যারা শুধু ফুটবল বোঝে, ফুটবল তারা কী-ই বা বোঝে?
FIFA World Cup 2022

রাজনীতি আর খেলার মাঠ

ফুটবল খেলা কি সত্যি রাজনীতির বাইরে? রাজনীতি বা অর্থনীতির অস্থিরতার আঁচ লাগে না খেলাটির গায়ে? ২০১৮-র বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলে অভিবাসী খেলোয়াড়দের সংখ্যাধিক্য নিয়ে জোর আলোচনা হয়েছিল।

Advertisement

ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ০৬:০৩
Share:

খেলা: ১৯৩৬ অলিম্পিক্স-এ অস্ট্রিয়া বনাম পেরু ম্যাচের একটি মুহূর্ত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

রাত পেরোলেই শুরু বিশ্বকাপ ফুটবল। অবশ্য, তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক। অভিবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা থেকে শুরু করে এলজিবিটিআইকিউ-দের অধিকার লঙ্ঘন, কাতারকে নিয়ে তর্ক বিস্তর। ফিফা-র ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে, কাতারকে এই দায়িত্ব দেওয়া ভুল হয়েছিল। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোভান্নি ইনফান্তিনো দিন কয়েক আগে প্রতিযোগিতায় যোগদানকারী ৩২টি দলকে চিঠি লিখে বলেছেন, তারা বরং এখন ফুটবল খেলায় মনোনিবেশ করুক— ফুটবল বিশ্বকাপ রাজনীতি বা আদর্শ নিয়ে লড়াই করার জায়গা নয়।

Advertisement

ফুটবল খেলা কি সত্যি রাজনীতির বাইরে? রাজনীতি বা অর্থনীতির অস্থিরতার আঁচ লাগে না খেলাটির গায়ে? ২০১৮-র বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স দলে অভিবাসী খেলোয়াড়দের সংখ্যাধিক্য নিয়ে জোর আলোচনা হয়েছিল। এক দিকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি গোটা ইউরোপ জুড়ে অসহায় উদ্বাস্তু মানুষের বিরুদ্ধে লোক খেপিয়ে চলেছে, আর অন্য দিকে ফ্রান্সের বৈচিত্রময় দলের শীর্ষ সাফল্য প্রমাণ করেছিল যে, মানুষের উ‍ৎকর্ষ বর্ণ-ধর্ম-জাতির ঊর্ধ্বে। রাজনীতিকে বাদ দিলে কি এই জয়ের আখ্যান, তার তাৎপর্য অসম্পূর্ণ থেকে যায় না?

এই লেখা অবশ্য আজকের রাজনীতি নিয়ে নয়। এমন দুটো দলের কথা লিখতে বসেছি, যাদের মধ্যে একটাকে ইতিহাস ভুলে গিয়েছে, অন্যটিও বিস্মৃতপ্রায়। ফুটবলীয় গুণবত্তার বিচারে দল দু’টি কোনও বিশ্বজয়ী দলের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক, নানান টানাপড়েন তাদের উৎকর্ষকে আঘাত করেছে। প্রথমটি অস্ট্রিয়ার জাতীয় ফুটবল দল। সময়টা গত শতকের ত্রিশের দশক— বিভিন্ন কারণে বিশ্ব রাজনীতির, বিশেষত ইউরোপীয় রাজনীতির, তুমুল উথালপাথালের মহালগ্ন।

