জয়ী: গুজরাতে জয়ের সংবাদে উল্লসিত বিজেপি সমর্থকরা, দিল্লি, ৮ ডিসেম্বর। পিটিআই
মোট ১৮২ আসনের মধ্যে ১৫৬টি কোনও দল জিতে নিয়েছে শুনলে প্রথমেই মনে হয়, নির্বাচনটি হল কোথায়? ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ায়? না, এটা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের গুজরাত রাজ্যের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের ফল, যেখানে ঝড়ের মতো প্রায় ৮২ শতাংশ আসন উড়িয়ে নিয়ে গেল বিজেপি।
গুজরাত মোদীর রাজনীতির পাঠশালা। সেখানে ২০০২ সালের ঐতিহাসিক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পশ্চাৎপটে তিনি অর্জন করেছিলেন সেই অমোঘ উপাধি ‘হিন্দু-হৃদয়-সম্রাট’। তার পর দীর্ঘ বারো বছর ধরে তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর আসন থেকে হিন্দুর হৃদয়টি ইচ্ছেমতো ছাঁচে গড়বার শিল্পটি আয়ত্ত করেছেন। তবে এই বার এই রাজ্যে জয়ের রেকর্ড স্থাপনের জন্য মোদী যে পরিমাণ স্বেদ ঝরিয়েছেন, তা ‘ভক্ত’দেরও বিস্মিত করেছে। সামান্য কয়েক দিনের মধ্যে তিনি ৩১টি জনসভা, তিনটি বিশাল রোড-শো করেছেন। উপহার দিয়েছেন এয়ারবাস-টাটার মস্ত বিমান-নির্মাণ কারখানা, যা মহারাষ্ট্রে স্থাপনের জন্য জমির ব্যবস্থা পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে খুশি রেখেছেন তাঁর ২০০২ সালের বন্ধুদের। সেই দাঙ্গায় ধর্ষিতা এবং সন্তান-সহ পরিবারের সাত জনকে হারানো বিলকিস বানো মামলার এগারো জন দণ্ডিতকে মেয়াদের আগেই জেল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হল সরকারি তৎপরতায়। বিজেপি নেতারা তাদের অভ্যর্থনা করলেন পুষ্পমাল্যে।
মোদীর রাজনীতি কিন্তু জনতোষণভিত্তিক নয়। তা শুধু সোজা বলের ক্রিকেট নয়, তাতে আছে শেন ওয়ার্নের স্পিনও। এ বার সেই ‘স্পিন’-এর আরও প্রয়োজন ছিল কারণ ২০১৭ নির্বাচনে অস্বস্তিজনক ভাবে বিজেপির কাছাকাছি চলে এসেছিল কংগ্রেস। বিজেপি জিতেছিল ৯৯ আসনে এবং কংগ্রেস ৭৭টিতে। অন্তর্নিহিত কারণ, ধর্মের কল তেমন নড়ছিল না। কাজ হচ্ছিল না শুধু হিন্দুত্বের তাসে। রাজ্যের পটেল বা ‘পাটীদার’ শ্রেণি উচ্চবর্ণের, তাই নেই তাদের জন্য কোনও সংরক্ষণ। বিরক্ত হয়ে তাদের বাসভূমি সৌরাষ্ট্রে ও কর্মভূমি সুরাতে তারা চুটিয়ে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিল। ব্যাপারটি বুঝেই পটেল নেতৃত্বকে হাত করেন মোদীর সঙ্গীরা। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত যে দুঃস্থ উচ্চবর্ণের জন্য ১০ শতাংশ চাকরি আসবে সংরক্ষণের আওতায় (অর্থাৎ, ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের সীমারেখা বাতিল) মিটিয়ে দিল পটেলদের পুরনো ক্ষোভ।
কিন্তু তবুও মোদী পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। তখনই উদয় হল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি, গুজরাতের তৃতীয় দাবিদার। সমাধানের পথে এগোল মোদীর সমীকরণ। পরিষ্কার হল বিরোধী ভোট দু’ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা। মোদী তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় আপ-কে যেন ভুলেই গেলেন। যত তর্জনগর্জন সবই কংগ্রেসের প্রতি। তারা ‘পরিবারবাদী’, তারাই নাকি সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক বিদ্বেষের প্রধান কারিগর! যে সব জায়গায় তিনি এই বাক্যবর্ষণ করেছেন, সেখানে সপ্তাহাধিক কাল লেগেছিল মৃতদেহের মিছিল সরাতে!
যা-ই হোক, পশ্চিম ও মধ্য গুজরাতে কাজ হল ‘কেজরীওয়াল সাফাই’-তে। যেখানে যেখানে ২০১৭ সালে কংগ্রেস জিতেছিল কম ব্যবধানে সেখানেই এ বার সে নিশ্চিহ্ন হল। নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ হল, বিজেপির মতো একটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী দলের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় দল রুখে দাঁড়ালেও, অনেকে আলাদা আলাদা ভাবে লড়াইয়ের ময়দানে নামার অর্থ— বিজেপির জয় নিশ্চিত করা।
ও দিকে পার্বত্য রাজ্য হিমাচলপ্রদেশে ছিল না কোনও তৃতীয় পক্ষ। রাজ্যটির রীতিই হল প্রতি নির্বাচনে শাসক বদল। ক্ষমতাসীন থাকাকালীন বিজেপি হুমকি দিয়েছিল এ বার ‘রাজ’ বদল হতে না দিয়ে তারা বদলে দেবেন ‘রিওয়াজ’। কিন্তু শাসানি কাজে পরিণত হল না; কংগ্রেসের ৪০ আসনের জবাবে বিজেপিকে খাতা বন্ধ করতে হল ২৫-এ। ভোটশতাংশে তাদের প্রভেদ খুবই কম। নির্বাচন-উত্তর ভাষণে মোদী সজোরে বলেছেন, ‘আমাদের’ এবং ‘ওদের’ ভোট পার্থক্য ‘এক শতাংশেরও কম’।
কথাটি ইঙ্গিতপূর্ণ। ২০১৪ সালের পর যত ‘দলবদলু’ বিধায়ক বা সাংসদ আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁদের প্রায় সকলেরই গন্তব্য একই, বিজেপি। দিল্লির গবেষণা সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর)-এর গণনা অনুসারে গত আট বছরে অন্য দল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন ২১১ জন আইনপ্রণেতা। ভলভো বাস, ভিনরাজ্যের পর্যটক আবাসে দলে দলে বিধায়কের আগমন, রাজভবনে তাঁদের গভীর রাতের বৈঠক। এ সবই ‘মোদী যুগ’-এর গণতন্ত্রের পরিচিত প্রতীক। দু’বছর আগে ঠিক এই ভাবেই মধ্যপ্রদেশের ‘রাজপুত্র’ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। একই ভাবে পিছনের দরজা দিয়ে বিজেপি যোগ দেয় মহারাষ্ট্রের সরকারে। ফলে হিমাচলে নির্বাচনের পর মোদীর উক্তিটি হতে পারে অশনিসঙ্কেত।
তবে বিধায়ক (বা সাংসদ) কেনাবেচার ঐতিহ্যটি প্রাচীন, এবং ‘আয়ারাম গয়ারাম’ পরিহাসের উৎপত্তি সেই ষাটের দশকের হরিয়ানায়। দলছুটদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার যখন খুশি বরখাস্ত করানোর প্রবণতা নিবৃত্ত করতে দলত্যাগবিরোধী আইন প্রণীত হয় ১৯৮৫ সালে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ভারতের রাজ্যস্তরের শাসনযন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক পরিসরে বিদ্যুদ্গতিতে অনুপ্রবেশের জন্য মোদীর পরিচালনায় বিজেপি যে ছল, বল ও কৌশল অবলম্বন করে চলেছে, তা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
এই কৌশলের ভিত্তিটি প্রতিষ্ঠিত একটি পরিচিত সামাজিক অবক্ষয়ের উপর। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে রাজনীতি হয়ে উঠেছে এক ব্যবসা; এমন নেতা খুঁজে পাওয়া ভার যাঁর জীবনের কোনও না কোনও চোরাকুঠরিতে মিলবে না দুর্নীতি বা অন্যান্য দণ্ডনীয় অপরাধের প্রমাণ। যেখানে প্রমাণ নেই, সেখানে এমন কোনও পদস্খলনের সাবুদ মিলবেই না যে, কোনও জননেতাকে মানুষের চোখে অপদস্থ করতে যথেষ্ট। ঠিক সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে দু’টি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। দ্বিতীয়োক্তটির কাজ বিদেশে মুদ্রা পাচার আইন বলবৎ করা। আইনটি দানবিক। দণ্ডবিধির সাধারণ রীতি হল, অপরাধ প্রমাণ না-হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত নিরপরাধ, কারণ, অভিযোগকারীকেই অভিযুক্তের অপরাধ প্রমাণ করতে হবে। কথিত আছে, অভিযোগ প্রমাণের এই দায়িত্ব, বার্ডেন অব প্রুফ হল সব নিরপরাধ বন্দির কাছে ঈশ্বরপ্রেরিত দেবদূত। কিন্তু বিদেশে মুদ্রা পাচার আইনটির অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে সে নির্দোষ। নইলে অনির্দিষ্ট কাল তাকে পচতে হবে জেলে। এমন অমানবিক আইন চালু রাখলে তার যা অবধারিত পরিণতি তা-ই হচ্ছে। মোদীর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে এই আইন অপব্যবহৃত হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো। ২০০২ সালের এই আইন ৯৮ শতাংশ প্রয়োগ হয়েছে গত অাট বছরে।
আইনটি কি আধুনিক যুগের মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? আশ্চর্যের ব্যাপার, দেশের শীর্ষ আদালত সম্প্রতি বলেছে, কোনও সমস্যা নেই যদি ইডি-র মামলায় প্রমাণের দায়িত্ব সরকারের উপর না থাকে, অথবা যদি বিনা অভিযোগে শুধু সন্দেহের বশে ইডি গারদে পোরে অভিযুক্তকে। এই আইনে দু’শো জন আসামি-পিছু অপরাধ প্রমাণ হয়েছে মাত্র এক জনের। ইডির ভয় দেখিয়ে (এবং উৎকোচ ও সরকারি পদের লোভ দেখিয়ে) তথাকথিত বিরোধী দলগুলিকে মোদী পরিণত করেছেন ক্রীতদাসে। মোদী সরকারের সঙ্গে তাঁরা শিশুদের মতো চোর-পুলিশ খেলেন। অথচ বিলকিসের ধর্ষকরা হাসিমুখে জেল থেকে ছাড়া পেলেও তাঁদের মুখে সেলোটেপ আঁটা থাকে। যখন অকাট্য প্রমাণ হাতে আসে যে অশীতিপর পাদরি স্ট্যান স্বামীর সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্কও ছিল না মাওবাদীদের, অথচ সেই মিথ্যা অভিযোগেই তিনি অসুস্থ অবস্থায় তিন বছর জেলবন্দি থেকে কারাগারেই মৃত্যু বরণ করেন, তখন একটি শব্দ উচ্চারিত হয় না দিল্লি, কলকাতা, তিরুঅনন্তপুরম, চেন্নাই বা হায়দরাবাদ থেকে। এই নৈঃশব্দ্য আরও সন্দেহজনক, কারণ একটি আমেরিকান সাইবার তদন্ত সংস্থা নিশ্চিত যে, স্বামীর কম্পিউটারে তাঁর সম্পূর্ণ অজানতে প্রবেশ করানো হয়েছিল মাওবাদী সংস্থার চিঠিপত্র। মিশনারিদের উপর আক্রোশ প্রকাশের জন্য কে বা কারা এই সাইবার রাহাজানিটি ঘটিয়েছেন, তা প্রশ্ন করবার কোনও দায়িত্ব কি নেই তথাকথিত বিরোধী নেতাদের? অন্য দিকে, ভারতের অ-কৃষি অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ৭৯ লক্ষ ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের উপর। তাদের ৫০ শতাংশ গত তিন বছরে তালাবন্ধ হয়ে গেলেও তথাকথিত বিরোধীরা টুঁ শব্দটি করেন না, খোঁজ করেন না কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁদের ৬০ শতাংশ কর্মী। শুধু মাঝে-মাঝে খোঁজ নেন আমরা করের ভাগটা ঠিক সময়ে পাচ্ছি না কেন।
মোদী কি তবে অপরাজেয়? তার জবাব মনে হয় নিহিত রয়েছে লোকসভার তৃণমূল সদস্য মহুয়া মৈত্রের ভাষণের একটি লাইনে: “সওয়াল ইয়েহ নাহি হ্যায় বসতি কিসনে জ্বালাই, সওয়াল হ্যায় পাগল কো মাচিস কিসনে দি?”