শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। - ফাইল চিত্র।
নবান্নের সভাঘরে কোনও এক সরকারি অনুষ্ঠানের আগে বিশ্রম্ভালাপ হচ্ছিল। এক মন্ত্রী বললেন, ‘‘শোনো, ইচ্ছে সকলেরই আছে। আমরা পারিনি। কানন পেরেছে।’’
নেহাতই ঘনিষ্ঠ বৃত্তে রসিকতা করে বলা। যেমন অতি পরিচিতদের কাছে খানিকটা মুখ-আলগা দিয়ে থাকি আমরা। তার কোনও সুদূরপ্রসারী প্রভাব (বা প্রতিপত্তি) আছে বলে তখন মনে হয়নি। তখনও শোভন-বৈশাখী (পদবির দরকার পড়ে না। যথার্থই বলেছেন অডিও ভিস্যুয়ালের এক সহকর্মী। এখন কে চট্টোপাধ্যায়, কে বন্দ্যোপাধ্যায়— সে সব নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। বলেও না। এখন হিট জুটি— শোভন-বৈশাখী। যেমন উত্তম-সুচিত্রা। যেমন অমিতাভ-রেখা।) আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু এ ভাবে ভিডিয়োবাহিত হয়ে নিজেদের দৈনন্দিনতা নিয়ে বাঙালির ঘরে-ঘরে ঢুকে পড়েননি।
তাঁদের প্রেমের এমন নির্ঘোষও এর আগে দেখা বা শোনা যায়নি। ক্যামেরার সামনে এমন ইনহিবিশন-হীন প্রেমালাপ, তা-ও একেবারে রিয়েল লাইফে, বাঙালি এর আগে দেখেনি।
একটি ওয়েবসাইটের উদ্যোগে যা শুরু হয়েছিল নেহাতই নির্দোষ পুজোর ফ্যাশনের আবডালে, তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে চ্যানেলে-চ্যানেলে। প্রথম পর্যায়ে নৃত্যগীত ছিল। বৈশাখীর ‘মম চিত্তে’র সঙ্গে মুদ্রা-সমন্বিত নাচের তালে তালে গুণমুগ্ধ শোভনের ঈষৎ আবেশজড়িত অঙ্গদোলন। তা নিয়ে বিবিধ মিম-টিমও হয়েছে। সেই ভিডিয়ো থেকে আরও গুচ্ছ-গুচ্ছ ভিডিয়ো এবং মিম বানিয়ে ‘ভিউ’ বাড়িয়ে অনেকে ফাঁকতালে পয়সা পিটে নিয়ে চলে গিয়েছেন বলেই জনশ্রুতি।
কিন্তু ভিডিয়ো সেই একটি-দু’টিতেই থেমে থাকেনি। উল্টে ধেয়ে এসেছে বন্যার জলের মতো। যেখানে পর্যায়ক্রমে শোভন-বৈশাখী বহুতলের দোলনায় দুলতে দুলতে কখনও অন্ত্যাক্ষরী খেলেছেন। তার ফাঁকে বৈশাখী ‘আমার গান তো একটাই— আমার চোখে তো সকলেই শোভন’ বলে পাশে-বসা প্রেমিকের থুতনিতে ভালবাসার ঠোনা দিয়েছেন। শোভন কখনও মুকেশ হয়ে গেয়েছেন, ‘ম্যায় নে তেরে লিয়ে হি সাত রং কে সপ্নে চুনে’। কখনও দ্বৈতকণ্ঠে প্রেমালু যুগল গান ধরেছেন, ‘কে প্রথম কাছে এসেছি। কে প্রথম ভালবেসেছি।’
কখনও গোলপার্কের বাড়ির গোছানো বৈঠকখানায় হাতে-হাত ধরে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে নেচেছেন। কখনও বৈশাখী যখন সাজগোজ করছেন, তখন শোভন পরম যত্নে ঠিকঠাক করে দিচ্ছেন প্রেমিকার কানপাশা। কখনও দু’জনে ভিক্টোরিয়া চত্বরে গিয়ে হাজির হয়েছেন ঘোড়ায়-টানা ফিটন গাড়িতে। শোভনের পরনে কোঁচানো ধুতি আর পাঞ্জাবি। বৈশাখীর মাথায় জুঁইফুলের গোড়ে। সামনে আঁচল দিয়ে সাবেকি ভঙ্গিতে পরা শাড়ি। তিনি শোভনের দিকে অপলকে তাকিয়ে গেয়েছেন, ‘চুরা লিয়া হ্যায় তুম নে যো দিল কো।’ আর শোভন কখনও দম ধরে, কখনও দম মেরে এবং কখনও ছেড়ে ‘দম মারো দম’ গানে তার জবাব ফিরিয়ে দিয়েছেন, ‘হম সব কি পরওয়া করে কিঁউ! সব নে হমারা কিয়া কেয়া!’
সত্যিই তো! কেন পরোয়া করবেন?
কখনও যুগলকে ক্যামেরা ধরেছে প্রিন্সেপ ঘাটে। সেখানে দাঁড়িয়ে দু’জন খুনসুটি করেছেন। বৈশাখী গেয়েছেন। শোভন কখনও হাতে-হাতে তালি দিয়েছেন। কখনও আঙুলে-আঙুলে তুড়ি। মিষ্টি লেগেছে।
কখনও দু’জনে দোলনায় দুলেছেন। কখনও একে অপরের দিকে নিবিড় ভাবে তাকিয়েছেন। কখনও অপাঙ্গে। কখনও বিলোল কটাক্ষে। সেখানে পূর্বরাগ-অনুরাগ সব মেখেজুখে একাকার।
ভাল লেগেছে দেখতে। মিষ্টি লেগেছে। সত্যিই। দুগ্গাঠাকুরের দিব্যি।
শোভন-বৈশাখী যে একে অপরের গভীর প্রেমে এবং যৌথ যাপনে আছেন, তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। বৈশাখী নিজেই বলেছেন, নয়-নয় করে দীর্ঘ ১৩ বছরের সম্পর্ক তাঁদের (অর্থাৎ, তখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁর সুবাদে ঘনিষ্ঠদের কাছে শোভনের ‘কানন’ ডাকনামের চলন)।
পাশাপাশি বলেছেন, তাঁরা স্বাভাবিক প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই আচরণ করেন। তাঁরা যা কিছু করেন, তার সবকিছুর মধ্যেই রোমান্স আছে। রোমান্স ছাড়া শোভনকে তিনি কল্পনা করতে পারেন না। তাঁরা সম্পর্কটাকে লালন করেন। যাকে বৈশাখী বললেন ‘টুগেদারনেস’। চমৎকার বললেন। আরও বললেন, ‘‘আমরা দু’জনে বেস্ট ফ্রেন্ড।’’ বললেন, ‘‘আমাদের আসলে বিচ্ছেদ হওয়ার নয়।’’ বাঙালি আরও জানল, বৈশাখী শোভনকে প্রায় সবসময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান।
বৈশাখী বাঙালিকে জানালেন, শোভনের ধূমপান তাঁর অপছন্দ। পছন্দ শোভনের সারল্য। আর পছন্দ শোভনের সেই অমোঘ বাক্য, ‘‘আমি যাকে বুক দেখাই, তাকে কখনও পিঠ দেখাই না।’’ অর্থাৎ, এক বার হৃদয়ের আগল খুলে দিলে কখনও পিছু ফিরে পিঠটান দিই না।
কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক শোভন সহ-নাগরিকদের জানালেন, তাঁর অপছন্দ বৈশাখীর মোবাইল নিয়ে নিরন্তর ঘাঁটাঘাঁটি। আর পছন্দ ‘ডিগনিটি, সিনসিয়ারিটি’। সত্যি কথাগুলো সরাসরি এবং সহজ ভাবে বলতে পারার ক্ষমতা। সে উল্টো দিকের লোকটার ভাল লাগুক বা খারাপ।
শোভনের বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে। বৈশাখীও সম্প্রতি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেছেন। দু’জন বিবাহবিচ্ছিন্নতাকামী নরনারী স্বেচ্ছায় একসঙ্গে বসবাস করলে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। আইনেও এর কোনও বাধা নেই। কিন্তু একের পর এক যুগল ভিডিয়ো বাঙালির সামনে তাঁদের যৌথ জীবনের দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। আর আপামর বাঙালি জুলজুল করে তাকিয়ে দেখেছে। দেখেছে। গিলেছে। আর জেনেছে।
শোভনের কথা থেকে তারা জেনেছে, বৈশাখীর শখ হল গণেশের মূর্তি কেনা। সে মেলার মাঠ থেকে পাঁচ টাকার মাটির মূর্তি হোক বা মহার্ঘ ধাতুর কোনও গণেশমূর্তি। বৈশাখীর কাছ থেকে তারা জেনেছে, বৈশাখী কার জন্য পুজোর প্রথম উপহারটি কেনেন বা পুজোর সময় কী করেন। জেনেছে, তাঁর জন্য কিনে-আনা গাদা গাদা শার্ট দেখে শোভন কপট রাগ দেখান। কিন্তু বাইরে বেরনোর আগে বৈশাখীকেই তার মধ্যে থেকে একটা শার্ট বেছে দিতে হয়। জেনেছে, যুগলের বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা প্রায় পাকা। চূড়ান্ত দিন ক্ষণ নির্ভর করছে বৈশাখীর কন্যার সময়ের উপর।
কলকাতার প্রাক্তন মেয়র, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং প্রাক্তন বিধায়ক শোভন সরাসরি বলেছেন (দেখে এবং শুনে মনে হল, সেই স্বীকারোক্তিতে বিশেষ বিষাদের ছোঁয়া নেই), ‘‘আজ আমি রাজনীতির আঙিনা থেকে অনেক দূরে।’’ ফিটন গাড়ি থেকে নেমে ময়দানের সামনে দাঁড়িয়ে অস্ফূটে স্বগতোক্তি করেছেন, ‘‘এই সেই ব্রিগেড ময়দান।’’ বৈশাখী ঝপ করে তাঁকে বলেছেন, ‘‘রাজনীতির ব্রিগেড ভুলে গিয়ে সামনের সবুজ ময়দানটাকে দেখো!’’
