আত্মজন: গুয়াহাটিতে হরিজনদের সঙ্গে আলোচনায় মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী
সব চিন্তাশীল মানুষের মধ্যেই যেমন বৌদ্ধিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, তেমনই জাতিবর্ণব্যবস্থা ও অস্পৃশ্যতা নিয়ে মহাত্মা গাঁধীও সব সময় এক রকম করে ভাবেননি। তাঁর মতাদর্শে সময়ের সঙ্গে অনেক রকম বিবর্তন ঘটেছে। শ্রমের সমমর্যাদায় বিশ্বাসী গাঁধীজি দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকাকালীন নিজে কল্মষ পরিষ্কার করতেন। পরবর্তী কালে তিনি তাঁর স্ত্রী কস্তুরবা গাঁধীকে ও নিজের সন্তানদের অতিথিদের শয়নকক্ষে ব্যবহার্য মূত্রদানি পরিষ্কার করতে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এই বিশ্বাসের গোড়ায় ছিল তাঁর বর্ণব্যবস্থার প্রতি আস্থা। তিনি মনে করতেন, যে হেতু বর্ণব্যবস্থা-ভিত্তিক শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে গ্রামজীবনের নানা সমস্যার সমাধান হয়, তাই এটি এক উপযোগী সামাজিক পরিকাঠামো।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে গাঁধী জাতিবর্ণব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন যে, সর্বজনীন সৌভ্রাত্রবোধ, শান্তি ও জনহিতৈষার উপর নির্ভরশীল এই ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, কারণ তা জন্মসূত্রেই কর্ম বিভাজন করে সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। তিনি এও মনে করেন যে, হিন্দু উচ্চবর্ণের দ্বারা লালিত ব্রাহ্মণ্যবাদী থাকবিন্যস্ত জাতপাতভিত্তিক সামাজ ও অস্পৃশ্যতার সঙ্গে হিন্দুধর্মের কোনও যোগ নেই। বরং, সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন যদি আদর্শ বর্ণব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে পুনঃসংস্কার করা হয়, তবে বিভিন্ন জাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ থাকবে না।
হিন্দু চতুর্বর্ণব্যবস্থার বাইরে অবস্থিত মানুষ যাঁদের অন্ত্যজ ও ভাঙ্গি বলা হত, গাঁধী চেয়েছিলেন তাঁরা যেন বর্ণহিন্দুব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। চতুর্বর্ণব্যবস্থাই যে জাতিবর্ণ বিদ্বেষ ও সামাজিক অসাম্যের মূল কারণ, তা অনুধাবন না করতে পেরে গাঁধী মনে করতেন অস্পৃশ্যতা হিন্দুধর্মের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সবর্ণ হিন্দুরা তাঁদের চিরাচরিত শুচি ও বিশুদ্ধতা বিষয়ক কুসংস্কার থেকে নিজেদের মুক্ত করে আচারসর্বস্ব ধর্ম পালন থেকে বেরিয়ে এলেই এর সমাধান সম্ভব, এমনটাই গাঁধী মনে করতেন। তিনি চেয়েছিলেন, উচ্চবর্ণের মানুষরাই অস্পৃশ্যদের অবস্থার সামাজিক রূপান্তর ঘটান তাঁদের কৃতকর্মের জন্য আত্মসংশোধনের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত করে এঁদের ‘হরিজন’ বা ঈশ্বরের সন্তান জ্ঞান করে।
জাতপাতের অসাম্য ও বর্ণহিন্দুদের দলিতদের প্রতি নিপীড়নের ভুক্তভোগী বি আর আম্বেডকর অস্পৃশ্যদের নাগরিক অধিকার অর্জন ও জনসমাগমস্থল পুনরুদ্ধারের অঙ্গ হিসাবে মন্দিরে প্রবশের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন। অস্পৃশ্যরা হিন্দুধর্মের অন্তর্গত, তাই তাঁদের মন্দিরে প্রবেশ ধর্মজাত অধিকার এমন ধারণা থেকেই গাঁধী এই আন্দোলনকে সমর্থন জানান। নামকরণের মাধ্যমে গাঁধীকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অস্পৃশ্যদের জনসাধারণের জন্য নির্মিত রাস্তা ও জলাধার ব্যবহার করার সমানাধিকারের দাবি নিয়ে ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে আম্বেডকর মহারাষ্ট্রে ‘মাহাদ সত্যাগ্রহ’-এর কর্মসূচি গ্রহণ করেন। কিছু দলিত বলপ্রয়োগ করে পুণের পার্বতী মন্দিরে ঢুকেছেন, এমন খবর পেয়ে অবশ্য গাঁধী এই ঘটনাকে তিরস্কার করেন।
