মাথায় হাত রেখেছে, ওরা ফিরে গেছে ওদের গ্রামের চেনা রাস্তায়। সাহায্য চেয়েছে দু’হাত জোড় করে, বাড়ির লোক গ্রামের লোক নিরাশ করেনি। যখন ববিতা ফোগটরা সরকারের তাঁবেদারি করে গিয়েছে, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কিষান ইউনিয়ন, বিভিন্ন জাতের খাপ পঞ্চায়েতগুলো।
ন্যায় ছিনিয়ে আনার এই কুস্তিতে ভিনেশরা বাজিমাত করবে, না কি ওদের গলা চেপে বসে থাকা বিজেপি সরকার ওদের শেষমেস ট্যাপ আউট করতে বাধ্য করবে, তা সময় বলবে। আপাতত সাক্ষী, বজরংরা আর ভয় পাচ্ছে না। পুলিশকে, প্রশাসনকে এমনকি সরকারকেও ভয় পাচ্ছে না। ভয় পাচ্ছে না রাজনীতিকে। যে বৃন্দা কারাটকে একসময় ধর্নামঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল ওরা, পাছে আন্দোলনের গায়ে রাজনীতির রং লেগে যায় এই ভয়ে, সেই মঞ্চেই আবার করজোড়ে ওরা ফিরিয়ে এনেছে বৃন্দাকে, শুভাষিণী আলি থেকে সচিন পাইলটকে। রাজনৈতিক নেতারা সংহতি জানিয়েছেন একে একে। ৯০-এর পরের যে প্রজন্ম বিরাজনীতি শিখেছে প্রতিদিন, যে খেলোয়াড়রা বিশ্বাস করেছে রাজনীতি মানেই তা খারাপ জিনিস, আজ নিজেদের বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতায় বুঝেছে, আসলে রাজনীতির বাইরে কিছু নেই। আমাদের খালি পক্ষ বেছে নিতে হয়, যে রাজনীতি গ্রামের মেয়েটার বিশ্ব জয়ের স্বপ্নের হয়ে সওয়াল করে, যে রাজনীতি কর্মক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া যে কোনও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সরব, সোচ্চার— সেই রাজনীতিই আমাদের রাজনীতি।
ভিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিকরা জানিয়ে দিয়েছে তারা ময়দান ছেড়ে যাবে না। পুলিশ আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করছে। বিভিন্ন পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অবস্থান মঞ্চের সামনে। তবুও আন্দোলনকারীরা অনড়। ব্রিজভূষণের শাস্তি চাই। স্বচ্ছতা চাই কুস্তি ফেডারেশনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে। যাদের মল্লভূমিতে অনুশীলনে ডুবে থাকার কথা ছিল, তারা রাজধানীর মাটিতে বসে আছে।
ওদের পাশে আছে কৃষকরা। ওদের পাশে আছে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রতিবাদী কলম থেকে শুরু করে আরও অনেক অনেক দেশবাসী। ওদের এই লড়াই, আমাদেরও লড়াই। খুব সচেতন ভাবেই বলছি যে আমাদের লড়াই। ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের হাতে নিগৃহীত হওয়ার পরেও মুখ খুলতে পারেনি যে মেয়ে, তার লড়াই। ছোটবেলায় খেলার ছলে নিজের অজান্তেই শৈশব হারিয়ে ফেলেছিল যে শিশু, দিনের পর দিন দুঃস্বপ্নময় জীবন কাটিয়েছে ভয় আর লজ্জায়, এ লড়াই তারও। কৃষকেরা পথ দেখিয়েছে আমাদের। এই হরিয়ানা, পাঞ্জাব-সহ গোটা ভারতবর্ষের কৃষকরা জান কবুল লড়াই করে দেশের সরকারকে বাধ্য করেছে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে। কুস্তিগিররাও পারবে। আমরা পারব। কোনও জাতপাতের সমীকরণ, কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ আমাদের ভাঙতে পারবে না। এককাট্টা হয়ে আমরা জিতে নেব এবং ফিরে যাব গ্যালারিতে। যেখানে সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগটরা কুস্তির প্যাঁচে ঘায়েল করবে প্রতিপক্ষকে। পতপত করে উড়বে দেশের পতাকা। অলিম্পিক, কমনওয়েলথ-সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতায় দেশের পতাকা উড্ডীন করতে চাইলে দেশের পতাকা হাতেই কুস্তিগিরদের লড়াইয়ের পাশে থাকুন। কারণ, ওরাই দেশ। আমি-আপনি মিলেই দেশ। মোদী-শাহ-ব্রিজভূষণদের খপ্পরে দেশ খাতরে মে হ্যায়, তাই দেশকে বাঁচাতে রাস্তায় নামুন, সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়েটির খাতার শেষ পাতার মতো আশাবাদী স্বপ্নালু হোক আমাদের আগামী।
(লেখক ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের নেত্রী। মতামত ব্যক্তিগত।)