Farmers

কালো ধান

চাষিরা দীর্ঘ লাইন দেওয়ার হয়রানি বা পরিশ্রম থেকেই কেবল বাঁচতে চান না, তাঁরা চান দুর্নীতি ও অন্যায্য ব্যবস্থার অবসান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ০৬:১৫
Share:

প্রতি বছর চাষিদের একাংশ রাজ্যের নানা ব্লকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান। ফাইল চিত্র।

বাজারে ফসল বিক্রি করে চাষি যাতে লাভ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করার কথা সরকারের। সে পরীক্ষায় সরকার ফেল। অগত্যা চাষিকে ‘মূল্য ধরিয়ে’ পাশ নম্বর তুলতে চান নেতারা। সেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও নিয়ে যাচ্ছে ফড়ে। ক্ষোভ সামাল দিতে সরকারের ঘোষণা, ধান বিক্রি করতে হলে অনলাইনে নাম নথিভুক্ত করতে হবে চাষিদের। অভিজ্ঞতা বলবে যে, কলেজে ছাত্র-ভর্তি থেকে আবাস যোজনা, কোথাও ডিজিটাল প্রযুক্তি স্বজনপোষণ রুখতে পারেনি, অন্তত এই রাজ্যে। তবু যে অনলাইনে নাম লেখানোর নির্দেশই দিল রাজ্য সরকার, এতে ভরসার চাইতে ভাবনা হয় বেশি। প্রথমত, প্রান্তিক চাষির নাম অনলাইনে নথিভুক্তির জন্য যে এক শ্রেণির দালাল গজিয়ে উঠবে, তা প্রায় অবধারিত। দ্বিতীয়ত, এলাকায় পরিচিতির জন্য ভাগচাষি-ঠিকাচাষিরাও সমবায় কিংবা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে ধান বিক্রি করতে পারতেন। জমির কাগজ ‘আপলোড’ করতে না পারায় তাঁরা সরকারি ক্রয়ের আওতা থেকে বাদ পড়বেন। তৃতীয়ত, যে জমি-মালিকরা চাষ করেন না, তাঁরা কিসান মান্ডিতে লাইন দিয়ে কুপন নিতেন না। কিন্তু তাঁদের অনলাইন নথিভুক্তি সহজ, তাই অ্যাকাউন্টের অন্যায্য ব্যবহারের ঝুঁকিও বেশি। সর্বোপরি, এই নির্দেশের ফলে বাংলার লক্ষ লক্ষ চাষির জমির নথি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ভোটার কার্ড এবং আধার কার্ডের তথ্য একটি সরকারি দফতরে মজুত হবে। তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষার আইন ভারতে এখনও পাশ হয়নি। সরকারের তরফে নাগরিকের তথ্যের সুরক্ষায় অবহেলা, এমনকি তথ্য অপব্যবহারের দৃষ্টান্তও এ দেশে কম নেই। কোনও দুষ্টচক্রের হাতে এ সব তথ্য থাকলে দুর্নীতি আরও ব্যাপক এবং সুচারু ভাবে সম্পন্ন হবে, সে আশঙ্কা থেকেই যায়।

Advertisement

প্রশ্ন হল, কেন অনলাইনে নথিভুক্তিকেই স্বচ্ছ ক্রয়ের সেরা পথ মনে হচ্ছে সরকারের? চাষিরা দীর্ঘ লাইন দেওয়ার হয়রানি বা পরিশ্রম থেকেই কেবল বাঁচতে চান না, তাঁরা চান দুর্নীতি ও অন্যায্য ব্যবস্থার অবসান। বার বার দেখা গিয়েছে যে, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কিসান মান্ডিতে তাঁদের বশংবদ কিছু ব্যক্তির নাম ও অ্যাকাউন্ট নম্বর নথিভুক্ত করছেন। চাষির কাছ থেকে অল্প দরে ধান কিনে, সেই সহযোগীদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ওই ব্যবসায়ীরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অধিকাংশটাই আত্মসাৎ করছেন। অনুমান করা চলে যে, রাজনৈতিক প্রশ্রয় না থাকলে তাঁদের পক্ষে বছরের পর বছর এমন চুরি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। অন্য দিকে অভিযোগ, প্রকৃত চাষিদের এত হয়রান করেন কিসান মান্ডির আধিকারিকরা যে, তাঁরা হতাশ হয়ে ফড়েদের ধান বেচতে বাধ্য হন। তবু প্রতি বছর চাষিদের একাংশ রাজ্যের নানা ব্লকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান, ফড়েদের রুখতে কিসান মান্ডিতে রাত জাগেন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার পঁয়তাল্লিশ লক্ষ মেট্রিক টনেরও বেশি ‌ধান কেনে প্রতি বছর, বাজারদরের চাইতে চারশো-পাঁচশো টাকা বেশি দরে। সেই টাকা যদি ন্যায্য প্রাপকদের বদলে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছয়, তবে তা নিতান্তই অপচয়। এত টাকা নয়ছয় হতে দেওয়া চলে না। এমন নয় যে, স্বচ্ছতার উপায়টি সরকারের জানা নেই। তা হল, গ্রাম থেকে ধান কেনা। সমবায় বা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে শিবির করে ধান কিনলে ফড়েদের প্রবেশের সুযোগ কম, কারণ গ্রামে প্রকৃত চাষিকে চেনা যায়। আর একটি উপায়, চাষিদের নিজস্ব কোম্পানিগুলির (এফপিও) থেকে ধান কেনা। এ সব কার্যকর হতে পারে, যদি সরকার এই প্রতিষ্ঠানগুলির সহায়তা করে, তাদের সঙ্গে চালকলের সংযুক্তির উপর জোর দেয়। সর্বোপরি, ভোটে জেতার জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের উপর নির্ভরতা ছাড়তে হবে শাসক দলকে। সরকার এ বার ছোট চাষিদের দুয়ারে এসে দাঁড়াক।

Advertisement

(এই প্রতিবেদন প্রথম বার প্রকাশের সময় ভুল ছবি ব্যবহৃত হয়েছিল। ভ্রম সংশোধন করা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement