কোভিডের আগে থেকেই অর্থনৈতিক অগ্রগতি শ্লথ হয়ে পড়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে ৪ শতাংশের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। কী করলে আর্থিক বৃদ্ধির হার ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার ৭-৮ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে, এই নিয়ে যখন সবাই ভাবিত, ঠিক তখনই এই অতিমারি— আর আমরাও মুখ থুবড়ে পড়লাম। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক ২.৮৭ লক্ষ কোটি আমেরিকান ডলার ছিল, যা কমে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে আনুমানিক ২.৬২ লক্ষ কোটি আমেরিকান ডলারে দাঁড়ায়— অর্থাৎ, ভারতের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ২০১৯-২০ থেকে ২০২০-২১, এই এক বছরে প্রায় ৮% সঙ্কুচিত হয়।
বিগত ৯ মাসে অর্থনীতিতে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার নয় শতাংশের কাছাকাছি থাকার সম্ভাবনা। করোনার তৃতীয় ঢেউ আগামী দুই মাসে সে রকম ক্ষতি না করলে আশা করা যায় যে, ভারতের জিডিপি তিন লক্ষ কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ, অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগে আমরা যেখানে ছিলাম, দু’বছর পরে সেখানে ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে, শুধু ভারতই নয়, অতিমারির জন্য বেশির ভাগ বড় অর্থব্যবস্থাই ধাক্কা খেয়েছে, এবং প্রায় সবার অগ্রগতিই দু’বছর পিছিয়ে গিয়েছে। সমস্যা হল, আমাদের দু’বছর নষ্ট হল এমন একটা সময়ে, যখন আমাদের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৯-১০ শতাংশ থাকা উচিত— অর্থাৎ, যখন আমাদের গড়ার সময়, তখন দু’বছর নষ্ট মানে বেশ খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া।
যা গিয়েছে, তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। অতিমারির তৃতীয় ঢেউ তেমন বিপজ্জনক হয়নি, কারণ বিগত সাত-আট মাসে বিপুল টিকাকরণ হয়েছে। সরকারের উচিত এটা নিশ্চিত করা যাতে আর অর্থনীতি থমকে না যায়। বর্তমানে প্রায় ৭০ কোটি ভারতবাসীর সম্পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতের মোট ১৪০ কোটি জনসংখ্যার ৬১ শতাংশের বয়স ১৮ বা তার উপর। অর্থাৎ, আনুমানিক ৮৫ কোটি ভারতীয় প্রাপ্তবয়স্ক। আর ১৫-১৮ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা আনুমানিক ৯-১০ কোটি। তাই বর্তমানে ৯৫ কোটির মধ্যে ৭০ কোটির পূর্ণ টিকাকরণ ও ২০ কোটির আংশিক টিকাকরণ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। যথাসম্ভব দ্রুত বাকিদেরও টিকার ব্যবস্থা করা জরুরি।
কিন্তু, শুধু করোনা টিকাকরণ করলেই তো হবে না। ভারতের অর্থনীতিতে এখনও চাহিদার ঘাটতি আছে। মানুষের হাতে টাকা দিলেও তাঁরা সে রকম খরচ করছেন না, ফলে চাহিদার সমস্যা মিটছে না। সরকারের উচিত পরিকাঠামোতে আরও বিনিয়োগ বাড়ানো। অর্থমন্ত্রী ২০২০ সালে ২০২০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত পাঁচ বছরে প্রায় দু’লক্ষ কোটি ডলারের জাতীয় পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা করেন। মোট ৯১৯৩টি প্রকল্পের মধ্যে ২৪২৫টির কাজ চলছে। এই কাজের গতি আরও বাড়াতে হবে। পরিকাঠামো উন্নয়ন যেমন কর্মসংস্থান ও চাহিদা বাড়ায়, তেমনই বাজারের কার্যক্ষমতাকে বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষত গ্রামীণ পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকারের আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত। এতে গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারেরও সম্প্রসারণ ঘটবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটছে না, তখন অভ্যন্তরীণ বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম। কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যুক্তিযুক্ত, অর্থ বিলি নয়। সর্বোপরি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর কথা ভুললে চলবে না। অর্থনীতির স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখতে ও ভবিষ্যতে থমকে যাওয়া আটকাতে আধুনিক ও উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো থাকা আবশ্যিক। আশা করা যায় অর্থমন্ত্রী আগামী বাজেটে কথাগুলি মাথায় রাখবেন।
২০২০ সালের জুলাই-অগস্ট মাসে কেন্দ্রীয় সরকার কিছু জোগানভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ করেছিল— মাঝারি মানের ব্যবসা ও ছোট ব্যবসার জন্য একগুচ্ছ পদক্ষেপ, যাতে তারা সহজে ঋণ পেতে পারে, এবং ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানোর সংস্থান করে রাখতে পারে; কৃষকদের জন্য সহজ কিস্তিতে ঋণ; পরিকাঠামো উন্নয়নে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ; কারখানাজাত উৎপাদন শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং খনি, উৎপাদন-শিল্প, বিমান-শিল্প এবং প্রতিরক্ষায় কাঠামোগত পরিবর্তন ও তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আরও খুলে দেওয়া ছিল উল্লেখযোগ্য। চাহিদার সমস্যা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে এই জোগানভিত্তিক পদক্ষেপগুলি আগামী দু’তিন বছরে দ্রুত আর্থিক প্রগতিতে সহায়ক হতে পারে।
২০২০ সালের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় সরকার কৃষিক্ষেত্রের উদারীকরণ এবং শ্রম আইন সংশোধন ও উদারীকরণে উদ্যোগী হয়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দু’টি ক্ষেত্রেই উদারীকরণ ও আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা আছে। কৃষি আইন কিছুটা সংশোধন ও পরিমার্জন করে বাস্তবায়িত করলে কৃষিক্ষেত্রের ও সাধারণ কৃষকদের লাভই হত। কয়েকটি রাজ্যের ভোটের কথা মাথায় রেখে কৃষি আইন প্রত্যাহার একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। এতে খুব ভুল বার্তা যায় যে, সরকার উদারীকরণ ও আধুনিকীকরণ নিয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নয়, এবং কোনও জনগোষ্ঠী ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থে আন্দোলন করে সরকারকে সংস্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করাতে পারে। উন্নয়নের পথে কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, যা সবার সব সময় পছন্দ হবে না— কূপমণ্ডূকরা আন্দোলন করবেই, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই— কিন্তু, সরকারের পিছিয়ে আসা চলে না। ১৯৯১ সালের আর্থিক উদারীকরণ নিয়েও অনেকের অনেক রকম আপত্তি ছিল— তখন পিছিয়ে এলে এখনও আমাদের মাথাপিছু আয় হয়তো বছরে ৬০০ ডলারের কাছে থাকত। তাতে আমাদের ভাল হত বলে তো মনে হয় না।
২০২৫ নাগাদ ভারত পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হয়ে উঠবে, সেই সম্ভাবনা আর নেই। কিন্তু এখনও যদি আমরা আগামী তিন বছর ৮ শতাংশ হারে আর্থিক বৃদ্ধি ধরে রাখতে পারি, তা হলে ২০২৫ সালে অন্তত আমরা চার লক্ষ কোটির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাব। তবে তার জন্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধিত সমস্ত পদক্ষেপ ঠিক ঠিক করতে হবে।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়