গাঁধী ও আম্বেডকরের মতাদর্শের পার্থক্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় ১৯৩১ সালের দ্বিতীয় রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে। এক ধরনের জাত্যভিমান ফলিয়েই, নিজের রাজনৈতিক এবং নৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করে গাঁধী বলেন যে, তিনি স্বয়ং অস্পৃশ্যদের প্রতিনিধি। অন্য দিকে, অস্পৃশ্যদের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তনের জন্য আম্বেডকর আইনি পদক্ষেপের ও রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রয়োজনের কথা জানান। কনফারেন্সের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড দলিতদের জন্য স্বতন্ত্র ও সংরক্ষিত নির্বাচকমণ্ডলী গঠনের অনুমতি দিলে গাঁধীজি আমরণ অনশনের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সচিব মহাদেব দেশাই আকস্মিক ভাবেই তাঁকে বলতে শুনে ফেলেন যে, অস্পৃশ্যরা স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর অনুমোদন পেলে তাঁরা মুসলমান দুষ্কৃতীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হিন্দুদের হত্যা করবেন।
অনশনরত গাঁধীর জীবনসংশয়ের আশঙ্কা দেখা দিলে আম্বেডকর পুণা চুক্তির মাধ্যমে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর শর্তে পিছু হটেন। তবে, জাতিবর্ণব্যবস্থা এবং অস্পৃশ্যতাকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখার এই প্রবণতার জন্য গাঁধীর প্রতি আম্বেডকর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। গাঁধীকে বলেন, “ইউ সে আই হ্যাভ গট আ হোমল্যান্ড, বাট স্টিল আই রিপিট দ্যাট আই অ্যাম উইদাউট ইট। হাও ক্যান আই কল দিস ল্যান্ড মাই ওন হোমল্যান্ড হোয়্যারইন উই আ ট্রিটেড ওয়ার্স দ্যান ক্যাটস অ্যান্ড ডগস, হোয়্যারইন উই ক্যানট গেট ওয়াটার টু ড্রিঙ্ক?” স্পষ্ট বলেন, “কোনও আত্মমর্যাদাপূর্ণ মানুষ যাঁদের ‘আনটাচেবল’ ভাবা হয় এই দেশে, ভারতবাসী বলে গর্বিত হতে পারেন না।”
১৯৩৩-এর মে মাসে গাঁধী দ্বিতীয় বার অনশনে বসেন। তিনি নেহরুকে লেখেন যে, অস্পৃশ্যতার মতো অভিশাপ আর হয় না, তাই তিনি খুব নিরাশ হবেন যদি হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সেটা নাকচ না করেন। তিনি এও জানান যে, যদি সনাতন ধর্ম অস্পৃশ্যতাকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে তা হলে সে ধর্মের কোনও প্রয়োজন তাঁর নেই। আম্বেডকরের সংগ্রামী জঙ্গিবাদের বিকল্প হিসাবে গাঁধী ১৯৩৪-এ ‘হরিজন সেবক সংঘ’ গঠন করেন নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য স্কুলের ট্যাঙ্ক, জলাধার, রাস্তা ব্যবহারের অধিকার প্রভৃতি কল্যাণমুখী কর্মসূচি সার্থক করার জন্য। আম্বেডকরের স্পষ্ট মত যে, অস্পৃশ্যতা যদি ক্ষতিকারক হয়, তার মূলে আছে জাতিবর্ণব্যবস্থার নৃশংসতা। অস্পৃশ্যতার অনুমোদন যে হেতু হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বিদ্যমান, তাই হিন্দুধর্মের বিলয় না ঘটলে অস্পৃশ্যতাকে সমূলে উৎপাটন অসম্ভব।
