অমৃত কালের নবপর্যায় কিন্তু ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে
Law and Order

ঘুরে দাঁড়ানোর দায়

নাগরিকের স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণ আজ শুরু হয়নি, স্বাধীন ভারতের আদিপর্ব থেকে শাসনতন্ত্রের ভিতরেই নিহিত ছিল অধিকার হরণের উৎস। যেমন, সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২৪ ০৮:৩২
Share:

এই সে দিনও চোদ্দো বছর ঠিকঠাক জেল খাটলে সচরাচর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ফুরোত। চোদ্দো বছর কম সময় নয়। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র হল মহাকালের মতো, তার চোখের পলকে কল্পান্তর ঘটে যায়, মহাবলী যন্ত্রীরা অবলীলাক্রমে সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধান অতিক্রম করে শিকার ধরতে পারেন। অতএব ২০১০ সালে স্বাধীনচেতা লেখক ও সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায় এবং শিক্ষক শেখ শওকত হোসেন কাশ্মীর বিষয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, তার জন্য ২০২৪ সালে— ‘অচ্ছে দিন’ ওরফে ‘অম্রুত কাল’-এর তৃতীয় পর্বের এই ভোরবেলাতেই— দিল্লির কেন্দ্রীয় প্রশাসকরা তাঁদের বিরুদ্ধে আইনবহির্ভূত কার্যকলাপ নিবারণী আইন (ইউএপিএ) প্রয়োগের নতুন উদ্যোগে নেমে পড়েছেন। দিল্লির উপরাজ্যপাল মামলা করার অনুমতি দিয়েছিলেন আগেই, এ-বার সেই মামলায় ইউএপিএ সংযোগের অনুমতি দিলেন। জল কত দূর গড়ায়, তা ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু এই ঘটনা নতুন করে সামনে এনে দিল একটি পুরনো ও গুরুতর প্রশ্ন: গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র নামে পরিচিত একটি দেশে ইউএপিএ-র মতো ভয়ঙ্কর আইন কেন থাকবে?

Advertisement

এ-প্রশ্নের উত্তর কেবল এই একটি আইনের চৌহদ্দিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার উৎস সন্ধানে ফিরে যাওয়া দরকার দীর্ঘ ইতিহাসের পথ ধরে। সেই কাজে আমাদের সাহায্য করেন কানাডার সাইমন ফ্রেজ়ার ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক জন হ্যারিস। ভারতীয় সংবিধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে স্পিকিং টাইগার বুকস-এর নতুন গ্রন্থমালার অঙ্গ হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে প্রবীণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর একটি ছোট্ট বই, লিবার্টি: দি ইন্ডিয়ান স্টোরি। নাগরিকের স্বাধীনতা সংক্রান্ত কিছু মৌলিক প্রশ্নে উজ্জ্বল আলো ফেলেছেন তিনি।

নাগরিকের স্বাধীনতার উপর রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণ আজ শুরু হয়নি, স্বাধীন ভারতের আদিপর্ব থেকে শাসনতন্ত্রের ভিতরেই নিহিত ছিল অধিকার হরণের উৎস। যেমন, সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ। মৌলিক অধিকারের তালিকায় থাকা এই অনুচ্ছেদে নাগরিককে গ্রেফতার বা আটক করার ক্ষেত্রে সুরক্ষার নানা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া আছে। কিন্তু নাগরিক অধিকারের এই রক্ষাকবচটিই কার্যত হয়ে দাঁড়িয়েছে লখিন্দরের লৌহবাসরের রন্ধ্র। তার কারণ, এখানেই বলা হয়েছে, ‘প্রিভেনটিভ ডিটেনশন’ অর্থাৎ অপরাধ নিবারণের ব্যবস্থা সম্বলিত কোনও আইনে কাউকে ধরা হলে রক্ষাকবচের সাধারণ নিয়মাবলি খাটবে না। অ-সাধারণ নিয়মাবলির জটিলতায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই, মোদ্দা কথা এই যে, তখন বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন অভিযুক্তকে দীর্ঘ দিন আটক রাখা যাবে। বহু দেশেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে এই ক্ষমতা আজ আর নেই। ভারতে আছে। এবং, ইদানীং আরও বেড়েছে।

Advertisement

সংবিধান রচনার সময় গণপরিষদে এই বিষয়ে বিস্তর তর্ক হয়েছিল। বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেডকর-সহ অনেক সদস্যের মত ছিল, ‘বিশেষ’ বা ‘অনিবার্য’ কারণে কোনও নাগরিককে বেশি দিন আটক রাখতে হলে বিচারবিভাগের বিশেষ অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু সংবিধান চূড়ান্ত করার দিনকয়েক আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভিমত অনুসারে একটি সংশোধনী এনে সাব্যস্ত হল যে, রক্ষাকবচ কেমন হবে, অভিযুক্তকে কত দিন কী ভাবে আটক রাখা যাবে, তা স্থির করবে সংশ্লিষ্ট আইন। তার অর্থ, এ বিষয়ে বিচারবিভাগের নজরদারির ক্ষমতা খর্ব করা হল। জন হ্যারিস লিখেছেন, “ঠিক কী কারণে আম্বেডকর এই সংশোধনীর প্রতিবাদ করলেন না, তা নিয়ে ধাঁধা থেকেই গিয়েছে।”

অতঃপর রন্ধ্রপথে কালনাগিনীর প্রবেশ। সংবিধান বলবৎ হওয়ার এক মাস পরেই পাশ হল প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট বা নিবর্তনমূলক আটক আইন। কয়েক বার সম্প্রসারণের পরে ১৯৬৯ সালে পিডি অ্যাক্টের কার্যকাল শেষ হয়েছিল। কিন্তু ‘জনজীবনে শৃঙ্খলা’ রক্ষার নামে, দেশের ‘ঐক্য ও সংহতি’ অটুট রাখার অজুহাতে নাগরিককে গ্রেফতার বা আটক করা এবং দীর্ঘ দিন আটকে রাখার জন্য বিশেষ আইন বানানো চলতেই থাকল: মিসা (১৯৭১), এনএসএ (১৯৮১), টাডা (১৯৮৫), পোটা (২০০২), ইউএপিএ (সংশোধিত, ২০০৪)। ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের অবস্থান থেকে প্রত্যেকটি আইনের বিরুদ্ধে এবং তাদের অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে বহু প্রতিবাদ হয়েছে, বিচারবিভাগ বারংবার রাষ্ট্রের দমন নীতিকে প্রতিহত করতে হস্তক্ষেপ করেছে, কখনও দ্রুত, কখনও বিলম্বিত বা অতিবিলম্বিত। কিন্তু অর্ধ শতক ধরে একের পর এক আইনে সরকারের যথেচ্ছাচারের ক্ষমতা ক্রমশ বেড়েছে, ভারতীয় বিচার-দর্শনের বনিয়াদি আদর্শকে উল্টে দিয়ে এই আইনগুলি কার্যত অভিযুক্তকে জানিয়েছে: নির্দোষ প্রমাণিত না-হওয়া অবধি তুমি দোষী, জীবনযাপনের স্বাধীনতার অধিকার শিকেয় তুলে রেখে তোমাকে রাষ্ট্র আটকে রাখতেই পারে।

প্রতিবাদী, বিরোধী বা স্বাধীনচেতা নাগরিকের স্বাভাবিক অধিকার হরণের এবং তাকে যখন খুশি যেমন খুশি দমনপীড়নের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প যখন প্রচলিত আইনে আটকায়, তখন জারি হয় বিশেষ আইন। প্রচলিত আইনে যা বেআইনি ছিল, সেটাই অতঃপর আইনি হয়ে ওঠে। উপনিবেশকে কব্জায় রাখতে ব্রিটিশ প্রভুরা এই অপকৌশলটি কব্জি ডুবিয়ে কাজে লাগিয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতের প্রভুরা কনুই অবধি ডুবিয়ে দিয়েছেন। সেই পথ ধরেই আজ আমরা এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যেখানে রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই নাগরিককে দীর্ঘ সময় গরাদের ও-পারে রেখে দিতে পারে। জাতীয় নিরাপত্তা বা জনজীবনে শৃঙ্খলার যে যুক্তি দেখিয়ে এই অপকর্ম করা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অজুহাতমাত্র। সরকারি তথ্যেই তার সুস্পষ্ট সঙ্কেত আছে। যেমন, ২০১৩ থেকে ২০১৬, এই তিন বছরে নিষ্পত্তি-হওয়া ইউএপিএ সংশ্লিষ্ট মামলাগুলির ৭৫% ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা মুক্তি পেয়েছেন, অনেকেই দীর্ঘ কারাবাসের পরে। স্পষ্টতই, নিরাপত্তা বা শৃঙ্খলা নয়, শাসকের স্বার্থই প্রকৃত লক্ষ্য।

