দেবের যা জীবনকাহিনি, তাতে তাঁকে নিয়ে ‘বায়োপিক’ হলে আশ্চর্য হব না। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তিনি যখন কল ব্যাক করলেন, আমি তখন অফিসের লিফ্টে। সিগনাল কেটে-কেটে যাচ্ছে। যাচ্ছিলাম চার তলায়। দোতলায় লিফ্ট থামিয়ে এক লাফে বাইরে।
আবেগঘন ভাষণ দিয়ে সংসদ ভবন ছেড়ে বেরিয়েছেন ঘণ্টা দুয়েক আগে। লোকসভায় বাংলা ভাষায় সেই বক্তৃতা রাজনীতি থেকে বিদায় নেওয়ার বাণীতে চুপচুপে ভেজা। তার আগের ক’দিন ধরে যে সমস্ত সঙ্কেত এসেছে, তাতে মোটামুটি এটা নিশ্চিত, যে তিনি আর ভোটে দাঁড়াচ্ছেন না। অবশ্য ঘটনাচক্রে, সেই কাহিনি শুরু হয়েছিল বছর দেড়েক বা দুয়েক আগে। যখন আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক লাইভ ‘অ-জানাকথা’য় অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘আমি আর ভোটে দাঁড়াব না।’’
লোকসভায় তাঁর ভাষণ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই আর দাঁড়াবেন না? তা হলে ২০২৪ সালের ভোটে ঘাটালে কাকে প্রার্থী করবে তৃণমূল? এমনিতেই এ বার ঘাটাল কেন্দ্র তৃণমূলের পক্ষে, যাকে বলে, খুব ‘নিরাপদ’ নয়। তিনি দাঁড়ালে তা-ও একটা সুযোগ ছিল। তা হলে কি বিজেপির খাতায় একটা আসন এখন থেকেই উঠে গেল? এই সব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে ফোনে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম তাঁকে। কিন্তু তিনি সমানে ‘নন রিচেব্ল’।
অবশেষে তাঁর মোবাইল ‘রিচেব্ল’ হল। এবং দীপক ‘দেব’ অধিকারী বললেন, ‘‘আমি তো এক বছর আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম! কিন্তু দিদি শুনতে চাইছেন না। যদিও আমি আমার মনের কথা শুনেছি।’’
আপনি নাকি এ বার ঘাটালে বিজেপির হয়ে দাঁড়াবেন? এটাই নাকি ইদানীং আপনার ‘মনের কথা’?
‘‘আমি দল বদলাব না। আমি সিপিএম বাড়ির ছেলে, যারা কোনও দিন তৃণমূলকে ভোট দেয়নি। সেই বাড়ির ছেলে হয়েও আমি তৃণমূলের হয়ে দাঁড়িয়েছি। ভোট পেয়ে জিতেছি। আমি দল ছেড়ে দেব। কিন্তু দল বদলাব না!’’ একটু থেমে, ‘‘আরে, আমি তো রাজনীতিই ছেড়ে দিচ্ছি! আর আমার মধ্যে লোভ জিনিসটা নেই। ওটা আমি অনেক দিন আগে ত্যাগ করেছি।’’
বাজারচলতি মারদাঙ্গা ছবিতে নায়কের ভূমিকা, ঈষৎ কেঠো উচ্চারণে সংলাপ, ‘পাগলু ডান্স’ বা ‘খোকাবাবু যায় লালজুতো পায়’ থেকে দেব স্বীয় চেষ্টায় নিজেকে দ্বিতীয় স্তরে উন্নীত করেছেন। তাঁর চেয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে জুনিয়র কিন্তু মাপমতো সফল এক অভিনেতা সে দিন বলছিলেন, ‘‘ওর অফিসে গিয়েছিলাম কথা বলতে। দেব কিন্তু অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছে। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সেটা মনে হল।’’
সত্যিই। উতরাই-চড়াই-উতরাই-চড়াইয়ের অভিযাত্রায় দেবের যা জীবনকাহিনি, তাতে তাঁকে নিয়ে ‘বায়োপিক’ হলে আশ্চর্য হব না।
বাবা গুরুপদ অধিকারীর সঙ্গে ১৮ বছর বয়সে কলকাতায় এসেছিলেন। মুম্বইয়ের স্টুডিয়োয় খাবার সরবরাহ করার ব্যবসা ছিল গুরুপদর। বালক দেব, কিশোর দেব তাঁর সঙ্গে যেতেন। যে স্টুডিয়োয় খাবার দিতে যেতেন গুরুপদ, তার মালিককে বলেছিলেন নিজের ছেলের কথা। যদি সিনেমায় কোনও ‘রোল’ দেওয়া যায়। তিনি অট্টহাস্য করেছিলেন। সেই আলোচনা আর এগোয়নি।
মুম্বইয়ের মধ্যবিত্ত যাপনে দেবের বড় হওয়া। বাংলা লেখা তো দূরের কথা, বলতেও পারতেন না ভাল করে (তাঁর বাংলা উচ্চারণ নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে এই সে দিনও ঠাট্টা-তামাশা করা হত)। সেখান থেকে বাংলা ছবির জগতে এসে পড়েছিলেন ১৮ বছর আগে। মুম্বই থেকে বেরোতে চেয়ে কলকাতায় আগমন। আগমন হয়েছিল নির্গমনের জন্যই। কিন্তু ফেরা হয়নি।
কলকাতায় না-এলে বড়জোর মুম্বই ইন্ডাস্ট্রিতে সহকারী পরিচালকের কাজ করতেন। বড়জোর মডেলিং করতেন। কিংবা বাবার ব্যবসায় মনোনিবেশ করতেন। কিন্তু দেব সে পথে হাঁটেননি। বাংলা ভাষাটা চেষ্টা করে রপ্ত করেছেন। বাঙালিয়ানায় নিজেকে অভ্যস্ত করেছেন। দাঁতে দাঁত চেপে উৎকর্ষকে ধাওয়া করে গিয়েছেন। ধীরে ধীরে নামী প্রযোজনা সংস্থার ছায়া থেকে বেরিয়ে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির নায়ক-বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছেন। এমন গাছ, যার তলায় দাঁড়ালে মাথা রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচে। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের পরে এই মুহূর্তে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম বড় নাম দেব। সম্ভবত একমাত্র সাবালক, যাঁর কাঁধে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প তার সমস্ত ওজন নিয়ে বসে আছে। অন্তরাত্মার ডাক শুনে নিজের প্রযোজনা সংস্থা শুরু করেছেন। প্রাণপাত খেটে সেটা দাঁড় করিয়েছেন। ‘গোলন্দাজ’, ‘বাঘাযতীন’, ‘কিশমিশ’, ‘টনিক’, ‘প্রজাপতি’ এবং ‘প্রধান’-এর মতো ছবি বানিয়েছেন। সে ছবি দর্শকেরা কমবেশি পছন্দও করেছেন।
পাশাপাশি রাজনীতি করেছেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল থেকে দু’বার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী লোকসভা ভোটে তাঁর টিকিট কাটা যাবে না, সেই নিশ্চয়তা সত্ত্বেও কেন তাঁকে এত ভাবতে হচ্ছে? বলতে হচ্ছে, রাজনীতিতে থাকতে চান না। আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে থেকে গেলে বলতে হচ্ছে, ‘‘আমি রাজনীতি ছাড়তে চাই। কিন্তু রাজনীতি আমাকে ছাড়তে চাইছে না!’’
দুষ্ট লোকেরা অবশ্য বলে, সিবিআই এবং ইডি নামক যৌথ ‘জুজু’র কারণেই দেবের রাজনীতিতে ‘অনীহা’। গরু পাচারের টাকায় ছবি বানিয়েছেন, এই অভিযোগে তাঁকে ডেকে জেরা করেছিল সিবিআই। তখন থেকেই নাকি দেব রাজনীতিতে ‘বীতশ্রদ্ধ’। দুষ্টুতর লোকেরা বলে, দেবের সঙ্গে নাকি বিজেপির নিরন্তর যোগাযোগ আছে। অতি সম্প্রতি বৈঠকও হয়েছে দু’পক্ষের। তাতে বাংলা ছবির সুপারস্টারকে বলা হয়েছে, ঘাটাল থেকে তিনি যেন নিজেকে সরিয়ে নেন। সে কারণেই এত বিদায়-উপচার। এত পোস্ট। এত আবেগ। এত শেষ দিনের ছবি। হতে পারে। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, দেব মনবদল করার অব্যবহিত পরেই তাঁকে আবার দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছে ইডি। এ কি নিছকই সমাপতন?