শেষ জীবনে গাঁধীও বুঝতে পারেন যে, উচ্চবর্ণের আত্মসংশোধনের মাধ্যমে অস্পৃশ্যতা রদ অসম্ভব, এবং একমাত্র সাংবিধানিক ভাবেই তার বিলোপ সম্ভব। জাতপ্রথাহীন সামাজিক ন্যায় স্থাপনের জন্য তিনি শুধু আন্তঃবর্ণ বিবাহতেই সম্মতি দেননি, উচ্চবর্ণের মহিলাদের অস্পৃশ্য পুরুষদের প্রতিলোম বিবাহে সম্মতি জানান। এই জাতিবর্ণভেদের প্রতি শিথিলতা রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীদের চোখে গাঁধীকে মারাত্মক ভীতির কারণ করে তোলে।
আজ আবারও ভারতের বুকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জাগরণ ঘটেছে। যদি নাথুরাম গডসের হাতে ১৯৪৮ সালে গাঁধীর পার্থিব মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে উত্তর-সত্যের যুগে গাঁধীর প্রবর্তিত ‘সত্য’-এর মৃত্যু ঘটেই চলেছে প্রতিনিয়ত। তাঁর ‘সর্বোদয়’-এর চিন্তা সমষ্টিগত পারস্পরিকতার কথা বলে, প্রান্তিক শেষ মানুষটির জন্য মানবিকতার কথা বলে। অথচ দলিত ও জনজাতির মানুষদের প্রতি ঘৃণা থেকে উদ্ভূত জনরোষে গণনিধন আজ আকছারই ঘটছে। গাঁধীর আদর্শের মেকি অনুসরণ করে কিছু সরকারি প্রচার অভিযান তাঁর নামে চালানো হচ্ছে। গাঁধীর স্বপ্নের ‘গ্রাম স্বরাজ’-এর নামকরণে যে প্রচার অভিযান তার স্লোগান ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। এই রাষ্ট্রীয় বিকাশের জোয়ারে প্লাবিত হয়েই হাজার হাজার দলিত ও জনজাতির মানুষ জল, জঙ্গল ও জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতি দিন।
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর কলুষমুক্ত সমাজ ও নির্মল ভারত গড়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’ কর্মসূচি গ্রহণ করে। স্বাধীনতার এত পরেও কোটি কোটি মানুষের বাড়িতে শৌচাগার না থাকায় তাঁরা খোলা জায়গায় মলমূত্র পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই কর্মসূচিতে যে সব এলাকায় শৌচাগার নেই, যাঁদের বাড়িতে শৌচাগার নেই, সেখানে শৌচাগার করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। জলবিহীন এই শৌচাগারগুলোর পরিষ্কার করার দায় কিন্তু বর্তায় সেই দলিত সাফাই কর্মচারীদের উপর। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ৪২৭ জন দলিত মারা গিয়েছেন অত্যাধুনিক ও নিরাপদ সরঞ্জাম ছাড়াই হস্তসাধিত সাফাই কাজ করতে গিয়ে। সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক দ্বারা সংসদে জমা দেওয়া নথি অনুযায়ী সরকারি গাফিলতিতে এই মৃত্যুগুলোর জন্য কেউ শাস্তি পায়নি, যদিও ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী হস্তসাধিত সাফাই কর্মসূচি গ্রহণ দণ্ডনীয় অপরাধ। এই সব প্রাণ মূল্যহীন বলেই বোধ হয় নাগরিক সমাজে সে সব নিয়ে বিশেষ হেলদোল দেখা যায়নি।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্যাপন কালে রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক ঔদাসীন্য ঝেড়ে ফেলে প্রত্যেক নাগরিকের উচিত গাঁধীবাদী স্বনির্ভরতার উপর আস্থা রেখে নাগরিক অধিকার বুঝে নেওয়া। তাঁর ‘স্বরাজ’-এর আদর্শ প্রায় এক শতাব্দী আগে বহুমাত্রিক প্রবৃত্তিকে প্রণোদিত করে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করে গিয়েছে। তাই গাঁধীর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্মের জিগিরকে প্রতিহত করাই আমাদের নাগরিক কর্তব্য। কোভিড মহামাির এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই সময় দাঁড়িয়ে যথেচ্ছ পুঁজিবাদী জীবনযাত্রার বিপরীতে গাঁধীর পরিমিত জীবনযাপনের আদর্শও ভাবায় বইকি।
ইতিহাস বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়