রাজনীতিক শোভনকে চেনা বহু দিনের পরিচিতেরা অন্তরালে বা ঘনিষ্ঠমহলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। তাঁদের আক্ষেপ— সাতান্নতেই কার্যত শেষ হয়ে গেল শোভনের মতো আনখশির রাজনীতিকের রাজার নীতির জীবন। কিন্তু তাঁদের কে বোঝাবে, শোভনের কাছে এখন মেজাজটাই আসল রাজা।
জাতির জ্যাঠামশাইরা গেল-গেল রব তুলেছেন। শোভন-বৈশাখী নেচেছেন বলে জেঠুদের রাগ হয়েছে। তাঁরা ছ্যা-ছ্যা করেছেন। কিন্তু কেন রাগ? রোগা মানুষ নাচলে কি দারুণ হত? দু’জন বিবাহিত নারী-পুরুষ ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ নাচলে বাঙালি বিমোহিত হয়ে দেখত? বাঙালি রেগে গিয়েছে। সেই অক্ষম ক্রোধকে বৈধতা দিতে নানা ফিকির এবং কারণ খুঁজে বার করেছে।
শোভন-বৈশাখীর তাতে কিছু যায়-আসেনি।
রসক্ষ্যাপারা খিল্লি উড়িয়েছে। আমোদগেঁড়েরা রকে-চায়ের ঠেকে-অফিসে-কাছারিতে রসালো আলোচনা করেছে। যার মধ্যে কৌতূহল আছে। রঙ্গ আছে। রসিকতা আছে। আদিরসাত্মক এবং আপাত-অশ্লীল মন্তব্যও আছে।
কিন্তু সর্বোপরি আছে এক অসহায় ক্ষোভ আর অসূয়া— কই, আমরা তো এমনটা পারি না! আমরা বলতে পারি না, বেশ করেছি! প্রেম করেছি!
বাঙালি ক্যামেরার সামনে প্রেমের এমন সগর্ব ঘোষণা করতে পারে না। ভিক্টোরিয়ার উল্টো দিকে ময়দানের ফোয়ারার সামনে দাঁড়িয়ে প্রেমিকার সঙ্গে পছন্দের গানে গলা মেলাতে পারে না। ফিটন গাড়ি থেকে নেমে ফুচকা খেতে পারে না। পাঞ্জাবির সঙ্গে শাড়ির রং মিলিয়ে পরে টিনএজার সুলভ চপল প্রেমিক-প্রেমিকা হতে পারে না। বাঙালি এমন ভানহীন ভাবে ‘বেশ করেছি, প্রেম করেছি’ বলতে চায়। পারে না।
পাশাপাশি বাঙালি এটাও বুঝতে পারে না যে, আসলে শোভন-বৈশাখী কৌশলী এক চোপাটে জাতির কৌতূহলটাকেই মেরে দিলেন।
এ আসলে ‘প্রেম করেছি’ নয়। প্রেম তো করেছিই। এ হল আরও একধাপ এগিয়ে ‘বেশ করেছি’!
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কোনও নিষিদ্ধ বস্তুকে টেবিলে ফেলে-ছড়িয়ে রাখলে তার সম্পর্কে মানুষের উৎসাহ আপনা থেকেই কমে যায়। মনে হয়, এ তো খুবই মামুলি। এটা নিয়ে আর কী-ই বা আলোচনা করব। কী-ই বা গসিপ করব। শোভন-বৈশাখী প্রবল বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেটাই করেছেন। তাঁদের নিয়ে যাবতীয় গসিপ, যাবতীয় কৌতূহলের মুখে নুড়ো জ্বেলে সকলের সামনে দ্যাখ-দ্যাখ করে প্রেম করছেন। আয়, কত দেখবি! কত বলবি! কত জ্বলবি! কত ফুলবি!
এই ভিডিয়োর বজ্রনির্ঘোষ নিছক ‘প্রেম করেছি’ নয়, এটা আসলে ‘বেশ করেছি’! ঠিকই। বেশই করেছেন। চুরিচামারি তো করেননি। প্রেমই তো করেছেন। গলা ফাটিয়ে বলবেন না কেন? ‘ভাইরাল’ ভিডিয়োয় শোভন-বৈশাখী নিরুচ্চারে বলেছেন, তোরা আমাদের নিয়ে আলোচনা করিস তো? আয়, আমাদের দেখিয়ে-দেখিয়ে উল্টে তোদের ‘বোর’ করে দেব!
লেখার শেষে এসে কয়েক বছর আগে বলা সেই মন্ত্রীর কথাটা আবার মনে পড়ছে— ‘‘ইচ্ছে সকলেরই আছে। আমরা পারিনি। কানন পেরেছে।’’ তখন মনে হয়েছিল, নিছকই রসিকতা। আলস্যজনিত অনায়াস বিশ্রম্ভালাপ। খেজুর। একছটাকও সিরিয়াসনেস নেই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তার মধ্যে কোথাও সরু হয়ে একটুখানি দুঃখও লুকিয়েছিল কি? কে জানে! হতেও পারে।