Advertisement

অনেক ফুটবল ইতিহাসবিদের মতে, গত শতকের ত্রিশের দশকের অস্ট্রিয়া দলই প্রথম ‘টোটাল ফুটবল’ খেলা শুরু করে। ম্যানেজার হুগো মাইস্‌ল-এর তত্ত্বাবধানে সেই অস্ট্রিয়া এপ্রিল ১৯৩১ থেকে ডিসেম্বর ১৯৩২ অবধি টানা ১৪টা খেলায় অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ে। ১৯৩২ সালে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে অস্ট্রিয়া ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপে আসে ফেভারিটের তকমা নিয়ে। বিশ্বকাপের আগের কিছু খেলার ফল দেখলে বোঝা যাবে, এই দলের কতটা আধিপত্য ছিল। জার্মানিকে পর পর দুটো খেলায় ৫-০ এবং ৬-০ গোলে হারানোর পর অস্ট্রিয়া সুইৎজ়ারল্যান্ডকে হারিয়েছিল ৬-০ গোলে, তবে ইউরোপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জয় ছিল হাঙ্গেরিকে ৮-২ গোলে হারানো। তারকা ফুটবলার ম্যাথায়াস সিন্ডেলার ও বিস্ময়-গোলদাতা জোসেফ ‘পেপি’ বাইকান ছাড়াও অধিনায়ক ওয়াল্টার নশ ছিলেন অস্ট্রিয়া দলের আর এক স্তম্ভ।

১৯৩৪-এর বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে ফ্রান্স এবং দ্বিতীয় রাউন্ডে হাঙ্গেরিকে হারিয়ে সেমিফাইনালে অস্ট্রিয়া মুখোমুখি হয় ইটালির। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে খেলা সেই ম্যাচের একমাত্র গোল আসে ১৯ মিনিটের মাথায়, যখন অস্ট্রিয়ার গোলরক্ষক প্লাটজ়ারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে গোল করে ইটালি। সেই ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সুইডেনের ইভান এক্লিন্ড। তিনি আবার ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করার দায়িত্ব পান আয়োজক দেশ ইটালির প্রতি তাঁর পক্ষপাতদুষ্টতার জন্য।

১৯৩৭ সালে হুগো মাইস্‌ল-এর মৃত্যু ঘটে, এবং বলা চলে যে, তার সঙ্গে সঙ্গেই অস্ট্রিয়া ফুটবল দলের শেষের শুরু হয়। অস্ট্রিয়া ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে, কিন্তু সে বছরের ১২ মার্চ দেশটি নাৎসি জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়। হিটলারের নির্দেশ আসে, শুধু জার্মানিই বিশ্বকাপ খেলতে যাবে। সিন্ডেলার-সহ তৎকালীন অস্ট্রিয়ার আরও কিছু খেলোয়াড় সেই দলের হয়ে খেলতে অস্বীকার করেন। জার্মানি সে বার প্রথম রাউন্ডেই হেরে যায় সুইৎজ়ারল্যান্ডের কাছে। হতভাগ্য অস্ট্রিয়া দলের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয় ১৯৩৯ সালে— ম্যাথায়াস সিন্ডেলার এবং তাঁর বান্ধবীর মৃতদেহ পাওয়া যায় তাঁদের নিজের বাড়িতে। সরকারি মতে দুর্ঘটনা, কিন্তু অনেকেই মনে করেন যে, সিন্ডেলার-এর স্পষ্টভাষী চরিত্রের জন্যই তাঁকে এবং তাঁর বান্ধবীকে খুন করা হয়েছিল। অস্ট্রিয়ান কবি ফ্রিডরিখ টরবার্গ তাঁর ‘এক ফুটবলারের মৃত্যুতে’ শীর্ষক কবিতাটি উৎসর্গ করেছিলেন সিন্ডেলারকে। সেই কবিতায় বলা হয় যে, অস্ট্রিয়ায় জার্মান আগ্রাসনের প্রতিবাদেই সিন্ডেলার আত্মহত্যা করেছিলেন।

দ্বিতীয় দলটি পঞ্চাশের দশকের আর্জেন্টিনা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মাথাপিছু সম্পত্তির নিরিখে আর্জেন্টিনার স্থান ছিল পৃথিবীর প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে। তাদের ফুটবল দলও ছিল বেশ শক্তিশালী। ১৯৩০-এর প্রথম বিশ্বকাপে উরুগুয়ের সঙ্গে ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর থেকে ফুটবল এবং দেশের অর্থনীতি, উভয়ই নিম্নমুখী হয়। ফুটবল দলের তারকা লুইস মন্তি আর্জেন্টিনা ছেড়ে ইটালিতে চলে যান পাকাপাকি ভাবে, ১৯৩৪-এর বিশ্বকাপে ইটালির হয়ে খেলেন, সে-বার ইটালি চ্যাম্পিয়ন হয়। এ দিকে আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা খুব টালমাটাল তখন। ১৯৩০-এ সাত দশকের সাংবিধানিক সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শক্তি। এমতাবস্থায় ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দা আর্জেন্টিনার অর্থব্যবস্থাকে একেবারে বেসামাল করে দেয়। সেই সময় থেকে শুরু করে ষাটের দশক অবধি আর্জেন্টিনার অনেক ফুটবলার দেশ ছেড়ে প্রথমে কলম্বিয়া, তার পর ইউরোপের নানান দেশে চলে যান। সঙ্কট চলে দীর্ঘ দিন।