এজেন্সির ডাক পেয়ে দেব জানিয়েছেন, তিনি যাবেন। তদন্তে সহযোগিতা করবেন। আইন মেনে-চলা যে কোনও নাগরিক যেমন করেন। কিন্তু তাঁকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, যে লোকটা একটু একটু করে খেটে নিজেকে সাধারণস্য সাধারণ থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, তাকে কি আবার মাটির ধুলোময়লায় নেমে আসতে হবে? দেব কি বাংলা সিনেমার ‘দেব’ হয়ে থাকবেন? না কি নশ্বরতায় অবতীর্ণ হবেন?
ইডেনে ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখার ফাঁকে এক বিশ্বস্তকে দেব বলেছিলেন, ‘‘কাবুলিওয়ালা ওয়াজ় আ স্ল্যাপ অন মাই ফেস! আমি ওটা কোনও দিন ভুলব না!’’ ভুলবেন না বলেই নাকি ঘাটালকে বিদায় জানানোর বিষয়ে মনস্থির করে ফেলেছিলেন দেব। তাঁর ক্ষোভ ছিল রাজ্য মন্ত্রিসভার এক প্রভাবশালী সদস্যের বিরুদ্ধে। দেব এবং মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘প্রজাপতি’ ছবির নন্দনে শো না-পাওয়া নিয়ে খটাখটি বেধেছিল। যদিও তার ‘কারণ’ বর্তানো হয়েছিল মিঠুনের উপর। অর্থাৎ, বিজেপির মিঠুন আছেন বলেই ছবিটা নন্দনে দেখানো হচ্ছে না। সে না-হয় হল। কিন্তু ঘটনাচক্র বলেছে, কিছু দিন আগে মুক্তি পেয়েছিল সেই মিঠুনেরই অভিনীত ‘কাবুলিওয়ালা’। এবং সেটি নন্দনে দিব্য ‘শো’ পেয়েছে।
মূলস্রোতের রাজনীতিতে থাকতে তখনও ‘অনিচ্ছুক’ দেব, নিজের প্রযোজিত ছবিকে জাতে তোলার জন্য প্রাণপাত করা দেব, রাজনীতির পাঁকে না-জড়িয়ে গিয়ে ভোটের আগে প্রতিপক্ষকেও শুভেচ্ছা জানানো দেব বুঝে ফেলেন (অথবা তাঁর মনে হয়), তাঁর গালে বিরাশি সিক্কার একটি চড়ই পড়েছে! বিজেপি বা মিঠুন ফ্যাক্টর নন, নন্দনে জায়গা পায়নি দেবের অভিনীত ‘প্রজাপতি’। অর্থাৎ, কাঁচি (মতান্তরে কাঠি) করা হয়েছে তাঁকেই।
দলের অন্দরে বিষয়টা ইতিউতি জানিয়েছিলেন দেব। ক্ষোভের কথা জেনে স্বয়ং মমতা তাঁকে কালীপুজোর পরদিন বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে একান্তে বৈঠক করেছিলেন। দেব তবুও ভোটে লড়তে রাজি হননি। অতঃপর মমতার বাড়িতে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলানেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক। সেখানে মমতা একপ্রকার তাঁর নাম ঘাটালের জন্য ঘোষণাই করে দিয়েছিলেন। দেব সেখানে কিছু বলেননি। কিন্তু বৈঠকের বাইরে নিজের কিছু ঘনিষ্ঠকে বলেছিলেন, তাঁর ভবি ভুলছে না। সেই মন্ত্রীকে তাঁর কাছে এসে অন্তত একটা আনুষ্ঠানিক দুঃখপ্রকাশ করতে হবে। নইলে তিনি লোকসভা থেকে বিদায়ের গান গেয়ে দেবেন।
বিষয়টা সে দিকেই গড়াচ্ছিল। যদি না ঠিক সময়ে স্বয়ং মমতা হস্তক্ষেপ করতেন। দলের এক নেতাকে তিনি নির্দেশ দেন দেবের সঙ্গে কথা বলতে। ক্ষুব্ধ সাংসদের সঙ্গে একপ্রস্ত কথা বলে সেই নেতা মমতাকে জানান, ঘাটালের বিদায়ী সাংসদের কিছু ক্ষোভ আছে। এবং তার ভিত্তি যে একেবারে নেই, তা-ও নয়। অতঃপর অভিষেকের অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন দেব। সেখান থেকে কালীঘাটে মমতার বাড়িতে। তার কয়েক দিন পরেই হেলিকপ্টারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী দেব। আরামবাগের সভা থেকে বলে দেন, তাঁর দেখা শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁকে দেখে যে সহর্ষ গর্জন উঠেছিল জনতার মধ্য থেকে, তা তৃণমূলের পক্ষে স্বস্তির।
কিন্তু তার পরেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ডাক যে নিশির ডাকের মতো ধেয়ে এল, তা কি দেবের পক্ষে অস্বস্তিকর নয়? যে ভাবে একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে তিনি এই উচ্চতায় পৌঁছেছেন, তাতে কি তাঁর এটা প্রাপ্য ছিল?
দেবের সঙ্গে কখনও ঘন এবং আঠালো সম্পর্ক হয়নি। বরং সব সময় উভয় তরফে একটা সম্ভ্রমসূচক দূরত্ব বজায় থেকেছে। রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞানরহিত দেব ২০১৪ সালে যখন বিস্তর টানাপড়েনের পরে লোকসভা ভোটে লড়তে রাজি হলেন (গোটা একটা রাত বিনিদ্র গড়িয়েছিল সেই ‘যাব কি যাব না’র দড়ি-টানাটানিতে) তখন তিনি লোকসভা ভোটের প্রার্থী হিসেবে রাজনীতির ময়দানে নেহাতই নাদান, ঘাঁতঘোঁত তেমন বুঝে উঠতে পারেননি। ঘটনাচক্রে, সেই সময়ে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে তোলপাড় পড়েছিল। সেটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থাকার কারণে আমাকে দেব দ্রুত তাঁর অহিতৈষীদের তালিকায় ঠেলে দেন।
রিওয়াইন্ড বোতাম টিপে দশ বছর পিছিয়ে গিয়ে দেখলে অবশ্য বুঝতে পারি, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ভুল করেননি। সামনে প্রায় অনিশ্চিত এক রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, কাকে বিশ্বাস করবেন আর কাকে অবিশ্বাস, সেই দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছেন। রাজনীতির ময়দানে বাধ্যতামূলক ভাবে কী বলবেন আর মুখ ফস্কেও কী বলবেন না, সেই পাঠ তখনও তাঁর রপ্ত হয়নি। সেই নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে যে মন্তব্য তিনি করেছিলেন, তা খুব নরম করে বললেও ‘ভয়াবহ’। প্রকাশ্যে সে কথা বলা যায় না। ‘পাবলিক ফিগার’ হলে তো আরওই যায় না। সে কারণে বিস্তর গোলমালেও পড়েছিলেন। কিন্তু কখনও নিজের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। বা বেশির ভাগ রাজনীতিকের নেওয়া পরিচিত রাস্তায় ঢুকে পড়েননি যে, মিডিয়া আমায় ‘মিস্কোট’ করেছে। যত দূর মনে পড়ছে, প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন। তার পরেও প্রতিটি বাউন্সার গায়ে-মাথায় নিয়েছিলেন। কালশিটেও খুব কম পড়েনি। কিন্তু সে সব ঝড়ঝাপটা সামলে জিতেছিলেন। অবিমৃশ্যকারিতা এবং বাংলা ছবির নায়কসুলভ চাপল্য তাঁকে চোরাবালির মতো অতলে টেনে নিতে পারত। দেব তা হতে দেননি।
কিন্তু দেবের সঙ্গে সম্পর্কটা আর ঠিকঠাক হয়নি। ২০১৪ সালের পরে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির রমরমার বাজারেও দেব জিতেছিলেন। অভিনন্দন-টন্দন জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কারণ, তাঁর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ। যা জারি ছিল প্রায় ছ’বছর। যত দিন না দেব আবার নিজে থেকেই যোগাযোগ করেছেন এবং আনন্দবাজার অনলাইনের ‘অ-জানাকথা’য় আসতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাতে অবশ্য আমার লেজ গজায়নি। দেবও ছোট হয়ে যাননি। বরং আরও বড় হয়েছেন। বুঝতে পেরেছি, দেব অতীতের স্লেট মুছে ফেলে নতুন আখ্যান লিখতে চাইছেন। সেটা জীবনের সমস্ত স্তরেই। পেশাগত হোক বা ব্যক্তিগত। তার পর থেকে দু’পক্ষের সম্পর্কে একটা ‘জলচল’ হয়েছে।
দেবকে অবশ্য বরাবর দিব্যি লাগে। সরল। সোজা। সাদাসিধে। সম্ভবত বাল্যকালের দারিদ্র্য, খানিক অভাবের সংসারে নিরাভরণ যাপন এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার নিরন্তর লড়াই তাঁর মধ্যে এই মূল্যবোধ বা গুণগুলোর জন্ম দিয়ে থাকবে। কিন্তু তাঁর মধ্যে যে বিষয়টা চিরায়ত ভাবে চিত্তাকর্ষক হয়ে থেকেছে, তা হল তাঁর রুচি এবং ভদ্রতার বোধ। দেব বরাবর নিজের মতো করে একটা অবস্থান নিয়েছেন এবং তাতে অনড় থাকার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বাংলা উচ্চারণ, অভিনয় করার ক্ষমতা (অনেকের মতো ‘অক্ষমতা’), টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রির বটবৃক্ষের ছায়াভরা এবং নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে বেরিয়ে নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা শুরু করা এবং নিজের শর্তে, নিজের মতো ভাল ছবি বানানোর চেষ্টা নিয়ে অনেকেই মাপমতো শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন এবং সন্দিহান ছিলেন। অনেকে খানিক ঠাট্টা-মশকরা করারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দেব তোয়াক্কা করেননি। তিনি নিজের অধীত অভিজ্ঞতা, ভাল ছবি করার দুর্দমনীয় ইচ্ছে, দশের মধ্যে এক হওয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা এবং একরোখা জেদ নিয়ে ঝান্ডা-হাতে এগিয়ে গিয়েছেন।
পেশাগত উৎকর্ষের খোঁজে তাঁর সেই যাত্রাপথে কি কোথাও রাজনৈতিক দায়িত্বের ভাগ একটু কম পড়েছিল? ঘাটাল কি তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় খানিক নীচে নেমে গিয়েছিল? লোকসভায় কি তিনি খানিক বেশিই অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন? হতে পারে। না-ও পারে। কিন্তু দেব মনে করছিলেন, রাজনীতির পথ ক্রমশ শ্বাপদসঙ্কুল এবং বন্ধুর হয়ে উঠছে। বস্তুত, ঘাটালের তৃণমূল সাংসদের মনে হয়েছিল, তিনি দলীয় রাজনীতির শিকার। তাই সমস্ত ছেড়েছুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিলেন। তার নড়চড় হওয়ারও কথা ছিল না। মমতা-অভিষেক জুটি কার্যত অসাধ্যসাধনই (তৃণমূলের এক শীর্ষনেতার মতে ‘গোললাইন সেভ’) করেছেন।
শাসকদলের অন্দরে সূক্ষ্ম ওঠানামা সম্পর্কে যাঁরা অবহিত, তাঁরা আপাতত আগ্রহ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর অবস্থানের দিকে তাকিয়ে আছেন। তৃণমূলশ্রুতি: দেব যথাস্থানে যা যা বলার বলেছেন। ছবি-সহ কিছু প্রমাণও পেশ করেছেন। তার ভিত্তিতে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে মন্ত্রীপ্রবরের দূরত্ব বাড়ে কি না, তার দিকে তাকিয়ে আছেন অনেকে।
কিন্তু তার চেয়েও বেশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে এই নিয়ে যে, এজেন্সি নামক নিশির ডাকের পর দেব কি আবার গাড়ি রিভার্স গিয়ারে ফেলবেন? না কি তাঁর নেত্রী যা বলেছেন (‘‘রাজনীতিতে থাকলে এ সব অনেক হয়’’), সেটাই মেনে লোকসভা ভোটের দিকে এগোনোর জন্য অ্যাক্সিলারেটরে পা রাখবেন?
দীপক অধিকারী ‘দেব’ থাকবেন, না কি নশ্বরতায় অবতীর্ণ হবেন?