সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা
One Nation One Election

এ বার ‘এক নির্বাচন, এক দল’?

পূর্বে প্রকাশিত কিছু নির্বাচনী তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, কেন্দ্র এবং রাজ্যে দু’রকম পার্টিকে ভোট দেওয়ার প্রবণতার পিছনে একটা বড় কারণ আলাদা আলাদা সময়ে লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট হওয়া।

Advertisement

শৈবাল কর

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৪ ০৮:৫৫
Share:

এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা পুরসভা, বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে ভিন্ন ভিন্ন দলের প্রার্থীকে সমর্থন করেন। এই প্রবণতা বহুদলীয় গণতন্ত্রে আশ্চর্য নয়। রাজ্যস্তরের নির্বাচনে মানুষ গত চার দশক ধরে ক্রমশ আরও বেশি করে বেছে নিয়েছেন আঞ্চলিক, অথবা খাতায়-কলমে সর্বভারতীয় হলেও প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক দলগুলিকে। বেড়েছে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সর্বভারতীয় দলের জোট সরকার তৈরির প্রবণতাও। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চায়, এমন কোনও একক দলের কাছে প্রবণতাটি অস্বস্তিকর। ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ চালু হলে কি রাজ্যস্তরের রাজনীতির এই চলন পাল্টাতে পারে?

Advertisement

‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর বিষয়টি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে। এই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি ১৮৬২৪ পাতার এক রিপোর্ট জমা করেছে গত মার্চ মাসে। তাতে সুপারিশ করা হয়েছে যে, পুরসভা, বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচন যেন এক সঙ্গে হয়। তার জন্য প্রয়োজন হলে কিছু কিছু রাজ্যে চলতি বিধানসভার মেয়াদ ছোট করতে বলা হবে।

পূর্বে প্রকাশিত কিছু নির্বাচনী তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, কেন্দ্র এবং রাজ্যে দু’রকম পার্টিকে ভোট দেওয়ার প্রবণতার পিছনে একটা বড় কারণ আলাদা আলাদা সময়ে লোকসভা এবং বিধানসভার ভোট হওয়া। এই ব্যবস্থা পাল্টে একই সঙ্গে জাতীয় এবং স্থানীয় ভোট হলে তার প্রভাব জনমানসে অন্য রকম হতেই পারে। একটি সমীক্ষার ফলাফল বলছে যে, এক সঙ্গে ভোট হলে কেন্দ্রে যে দলকে ভোট দিয়েছেন মানুষ, রাজ্যেও তাকে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ৭৭%! অর্থাৎ, যে দলের প্রার্থীকে মানুষ সংসদে পাঠাচ্ছেন সেই দলের প্রার্থীকে বিধানসভাতেও মনোনীত করছেন প্রায় নিশ্চিত ভাবেই। এর গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ আগেও দেখা গিয়েছে যে যখন নির্দিষ্ট কোনও দলের স্বপক্ষে বেশ জোরালো সমর্থন তৈরি হয়, তারা রাজ্যস্তরে এবং জাতীয়স্তরে এক সঙ্গে ভাল ফল করছে।

Advertisement

সাধারণ ভোটদাতার কাছে ভোটের আগে প্রচুর তথ্য আসতে শুরু করে— দল, প্রার্থী, তাদের বিগত কর্মকাণ্ড, জিতলে কী করবে ইত্যাদি বিষয়ে। আদর্শ পরিস্থিতিতে নাগরিক সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দল এবং প্রার্থী চয়ন করবেন বলে প্রত্যাশিত। কিন্তু, পছন্দের দল আগে ঠিক করে ফেললে প্রার্থী চয়ন ভোটদাতার হাতে থাকে না। আবার এমন হতে পারে যে, প্রার্থী পছন্দের হলে সেই দল ভোট পেয়ে থাকে। তথ্য জোগাড় করা এবং মন দিয়ে বিশ্লেষণ করা শ্রমসাধ্য এবং জটিল। মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এত সময় এর পিছনে ব্যয় করেন না। মানুষ যেমন নির্দিষ্ট কিছু ব্র্যান্ড পছন্দ করেন, সে রকম অনেকে পরিবার বা গোষ্ঠী হিসাবে নির্দিষ্ট দলকে মনোনীত করে রাখেন এবং যূথবদ্ধ ভাবে তাদের ভোট দেন। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের পরিশ্রম কম, কিন্তু দেশ ও রাজ্যের ক্ষতি হতে পারে।

বহুদলীয় রাজনীতিতে দলের সংখ্যা বাড়লে ভোটদাতার পছন্দের পরিধি বাড়ে এবং তার সঙ্গে উপযোগিতাও। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রার্থী দিলে তাদের মধ্যে কারও না কারও ঘোষিত আর্থসামাজিক পরিকল্পনার সঙ্গে আমাদের পছন্দ মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর ফলে ভোটদাতার উৎসাহ যেমন বাড়ে, তেমনই রাজনৈতিক দলের উন্নয়ন পরিকল্পনায় আপনার স্থান আছে কি না তারও একটা প্রমাণ পাওয়া যায়। রাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতির মেরুকরণ ঠেকাতে ছোট দল বিশেষ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।

রাজ্য এবং জাতীয়স্তরের দলের মধ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। স্থানীয় দল রাজ্য সম্বন্ধে বেশি জানে ও তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে, যা তারা সংসদে দাবি করবে বলে প্রচারে নামে। জাতীয় দলের পক্ষে জাতীয় নির্বাচনের সময়ে এ রকম অঙ্গীকার করা শক্ত, যদি না রাজ্যভিত্তিক ইস্তাহার তৈরি করে সেই দল। রাষ্ট্রীয় দলের কাছে বড় প্রকল্প, আন্তঃরাজ্য পরিকল্পনা গুরুত্ব পায় বেশি, যা একটি রাজ্যের ছোট ছোট বিষয় বা উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে চট করে সংযুক্ত করা যায় না।

কিন্তু এই ধরনের প্রকল্পে রাজ্যের লোকের তাৎক্ষণিক প্রয়োজন না-ও মিটতে পারে। যেমন ধরা যাক, এই মুহূর্তে বেশির ভাগ রাজ্যেই মোটামুটি ৪০% যুবক-যুবতী কর্মসংস্থানের বিষয় নিয়ে চিন্তিত। বিজেপি চাকরি সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে কার্যত একটি কথাও বলেনি। কংগ্রেস জিতলে সর্বভারতীয় স্তরে কী করবে, বলেছে। কিন্তু তার মধ্যে নির্দিষ্ট একটি রাজ্যের সমস্যা কী ভাবে মিটবে, বলা সম্ভব নয়। রাজ্যভিত্তিক দলগুলো এই ঘাটতি মেটানোতে অনেক বেশি মনোনিবেশ করে এবং তাদের প্রার্থীরা দায়বদ্ধ থাকেন। সেখানেই তাদের গ্রহণযোগ্যতা। এর সঙ্গে, নতুন দলগুলো সুবিধা পেয়েছে যে-হেতু কেন্দ্র ও রাজ্যের নির্বাচন বিভিন্ন সময়ে হয়েছে বেশির ভাগ রাজ্যে। ভোটদাতারা সময় পেয়েছেন নতুন তথ্য বিশ্লেষণ করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

সব নির্বাচন এক সঙ্গে ঘটলে তথ্যের ঘনঘটা এবং মিশ্রণে দুধ আর জল আলাদা করা শক্ত হবে বিলকুল। রোদ্দুর মাথায় নিয়ে ভোটের লাইনে দঁড়িয়ে ক’জনই বা শুধু দুধটুকু পান করতে পারবেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement