জীবনে তিনটে ‘এফ’ নেই শ্যামল মাহাতোর। বাইপাসের ধারের একটি বার-রেস্তরাঁর ওয়েটার তিনি। ‘ফ্যামিলি, ফ্রেন্ড, ফেস্টিভ্যাল’ (পরিবার, বন্ধু, উৎসব), এই তিনটি নাকি ওয়েটারদের ভুলে থাকতে হয়। সরকারি ভাবে পানশালা বন্ধ থাকে মাত্র তিন দিন— গান্ধীজয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস ও প্রজাতন্ত্র দিবসে। বছরের বাকি দিনগুলিতে চলে খদ্দেরের ভিড়, শ্যামলরা জুগিয়ে যান তার ইন্ধন— পানীয় আর মুখরোচক খাবার। সকাল এগারোটা থেকে রাত বারোটা অবধি, তেরো ঘণ্টার ডিউটি বাঁধা। মাইনে ছাড়া উপরি পাওনা খাবার, যা মালিকই দেন। প্রাতরাশ মুড়ি, কখনও কখনও সঙ্গে জোটে খদ্দেরদের বিনামূল্যে দেওয়া চানাচুর। দুপুর ও রাতের ভাত-তরকারিও মেলে। লকডাউনের আগে সপ্তাহের নানা দিনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাছ-ডিম-মাংস মিলত। এখন ছ’দিনই ডাল-ভাতের সঙ্গে জুটছে আলু চোখা। শ্যামল আট বছর আগে কলকাতায় এসেছিলেন বাঁকুড়া থেকে এক আত্মীয়ের ভরসায়। রেস্তরাঁয় ঢুকেছিলেন চার হাজার টাকা মাইনেতে। আট বছরে তা হয়েছে ছ’হাজার টাকা। প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো সুবিধে কম কর্মীই পান, লকডাউনের পর বোনাসও বন্ধ। ভরসা খদ্দেরদের দেওয়া ‘টিপস’।
বার-রেস্তরাঁর কর্মীদের উপার্জনের বড় অংশই টিপস থেকে আসে। টিপসের বাঁটোয়ারা হয় পয়েন্ট সিস্টেমে, বলছিলে আর এক রেস্তরাঁ কর্মী বিশ্বজিৎ কর্মকার। দিনের শেষে টিপসের টাকা এক জায়গায় করে বণ্টন করে নেওয়া হয়, কুক, হেল্পার ও ম্যানেজারের ভাগও থাকে। যে বেশি সিনিয়র তাঁর ভাগে বেশি যায়। বিশ্বজিতের রেস্তরাঁ একটু উচ্চমানের, ইংরেজিতে কথা বলা খদ্দের আসেন। অন্তত দু’জন সিনিয়র ওয়েটার ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। ক্যানিং-এর টেন-পাশ বিশ্বজিৎ তাঁদের কাছে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিখছেন, এই শিক্ষা কাজে লাগবে, এই আশায়। হোটেল লাইনে ট্রেনিং মানে অন্যকে দেখে শেখা। রাঁধুনির হেল্পার হয়ে ছোট হোটেলে ঢুকে শেষে বড় হোটেলের কুক হয়েছেন, এমন উদাহরণ অসংখ্য।
বিশ্বজিৎ তিন মাস অন্তর বাড়ি যান দিন সাতেকের জন্য, বেতন কাটা যায় সেই ক’দিনের। বাড়ি গিয়ে প্রথমে দু’দিন টানা ঘুমোন। দেখা করার সময় নেই বলে আত্মীয়দের এড়িয়ে চলেন। বছর দশেক দিদির মুখ দেখেননি, বললেন বিশ্বজিৎ। টাকা জমাচ্ছেন গ্রামে ফিরে ব্যবসা খোলার আশায়। খদ্দেরের দুর্ব্যবহার, কুক-এর মুখঝামটা, রেস্তরাঁ মালিকের সামন্তপ্রভুসুলভ আচরণ, সবই সহ্য করতে হয়। মালিকের এক কথায় চলে যাবে চাকরি। পাশের বন্ধু ওয়েটারটিও শুকনো সান্ত্বনা দিতে পারেন বড় জোর, প্রতিবাদ করতে পারেন না। এই অবমাননার জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চান বিশ্বজিৎ।
মেহবুব আলম চার দশকের বামপন্থী ট্রেড-ইউনিয়ন কর্মী, কাজ করেন ধর্মতলা চত্বরের একটি হোটেলে। মেহেবুব জানালেন ধর্মতলা, পার্ক স্ট্রিটের কিছু পুরনো বার-রেস্তরাঁয় শ্রমিক সংগঠন এখনও রয়েছে। মর্জিমতো ছাঁটাই করে দেওয়া, অতি দীর্ঘ ডিউটি, এ সব থেকে সেখানে কর্মীরা কিছুটা সুরক্ষিত। এমনকি অস্থায়ী কর্মীরাও পুরনো শ্রম আইন অনুযায়ী সবেতন ছুটির মতো কিছু কিছু সুবিধে পান। নতুন শ্রম কোড বিল আসার পর সে সব সুযোগ থাকবে কি না, তা নিয়ে ধাঁধায় রয়েছেন মেহবুব। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ কেবল রেস্তরাঁ কর্মীদেরই বিপন্ন করে এমন নয়। বেতন কাটা যাওয়া, বা চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা অসুস্থ অবস্থাতেই কাজে আসতে বাধ্য হন, যা সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর অন্যতম কারণ। ফ্লু নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমেরিকার গবেষকরা এই তথ্য পান। রন্ধন ও পরিবেশনকারী কর্মীদের খাদ্যের গুণমান নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ, পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা কত জরুরি, কোভিড তা মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু অস্থায়ী কর্মীর শিক্ষায় বিনিয়োগ করবে কে? কর্মীর বিপন্নতা শেষ বিচারে উপভোক্তাকেও বিপন্ন করে।
কলকাতার হোটেল-রেস্তরাঁর কর্মীদের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়, সময়ের সঙ্গে শ্রমিক-সুরক্ষা কমেছে। ধর্মতলা এলাকার এক পাইস হোটেলের কর্মী অমিত মাইতি জানালেন, তাঁদের স্থায়ী চাকরি, তাই পিএফ, ইএসআই, গ্র্যাচুইটি আছে। সাড়ে আট ঘণ্টার বাঁধা ডিউটি, ওভারটাইমের আলাদা মজুরি, পুজোর বোনাস, চার বেলা খাবার, সবই পান তাঁরা। পান বছরে ছাব্বিশ দিন ছুটিও। পাইস হোটেলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে মনে হয়, শ্রমিকের নেই-রাজ্যে কিছু পাইস হোটেল যেন মরূদ্যান।
নতুন শ্রমিক কোড চুক্তিতে অস্থায়ী কর্মী নেওয়ার ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকেছে। আগের কন্ট্র্যাক্ট লেবার আইনের মতো, এই কোডেও অস্থায়ী কর্মীদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য বিধানের কথা আছে। সে সব সুযোগ-সুবিধে কলকাতার বার-রেস্তরাঁর কর্মীরা কতটা পাবেন, তা নিয়ে অবশ্য ট্রেড ইউনিয়ন ও কর্মীরা সন্দিহান। শ্রমিক আদালতে ছুটোছুটি করতে করতেই তাঁদের বেলা ফুরিয়ে যায়। তাই আলো-ঝলমল পানশালা, রেস্তরাঁয় সুখাদ্য-সহযোগে হাসি-আড্ডার আড়ালে চাক বেঁধে থাকে ধূসর ক্লান্তি, দিন কাটানোর গ্লানি। শ্যামলের কথায়, “আমরা সুখে নেই, দুঃখে নেই, টিকে আছি খালি।”