এ-ব্যাধি নতুন নয়। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে সব ধরনের রাজনৈতিক জমানায় সরকার দমন-নিপীড়নের হাতিয়ার এই আইনগুলিকে কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু গত দশ বছরের জমানাটির সঙ্গে তার পূর্বসূরিদের কোনও তুলনাই চলে না। ‘লিবার্টি ইন দ্য টাইম অব হিন্দুত্ব’ নামাঙ্কিত শেষ অধ্যায়ের শুরুতেই জন হ্যারিসের দ্বিধাহীন সিদ্ধান্ত: “ভারতে, ২০১৪ থেকে হিন্দুত্বের দাবিগুলিকে পূরণের লক্ষ্যে চালিত বিজেপি-শাসিত সরকারের জমানায় ‘বৈধ-করে-তোলা যথেচ্ছাচার’ অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে।” এবং, “... ‘নিরাপত্তা’র বাস্তব বা কল্পিত যুক্তি দেখিয়ে সমস্ত রকমের অসহিষ্ণু বা সরাসরি স্বৈরাচারী পদক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করা হচ্ছে, যা একেবারে মৌলিক স্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে।” ভাব-সম্প্রসারণের প্রয়োজন নেই।

চাকা ঘোরানোর উপায় কী? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, সংবিধান তথা আইনের যে রন্ধ্র দিয়ে শাসকের দমন নীতি প্রবেশ করতে পারে, সর্বাগ্রে সেটি বন্ধ করা চাই। যেমন, নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা ছাড়া কাউকে (ইউএপিএ-র মতো আইনে) অপরাধ নিবারণের যুক্তিতে আটক করে রাখা যাবে না— এই রক্ষাকবচটি থাকা জরুরি। বস্তুত, ১৯৭৮ সালে সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনীতেই তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ভূতপূর্ব আমলাদের একটি গোষ্ঠী সেই অনুসারে নির্দেশ জারি করার জন্য কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। তার পর? তার আর পর নেই।

থাকবেই বা কেন? রাষ্ট্রশক্তির অধীশ্বররা কোন দুঃখে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মর্যাদা দেবেন? তাঁরা তো নাগরিককে ভয় দেখিয়ে বশ মানাতে এবং বশে রাখতেই বদ্ধপরিকর। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে যথার্থ মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষায় বিরোধীদেরও বিস্তর ঘাটতি আছে। জাতীয় নিরাপত্তা বা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতার অজুহাতকে তাঁরাও অনেক সময়েই যুক্তি বলে ভুল করেন কিংবা জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে মেনে নেন। তার ফলে তাঁদের প্রতিস্পর্ধা বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদে বা ইতস্তত মামলার উদ্যোগেই সীমিত থাকে, অন্যায় ও অনৈতিক আইনের বিরুদ্ধে মৌলিক আদর্শগত অবস্থান নিয়ে সংগঠিত প্রতিরোধ তাঁরা গড়ে তুলতে পারেন না।

এই ইতিহাস বদলাতে না পারলে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ‘চমকপ্রদ’ ফলাফল যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি করেছে, তা অচিরেই বিলীন হবে। পরমাত্মার তৃতীয় সংস্করণের লীলা শুরু হতে না হতেই রাষ্ট্রীয় দাপটের নবপর্যায় চালু হয়ে গিয়েছে। চোদ্দো বছরের পুরনো উপলক্ষ খুঁড়ে নতুন আইনি অভিযানের উদ্যোগ তার একটি নজিরমাত্র। কেবল এই উদ্যোগকে প্রতিহত করতেই নয়, এই উপলক্ষটিকে কাজে লাগিয়ে একটি আদ্যোপান্ত অগণতান্ত্রিক এবং অনৈতিক আইন বাতিল করার মৌলিক দাবিতে, এবং তার সূত্র ধরে শাসনতন্ত্রের মজ্জায় মজ্জায় নিহিত গণতন্ত্র-বিরোধী নীতি ও আচরণের বিরুদ্ধে, বিরোধী শিবিরের অবিলম্বে সংগঠিত ভাবে সরব এবং সক্রিয় হওয়া জরুরি। শুরু থেকেই ঘুরে না দাঁড়ালে ভারতীয় গণতন্ত্রের নবলব্ধ জীবনীশক্তি ফুরিয়ে যেতে দেরি হবে না। যা চলছে, তা-ই চলবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement