সুস্মিতা তাঁর মৃত্যুবাসরে আগাম নিমন্ত্রণ জানিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির কাছাকাছি থাকা ঘনিষ্ঠদের। ছবি: সুস্মিতার পরিবারের সৌজন্যে।
‘রবিবার বিকেলটা কোনও কাজ রাখিস না। দরকার লাগতে পারে।’
‘তুমি কি রবিবার আমাদের বাড়ি আসছ?’
‘জয়, তুই রবিবার বিকেলে এক বার আসিস। সন্ধে করিস না। দিন থাকতে থাকতে আসিস।’
এমন সব নিমন্ত্রণপর্ব চলেছিল পাঁচ-সাতদিন আগে থেকেই। কেউ ভেবেছিল মুন’দি খাওয়াবে কিছু। যেমন অনেক সময়ই ডাকে। কেউ ভেবেছিল কোনও কাজ আছে হয়তো। কিন্তু সদাহাস্যমুখী, প্রিয় মানুষটার কথা বা আচরণ অন্য কোনও সন্দেহ উস্কে দেওয়ার অবকাশ দেয়নি।
কেউ বোঝেননি, আসলে বাড়ির কাছাকাছি থাকা ঘনিষ্ঠদের ওই আগাম আমন্ত্রণ তাঁদের প্রিয় মানুষটির মৃত্যুবাসরে উপস্থিত থাকার জন্য। যে বাসর তিনি নিজের হাতে সাজিয়েছিলেন। গত রবিবার বিকেলে।
প্রিয় মানুষটির নাম সুস্মিতা রায়চৌধুরী (ডাকনাম ‘মুন’)। আড়াই মাস হল ৬০ পূর্ণ করেছিলেন। গত রবিবার, ৩১ অক্টোবর সুস্মিতা নিজের বাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন।
সুস্মিতা বোধহয় ‘হত্যা’ শব্দটায় আপত্তি করতেন। তাঁর কাছে এটা ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’। সুস্মিতা কোনও দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত ছিলেন না। গ্লানি, হতাশা বা তীব্র মানসিক যন্ত্রণাও ছিল বলে নিকটজনেরা মনে করছে না। আচমকা কোনও মানসিক বিপর্যয়ের কারণ ঘটেনি। সুস্মিতার আত্মহত্যার কারণ বিস্ময়কর। চেনা ছকের একদম বাইরের।
এক বছর আগের জন্মদিনে ফেসবুক পোস্টে সুস্মিতা নিজের এপিটাফে লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমার ইচ্ছে, আমার মরণ বাসরসজ্জা আমি নিজেই রচনা করব। এটা আমার খুব ছোটবেলার স্বপ্ন। এ বিষয়ে আমি খুবই রোম্যান্টিক। কোনও দুঃখ না, হতাশা, অবসাদ না। আমার প্রচন্ড ভালোবাসার জীবনকে আমি কিছুতেই স্বাভাবিক যাপনের বিরুদ্ধে আপোস করতে দেব না।’
উত্তর কলকাতা শহরতলিতে ডানলপের কাছে বি-হাইভ গার্ডেনের চারতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন সুস্মিতা। রবিবার বিকেলের পর সেই ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে যখন বন্ধু, প্রতিবেশীরা ঢোকেন, তখন সামনেই খাওয়ার টেবিলে ছিল সুস্মিতার সাজিয়ে রাখা মৃত্যুপূর্ব-আয়োজন। খামে ভরা পুলিশকে লেখা চিঠি। কাকে কাকে সকলের আগে খবর দিতে হবে তাঁদের নাম-ফোন নম্বর। নিজের আধার কার্ড। আলাদা আলাদা ভাবে আরও কিছু নির্দেশ দেওয়া চিঠিপত্র। এবং আর্ট পেপারে লেখা রবীন্দ্রনাথের দামিনীর একটি উক্তি। টেবিলময় সাজানো সব। খুব যত্ন করে সাজানো।
মৃত্যুর দিন দুপুরেও একতলার বাসিন্দা বোনকে জড়িয়ে ধরে আদর করা ছিল। যেমন দৈনন্দিন থাকত। গালে চুমু খাওয়া এবং পাওয়া। কে জানত, এ বার দিদি চারতলায় উঠছে শেষ বারের মতো! রোজকার মতো সেই ভালবাসার হাসিখুশি মুখে বোন সঞ্চিতা কোনও ফারাক খুঁজে পাননি অন্য দিনের থেকে।
সুস্মিতার চারতলার সংসার ছিল বছর কয়েকের ছোট বরকে নিয়ে। তবে তাঁর আসল সংসারটা অনেক বড়। সমাজকর্মীর সংসার। কোনও দল না করলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রে সুস্মিতার কাছাকাছি থাকা মানুষজন, বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অগুন্তি। তাঁদের অনেককেই মৃত্যুর আগে নির্দেশ, বার্তা, পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন সুস্মিতা (সম্ভবত ফোনের ইন্টারনেট কানেকশন বন্ধ করে)। জনে জনে আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ লিখেছেন। তেমন একটি বার্তা ছিল আমার জন্যেও— ‘মুকুল, আমি চললাম। বিদুরের মতো তুমি দেখে রেখো। নিজে ভাল থেকো।’
মেসেজ লেখার পর ফোন বন্ধ করে দেন সুস্মিতা। বেলঘরিয়া থানার পুলিশ রবিবার রাতে সেই ফোন খোলার পরই মেসেজগুলো পৌঁছতে থাকে জনে জনে। অনেক কিছু বলে যাওয়ার পাশাপাশি বরকে ‘নির্দেশ’ দিয়ে গিয়েছেন, ‘অমুকের মাইনেটা অমুক মাস থেকে বাড়িয়ে অত করিস।’ বা, ‘তুই কিন্তু এই ঘরেই থাকবি কাল থেকে...। প্রথম কয়েক দিন রাতে অমুক অমুকদের এসে থাকতে বলবি...। কিছু দিন পর থেকে তার দরকার পড়বে না।’
এ তো সত্যিই নিজের হাতে নিজের মৃত্যুবাসর সাজানো। লিখেছিলেন, ‘সেই ছোট্টবেলা থেকে জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর কথা জানি। জীবনকে যতটা ভালোবাসি, মৃত্যুকেও ততটাই ভালোবাসি। মৃত্যুকে কোনওদিন ভয় পাইনি বলেই তো জীবনকে এতো গভীর ভাবে উপভোগ করতে পেরেছি।’ লিখে গিয়েছেন, ‘রোগশয্যায় শুয়ে মৃত্যুর কাছে কাতর অনুনয় করতে পারব না। ভিক্ষা না, মৃত্যুকেও আমি অর্জন করতে চাই। মৃত্যু আমার কাছে পালানো নয়। আমি মৃত্যুর প্রণয়প্রার্থী।’
তবু প্রশ্ন তো থাকেই। আইনের প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠছে, এই যুক্তিতে তো একটা বয়সের পর সব মানুষেরই আত্মহত্যা করতে হয়! এত মানুষ যে সুস্মিতাকে ভীষণ ভীষণ রকম ভালবাসতেন, তাঁদের প্রতি কি নির্দয় আর নির্মম হলেন না সুস্মিতা?
এ সব প্রশ্ন যে উঠবে, সুস্মিতা জানতেন। অবশ্যই জানতেন। সমাজ, আইন, সম্পর্ক, ভালবাসা— সব কিছু নিয়ে সুস্মিতার নিজস্ব বোধ, নিজস্ব ভাবনা ছিল। দৃঢ় ভাবেই ছিল। তার সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত অধিকারের ভাবনা।
নিজের জীবন-মৃত্যুর নির্বাচন আমার নিজের— পৃথিবীর ইতিহাসে এই চেতনাবোধ ঘিরে কম আলোচনা, কম বিতর্ক হয়নি। আজও হচ্ছে। কিন্তু এ তো শুধু তাত্ত্বিক আলোচনা নয়— ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পনা করে, দিনক্ষণ আগে থেকে ঠিক করে নিজের মৃত্যুর এমন আয়োজনের সাহস আসে কোত্থেকে! কোন মানসিক জোর, জীবনাদর্শবোধের কোন দৃঢ়তা, কোন আত্মবিশ্বাস এই সাহস জোগায়, তা ভাবার মতো তো বটেই। কারণ, এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে তো নয়ই, বিশ্বে খুঁজলেও মনে হয় বিরল। সুস্মিতা ইচ্ছামৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু ভাবনা, বিতর্কের অবকাশ তৈরি করে দিলেন সমাজের সামনে।
সুস্মিতা লিখে গিয়েছেন, ‘যেদিন আমার স্বাস্থ্য আমার সুরে মিলবে না, আমার তালে পা ফেলতে পারবে না, সেদিন বিদায় জানিয়ে আমি জীবনের হাত ছেড়ে দেব। তার আগে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গের দামিনীর মত আমিও আমার সাথীর উদ্দেশ্যে বলে যাব—সাধ মিটিল না, জন্ম জন্মান্তরে যেন তোমাকে পাই। এই উক্তিটি উদাহরণ মাত্র (আমি জন্মান্তরে বিশ্বাস করি না)...।’
সুস্মিতার সেই ফেসবুক পোস্টে ‘লাইক’ বা ‘লভ’ সাইন দিয়েছিলেন অনেকে। তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না সুস্মিতার এই মৃত্যুকে। বলা তো সহজ। সত্যিই কি এমনটা কেউ করে দেখায়! দেখাতে পারে!
ভেবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না সুস্মিতার ‘বিদুর’।