বইমেলা কি পাঠকের না লেখকের? না কি প্রকাশকের? মেলায় পাঠকেরা ভিড় করেন, তাঁরাই বইমেলার প্রাণ। প্রকাশক তাঁদের মিলিয়ে দেন লেখকের সঙ্গে। লেখকেরাও মেলায় উপস্থিত হন নিজেদের লেখার ঝুড়ি নিয়ে, তাঁদের বই, লেখাপত্র ছড়িয়ে থাকে ইতস্তত। কোনও লেখক নিত্য উপস্থিত, কোনও লেখক পলাতক, ধরা দেন না। ও দিকে স্টল নম্বর আর সূত্র ধরে পছন্দের লেখকের বই-দরবারে ঠিক পৌঁছে যান যথার্থ পাঠক।
এই লেখক-পাঠক সম্মিলন কি সত্যি এমনটাই? পাঠক বই কিনে হাহুতাশ করছেন ‘খারাপ লেখা’ তিনি আগে পড়েননি, এও শোনা যায় প্রায়ই। কিন্তু লেখকের হাহুতাশ? তিনি কি এই হতাশা প্রকাশ করতে পারেন না, তিনিও দেখা পাননি প্রকৃত প্রস্তুত পাঠকের? পাঠক ‘অর্জন’ না করতে পারা যে তাঁরও নিশ্চিত ত্রুটি। লেখকের লেখা নিয়ে বিচারের জন্য আছে সমাজমাধ্যম, খবরকাগজ, পত্রপত্রিকা, কিন্তু অপ্রস্তুত পাঠকের প্রস্তুতিহীনতা নিয়ে বেদনা প্রকাশের কোনও মাধ্যম নেই। কোথায় এই রসিক পাঠকেরা, তাঁদের চিহ্ন কী? লেখক জানেন না, প্রকাশকও জানেন না।
সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে, লেখক একা প্রস্তুত হলেই হবে না, প্রস্তুত হতে হবে পাঠককেও। যে পাঠকের মন নিত্য সাহিত্যপাঠে উজ্জ্বল— যেমন উজ্জ্বল হয় নিত্য মোছার পর আয়না— সেখানেই প্রকৃত সাহিত্যের প্রতিফলন হবে। নয়তো ভুল হয়ে যাবে গতিপথ, রসাস্বাদন যথার্থ হবে না। হবে না লেখক বা কবির মনের সঙ্গে প্রকৃত মিল। পাঠক হাঁটবেন সমান্তরাল অন্য কোনও পথে। ফলত জনপ্রিয়তা নিয়ে বিভ্রান্ত হবেন সকলেই— এমনকি প্রকাশকও। তিনি লেখক নির্বাচন করবেন জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে, করছেনও হয়তো।
এই বিভ্রান্তি অবশ্যম্ভাবী। ঠিক যেমন অবশ্যম্ভাবী লেখকের ক্রমাগত জনপ্রিয় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, যা তাকে অপ্রস্তুত পাঠকের মনোরঞ্জন করা ছাড়া অন্য কোনও দক্ষতায় উত্তীর্ণ করায় না। আর এই সব সম্ভাবনাই ক্রমশ বাড়তে থাকে কারণ লেখক হওয়ার যেমন কোনও পাঠশালা নেই, পাঠক হওয়ারও পাঠশালা নেই। কুবেরের ভান্ডারের মতো কেবল অধিক বই সংগ্রহই লক্ষ্মীর ঝাঁপির মতো মধুর সাহিত্যবোধ তৈরি করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস-ভিত্তিক পড়াশোনাও প্রকৃত পাঠক হওয়ার পাঠশালা নয়।
সাবিত্রী রায়ের ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পে এক পাঠক এবং পত্রিকা সম্পাদক এক অনামী লেখকের অন্তঃপুরে গিয়ে দেখে আসেন, কী প্রবল যুদ্ধের বিনিময়ে লিখছেন সেই মহিলা লেখক। তাঁর কফিহাউস নেই, ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ বন্ধুবান্ধব নেই, পাঠক তৈরি করার সেকালীন প্ল্যাটফর্মও নেই, কিন্তু তাঁর এক জন পাঠক আছেন যিনি দুর্যোধনের অক্ষৌহিণী সেনা নয়, অর্জুনের পাশে একা শ্রীকৃষ্ণের মতো এসে দাঁড়ান শুধুই সহমর্মিতা দিয়ে। ঠিক যে ভাবে পথের পাঁচালী-র অপু এক দিন আবিষ্কার করে, তার এক জন পাঠক অন্তত আছে, যে ঠিকানা খুঁজে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। আজ অধিক জনসংযোগের তোড়ে লেখকের তরফে এই ম্যাজিক মোমেন্ট যেমন পাওয়া হয় না, তেমনই পাঠকও কি বিশ্বাস করেন না সহজলভ্যতায়— যাকে সহজে পাওয়া যায়, সহজে বোঝা যায়?
গগন হরকরার মনের মানুষ খোঁজার আকুতি মিলে গেছে কালকূটের কোথায় পাবো তারে-র আর্তিতে। লেখকের রসিক ও সহৃদয় পাঠক অনুসন্ধানের জন্য এই আকুতি কি অম্লান নয়? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী-তে বলেছিলেন, শিল্পীর শিল্প সৃষ্টির ইচ্ছা যেন অম্লশূলের বেদনার মতো অকস্মাৎ না হয়। পাঠকের মনে জায়গা করে নেওয়ার জন্য প্রকৃত লেখক আজন্ম প্রস্তুতি নেন, কিন্তু পাঠকেরও সে প্রস্তুতি চলে কি? বিক্ষিপ্ত ইচ্ছা তাঁকে ‘অম্লশূলের বেদনা’র মতো হঠাৎ বই কিনতে ও পাঠ করতে প্রলুব্ধ করে না তো? লেখক প্রস্তুত, কিন্তু পাঠকও কি?