সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় অর্থনীতির হাল আগের চাইতে অনেক বেশি ভাল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক সময়ে ভারতীয় অর্থনীতির মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা দেখে কিছু হিতৈষী পর্যবেক্ষক বলতেন, স্বল্পমেয়াদে দেশের জন্য আশার আলো দেখা না গেলেও, তাঁরা দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে আশাবাদী। ইদানীং বোধহয় এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরোটাই উল্টে গিয়েছে। বহু মানুষই স্বল্প মেয়াদে দেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী, কিন্তু দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে তাঁরা তা নন। এই বলে যুক্তি খাড়া করাই যায় যে, ধারাবাহিক ভাবে বেশ কিছু স্বল্প দৈর্ঘ্যের ফলাফলকে জুড়ে নিলেই তো দীর্ঘমেয়াদি চেহারাটা ফুটে ওঠার কথা। কিন্তু এমন যুক্তি দেওয়ার আগে খানিক ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে।
এ কথা বিশেষ ভাবে স্পষ্ট যে, সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় অর্থনীতির হাল আগের চাইতে অনেক বেশি ভাল। এই মুহূর্তে ভারত সব থেকে দ্রুত বৃদ্ধির বৃহৎ অর্থনীতির দেশ (অতীতেও এক বার খুব কম সময়ের জন্য এটি হয়েছিল)। এমন এক সময়ে ভারতীয় অর্থনীতির এই বৃদ্ধি ঘটছে, যখন জাপানি ও ব্রিটিশ অর্থনীতি সঙ্কুচিত হচ্ছে। গত ত্রৈমাসিকে আমেরিকান অর্থনীতির অবস্থাও ছিল তথৈবচ। আর ইউরো-নির্ভর অর্থনীতির একেবারেই চিঁড়েচ্যাপ্টা দশা। পশ্চিমের এগিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশগুলির থেকে ভারতে মুদ্রাস্ফীতির হারও কম। বাণিজ্যিক দিক থেকে দেখলে আমেরিকা বা ব্রিটেনের তুলনায় ভারতের ঘাটতি (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট) কম। সেই সঙ্গে এ-ও বলা প্রয়োজন যে, আমেরিকান ডলারের প্রেক্ষিতে ভারতীয় টাকার দাম অন্যন্য দেশের তুলনায় অনেকখানি কম হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং এটা ধরে নেওয়া যায় যে, বিষয়টি শুধু মাত্র বৃদ্ধির প্রশ্নে আটকে নেই, এর পাশাপাশি জেগে রয়েছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নও। সে দিক থেকে দেখলেও, ভারত অন্যান্য বৃহৎ অর্থনীতির দেশের থেকে এগিয়ে রয়েছে। বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে এই দিকগুলি ধরে বিচার করলে, এ দেশ এক নম্বরেই রয়েছে বলা যায়।
চিন সাধারণত অর্থনৈতিক ভাবে ভারতের থেকে এগিয়ে থাকত, সম্প্রতি তারও গতিতে শ্লথতা এসেছে। চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ভারতের অর্ধেক বলেই জানা যাচ্ছে এবং সে দেশের অর্থনীতিতে কিছু পরিকাঠামোগত সমস্যাও দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে আর্থিক দিকে। ভারত তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, বিপর্যস্ত এক হিসাবের খতিয়ানকে মেরামত করে তুলতে ঠিক কতখানি সময় লাগে। এর মধ্যে জাপান তার কম মুদ্রাস্ফীতি ও দীর্ঘকালীন বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তের খাতিরে কিছুটা আলাদা অবস্থায় দঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু সে দেশের অর্থনীতিতেও গতিশীলতার অভাব দেখা যাচ্ছে।
বলাই বাহুল্য, দেশবাসীর মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও, ভারত এই সমস্ত দেশের তুলনায় অগ্রগতির এক ভিন্নতর স্তরে রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি অদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন তো দেখা যাবে যে, বিশ্বের গড় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দ্বিগুণ ভারতে রয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে, বাণিজ্য ঘাটতি পূরণের জন্য পুঁজির সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের জন্য অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই রয়েছে। পশ্চিমের প্রধানতম অর্থনীতির দেশগুলির মতো মন্দাবস্থার ভয় ভারতকে অতটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে না। যেখানে ব্রিটেনের বেশ কয়েক দশক আগে করা ভুল পদক্ষেপগুলি সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনমন ঘটিয়েছে, যার পরিবর্তন ঘটাতে হলে অত্যন্ত যন্ত্রণার পথে যেতে হবে, যখন চিনের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বিশ্বের গড় বৃদ্ধির হারের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে এবং আমেরিকার রাজনৈতিক ডামডোল তার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন ভারত অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বলেই মনে হয়।
অভ্যন্তরীণ দিক থেকে দেখলে, ভারতের মতো এক সদাব্যস্ত সরকার সর্বদাই নতুন উদ্যোগের বিষয়ে জড়িত থাকে, উৎপাদনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য ইনসেন্টিভ বা উদ্দীপক প্রদানের জন্য সে বদ্ধপরিকর থাকে, পরিবহণ এবং টেলি-যোগাযোগ শিল্পের পরিকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগের জন্য সে তৈরি থাকে। এই সব বিষয়ে ভারতের পারদর্শিতা আন্তর্জাতিক মানের হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন সঙ্কটে তার নিপুণ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া এবং চলতি সপ্তাহে জি-২০ সম্মেলনে তার প্রভাব সৃষ্টিকারী ভূমিকা থেকে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ সমস্ত কিছু থেকে বোঝা যায় যে, ধনীতর রাষ্ট্রগুলির তুলনায় ভারত এই মুহূর্তে এমন একটি দেশ, যে জানে সে ঠিক কী করতে চলেছে।
তা হলে কেন কিছু পর্যবেক্ষকের চোখে সাম্প্রতিকের উজ্জ্বল ছবিগুলি সুদূরপ্রসারী হয়ে ধরা পড়ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে কিছু অতি পরিচিত সমস্যার সামনে এসেই দাঁড়াতে হবে। সেই সমস্যাগুলির মধ্যে সব থেকে বড় পরিকাঠামোগত সমসা হল, বেকারত্ব। এই সমস্যার সমাধান সহজে সম্ভব নয়। তার উপর আবার সামাজিক অস্থিরতার শিকড়গুলিও এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এর সঙ্গেই রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং পুষ্টির ঘাটতির মতো সমস্যা, যার প্রভাব বিপুল ভাবে গিয়ে পড়ছে শিশুদের উপর, যারা আগামী দিনের শ্রমের উৎস। এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না, এই সমস্ত পিছুটানগুলির জন্যই কোনও দেশ তার বৃদ্ধির গতিছন্দকে উন্নততর অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে না। এই সবের বাইরেও তৃতীয় পর্যায়ের কিছু বিষয় রয়েছে, যা সেই সব রক্ষাকবচগুলিকে সীমিত রাখে, যেগুলি নেতৃত্বগত ত্রুটির ফলে জন্মানো বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থেকে দেশকে বাঁচাতে পারবে।
কিছু পর্যবেক্ষক যে দীর্ঘমেয়াদি পরিসরে নিরাশাব্যঞ্জক ছবিকেই দেখতে পান তার কারণ, সরকারের রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য পূরণের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন বিষয় যখন উপরোক্ত সমস্যাগুলিকে নাকচ করে দেয়, তাঁরা আসলে তা থেকে দুর্ভাবনায় ভুগতে শুরু করেন। সরকার অবশ্য এ বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যে, চলতি দশকটি ভারতেরই দশক, কেন না তাঁদের ধারণায় সাম্প্রতিকের উজ্জ্বল ছবিটি মোটেই ক্ষণস্থায়ী নয় এবং সেই কারণে ‘উচ্চ মধ্য-আয়’-এর দেশের তকমা (৪০০০ মার্কিন ডলারের বেশি মাথাপিছু আয়, বর্তমানে যা ২৪০০ মার্কিন ডলার) হাতের প্রায় নাগালে। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথা সমান ভাবে সত্য যে, অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের রাশ অন্য ভাবে ধরতে হবে, আরও বেশি মাত্রায় সুষম ব্যবস্থা এবং গতি সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এমন যদি না হয়, তা হলে পরিকাঠামোগত পিছুটান আরও বাড়বে এবং অচিরেই গোলযোগ দেখা দেবে।