তা সত্ত্বেও আর্জেন্টিনা ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৯, টানা তিন বার কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই দলের প্রাণভ্রমরা ছিলেন আন্তোনিয়ো আনহেলিয়ো, ওমার সিভরি এবং উম্বের্তো মাসচিয়ো। আমাদিয়ো কারিসো— ডাকনাম টারজ়ান— ছিলেন গোলকিপিং-এর নানান টেকনিক্যাল বিষয়ের পথিকৃৎ। রক্ষণ ভাগে ছিলেন হুয়ান ফ্রান্সিস্কো লোম্বার্দো, ফেদেরিকো ভাইরো এবং এলিসেয়ো মোরেনো। ফুটবল পণ্ডিতদের মতে যিনি পৃথিবীর অন্যতম সেরা রাইট-উইং’এর খেলোয়াড়, সেই ওরেস্তে কর্বাত্তাও ছিলেন সেই দলে। তখন ব্রাজিল, উরুগুয়ে, পেরু খুবই শক্তিশালী দল ছিল। কিন্তু এই আর্জেন্টিনা ১৯৫৭-র কোপা আমেরিকাতে উরুগুয়েকে ৩-০, ব্রাজিলকে ৪-০ হারায়। যদি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া খেলোয়াড়দের কয়েক জন, বিশেষ করে আলফ্রেদো দি স্তেফানো এবং এক্তর রিয়াল সে সময়ের আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে খেলতেন, তা হলে হয়তো তখনই বিশ্বজয় সম্ভব হত।

কিন্তু তা হয়নি। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই দলের অনেকেই ক্লাব ফুটবল খেলতে ইটালি চলে যান। দি স্তেফানো, এক্তর রিয়ালরা যে ভাবে রিয়েল মাদ্রিদ-এ ক্লাব ফুটবলের সব পুরস্কার জেতেন, হয়তো আর্জেন্টিনার হয়ে সেই সময়ের বিখ্যাত ত্রয়ী আনহেলিয়ো-সিভরি-মাসচিয়োর সঙ্গে খেললে সেই দল পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা পেত। আর্জেন্টিনার এই দলের ডাকনাম ছিল অ্যাঞ্জেলস উইথ ডার্টি ফেসেস— অসাধারণ ফুটবলশৈলী তাঁদের দেবদূত করে তুলেছিল। আর্জেন্টাইন ফেডারেশনের বোকামি এবং লিরা-র লোভ, এই দুটো কারণেই সেই দেবদূতের দল বিশ্বজয়ী না হয়ে লুকানো মণি হিসেবেই থেকে গেল।

যে কোনও জনপ্রিয় খেলার সঙ্গেই রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের যোগসূত্র থাকে। বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলার সঙ্গে হয়তো রাজনৈতিক বিষয়ের যোগ বেশি। তাই ২০১৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্রোয়েশিয়া এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টদের দেখা যায় আবেগতাড়িত ভাবে খেলোয়াড়দের সংবর্ধিত করতে। ফুটবল মাঠে আমরা যে খেলা দেখি, তা একটি বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এক খণ্ডচিত্র, যার মধ্যেই কেটে যায় খেলোয়াড় জীবন। সিএলআর জেমস-এর কথা ধার নিয়ে বলা যায়— যারা শুধু ফুটবল বোঝে, ফুটবল তারা কী-ই বা বোঝে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement