JU Student Death

হোক তোলপাড়!

আবাসিক ছাত্রের অকালমৃত্যুর পর তোলপাড় চারদিক। র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে যাদবপুরে মৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম। হাহাকার, রোষ, প্রতিবাদ, প্রতিকারের দাবি উঠছে মুহুর্মুহু। উঠুক! এই তোলপাড় হওয়া উচিত।

Advertisement

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২৩ ০৭:৫৮
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শুনলাম সে দিন রাতে লাইট্‌স অফ বেল পড়ার আগে নিরঞ্জনানন্দ ভবন থেকে আমাকে ক্লাস সেভেনের দু’জন ‘দেখতে’ আসবে। শুনেই পিলে চমকে গেল! অসুস্থতাজনিত কারণে অন্যদের চেয়ে কিছু দিন পরে আবাসিক ইস্কুলে যোগ দিয়েছি। ক্লাস ফাইভের পড়ুয়া। অদ্বৈতানন্দ ভবনের ২.৩ রুমের বাসিন্দা। তত দিনে অন্য নতুনদের জরিপ করা হয়ে গিয়েছে। সে দিন আমার পালা। কারণ, আমি নবাগত। এ বার আমার ‘মাপিত’ হওয়ার পর্ব।

Advertisement

তবে দেখলাম, ভয়ের কিছু হল না। মুশকো চেহারার দুই সিনিয়র এল বটে। কিন্তু তারা কোনও হুজ্জুতি করল না। স্রেফ দেখে-টেখেই চলে গেল। তাদের কাছ থেকে কোনও রকম ভয়-ভীতির অনুষঙ্গও পেলাম না।

সেটাও এক ধরনের ‘ইন্ট্রো’ই ছিল বটে। কিন্তু ওই উপক্রমণিকাটুকুই। তার বেশি সে সব হস্টেলে কিছু এগোতে পারত না। পাজি ছেলে কি কিছু ছিল না? আলবাত ছিল! তারা কি কোনও অসৈরণ করত না? অবশ্যই করত! কিন্তু সেটা একটা সীমা পর্যন্ত। তার বেশি যাওয়ার দুঃসাহস কারও ছিল না। স্পর্ধাও নয়। প্রাতিষ্ঠানিক অনুশাসন এবং শৃঙ্খলারক্ষায় এতটাই কঠোর ছিলেন সেখানকার মাস্টারমশাই, ওয়ার্ডেন এবং সাধুরা। হতে পারে, বেসরকারি স্কুল বলে সেখানকার আটবাঁধ অনেক কড়া ছিল। হতে পারে, সেখানে যে ছাত্রেরা থাকত, তারা বয়সে নেহাতই কাঁচা হওয়ায় তাদের তুলনায় সহজে আয়ত্তে রাখা যেত। কিন্তু কাঁচা বয়স বলেই তাদের আগুপিছু না-ভেবে অনেক কিছু করে ফেলার সম্ভাবনাও থাকত।

Advertisement

তা হলে করতাম না কেন?

ভয়ে! কড়া শাস্তির ভয়ে। আড়ংধোলাইয়ের ভয়ে। টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) খাওয়ার ভয়ে। বাড়ি থেকে বাবা-মা’কে ডেকে পাঠিয়ে জানানোর ভয়ে। সেই ভয়ের পিছনে যেমন এক দিকে ছিল সামগ্রিক ভাবে মাস্টারমশাইদের প্রতাপ, তেমনই অন্য দিকে ছিল তাঁদের অবিমিশ্র স্নেহ।

সেই শিক্ষক এবং সাধুরা যখন আমাদের সঙ্গে ফুটবল পেটাতে বা ভলিবল কোর্টে নামতেন, তখন তাঁরা স্রেফ প্রতিপক্ষ বা সহ-খেলোয়াড়। সতীর্থ। সন্তোষদা (সাহা) ওয়ার্ডেন বলে কোনও দিন গোল ছেড়ে দিইনি। তুষারদা (মহারাজ) প্রেয়ার হল-এ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসার কারণে যতই চড়চাপাটি মারুন, নেটে খেলার সময় তিনি যাতে জুতিয়ে স্ম্যাশ করতে পারেন, সেই জন্য নিখুঁত ‘লিফ্‌ট’ করেছি। তাঁদের ভয় পেয়েছি যেমন, তেমন সম্ভ্রমও করেছি। অভিমান থেকেছে। কিন্তু তাতে শ্রদ্ধায় ঘাটতি পড়েনি। ভাগ্যিস পড়েনি!

বিভিন্ন ছাত্রাবাসে যে সমস্ত গৃহী শিক্ষক এক একটি ব্লকে ওয়ার্ডেনের দায়িত্বে থাকতেন, তাঁদের সবচেয়ে পাজি ছেলেটি যেমন ভয় পেত, তেমনই সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রটি সকলের চেয়ে বেশি ভরসা করত। তাঁরা যেমন দুর্বলকে রক্ষা করতেন তেমনই শাস্তি দিতেন দুর্জনদের। হস্টেলের ঘরে সেল্‌ফ স্টাডির সময় বারান্দায় ওয়ার্ডেনদের পায়চারি করতে দেখলে পেট গুড়গুড় করত। বেচাল কিছু করা তো দূরস্থান! আবাসিক মাস্টারমশাইদের তো বটেই, যাঁরা ইস্কুলের চৌহদ্দির বাইরের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন এবং প্রতি দিন ক্লাস নিতে আসতেন, আমরা তাঁদেরও যমের চেয়ে সামান্য বেশি ভয় পেতাম। ভাগ্যিস পেতাম!

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের অকালমৃত্যুর পর তোলপাড় চারদিক। র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম। তাই হাহাকার, রোষ, সম্মিলিত প্রতিবাদ, প্রতিকারের দাবি উঠছে মুহুর্মুহু। উঠুক! এই তোলপাড় হওয়া উচিত। হোক তোলপাড়!

কিন্তু পাশাপাশিই যে কথাটা বার বার মনে হচ্ছে, এত দিন ধরে যাদবপুরে এই র‌্যাগিংয়ের সংস্কৃতি চলে আসছে, কেউ তো কিছু বলেননি! এই কুৎসিত কাজটা বন্ধ করার দায় কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছিল না? বিভিন্ন সময়ে যাঁরা উপাচার্যের পদে থেকেছেন, তাঁদের ছিল না? অধ্যাপকদের ছিল না? হস্টেল সুপারদের ছিল না? ডিন অফ স্টুডেন্টস-এর ছিল না? রেজিস্ট্রারের ছিল না? নির্বাচিত ছাত্র সংসদগুলির ছিল না? নবাগত ছাত্রদের রক্ষা করার দায় এঁদের কারও ছিল না? ধর্ষকামী সিনিয়রদের ভৎর্সনা করার, দাবড়ে রাখার, দমিয়ে দেওয়ার, শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের তরফে কেউ নিলেন না? এতগুলো বছর চলে গেল!

যে সমস্ত ছাত্র বা শিক্ষক সংগঠন এখন ব্যানার নিয়ে, পোস্টার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করছেন, পরস্পরের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলছেন (সেই স্লোগানেও শুনছি ‘চামড়া গুটিয়ে নেওয়ার’ হুমকি), তাঁদের কোনও দায় ছিল না? এখন যে সমস্ত ছাত্র সংগঠন ‘খুনিদের শাস্তি চাই’ বলে কলকাতা শহরের প্রায় সমস্ত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং রাজপথে দাপিয়ে মিছিল-মিটিং করছেন, এত দিন তাঁরা জানতেন না যাদবপুরে কী হয়? হয়ে আসছে বছরের পর বছর? এক আঠারো ছুঁই-ছুঁই কিশোরের মৃত্যু তাঁদের সকলের বিবেককে জাগ্রত করে দিল? সকলে রিপ ভ্যান উইঙ্কলের ঘুম ভেঙে উঠে লাফ দিয়ে ময়দানে নেমে পড়লেন?

এমন তো নয় যে, প্রতিষ্ঠানেরও কেউ এগুলো সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না! কিন্তু তাঁদের কারও হিম্মত হয়নি এগিয়ে গিয়ে এই ঘৃণ্য এবং মধ্যযুগীয় বর্বরোচিত প্রথাটা বন্ধ করার? উপাচার্য, অধ্যাপকেরা যে যাঁর মতো এলেন, ক্লাস নিলেন, পরীক্ষা নিলেন, প্রশ্নপত্র তৈরি করলেন, উত্তরপত্র দেখে নম্বর দিলেন বা দিলেন না আর বাড়ি চলে গেলেন? শিক্ষক তো এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অভিভাবকও বটে। এঁদের ভরসাতেই তো দূরদূরান্ত থেকে পড়ুয়ারা আসেন বড় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে। এঁদের ভরসাতেই তো পড়ুয়াদের বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের পাঠান বাড়ি থেকে এত এত দূরে। এই সেই অভিভাবকের দায়িত্ববোধ? এই সেই অভিভাবকের কর্তব্যবোধ? এই তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব?

না কি তাঁরা এসব ‘ঝুটঝামেলা’য় জড়াতে চান না? ছাত্রদের হস্টেলে যা হচ্ছে হোক। তাঁদের সঙ্গে তো আর ছাত্রাবাসের কোনও সম্পর্ক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করাতে পারলেই হল। এখন যে কিছু অধ্যাপক চ্যাঁ-ভ্যাঁ করছেন, বলছেন লজ্জায় মাথা হেঁটে হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা কোথায় ছিলেন এত দিন? মাথা পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন যাতে হেঁট না-হয়? এটা কি বিশ্বাস্য যে, তাঁরা কেউই কিছু জানতেন না? অনেকে বলছেন, হস্টেলে যে এতটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের র‌্যাগিং হয়, তা ততটা বাইরে জানাজানি হয় না।

তাই নাকি?

না কি মফস্‌সল শহর থেকে আগত ছাত্রটি শহুরে মাস্টারমশাইদের কাছে ঘেঁষতে পারার মতো ‘কুল’ হতে পারেন না? না কি তাঁদের সঙ্গে সেই পড়ুয়ার সম্পর্কের কোনও সেতু গড়ে ওঠে না? না কি তাঁরা তাঁদের পছন্দের স্মার্ট, শহুরে পড়ুয়াদের সঙ্গে অনেক বেশি স্বাভাবিক এবং সাবলীল? তাঁরা কি কখনও ভেবেছেন, পড়াশোনা তো আছে। কিন্তু দূর মফস্‌সল শহর থেকে আসা ছেলেটা ঠিকঠাক আছে তো?

কী করছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্টস? প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পড়ুয়াদের যোগাযোগ বজায় রাখাটাই তো তাঁর কাজ। সেই কারণেই তাঁর পদটি তৈরি হয়েছে। তিনিই তো পড়ুয়াদের হদিস জানবেন। খোঁজ রাখবেন। সেই কারণেই তো তিনি পারিশ্রমিক পান। ঘটনার দিন রাতে তাঁকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। সে তো এক রকম হল। কিন্তু এত দিনই বা তিনি কোথায় ছিলেন?

নতুন পড়ুয়ার অকালমৃত্যুর পরে যাদবপুরের বিভিন্ন প্রাক্তনীর থেকে যা শুনছি, তাতে তো এই জিনিস নিছক এক সপ্তাহ আগে শুরু হয়েছিল বলে মনে হয় না। ওই ঘটনার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সায়ন সেনগুপ্ত ফেসবুকে যে পোস্টটি করেছেন, শিউরে ওঠার মতো!

সায়ন নবাগত পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনাটিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। মনে হয়, ভুল কিছু বলেননি। সায়ন লিখেছেন, ‘‘প্রায় সিঁটিয়ে বসে আছি। দুঃখ, যন্ত্রণা, আতঙ্ক আর গ্লানি একসাথে অনুভব করছি। তার কারণ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষে সদ্য ভর্তি-হওয়া পড়ুয়া যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ছাত্রাবাসের তিনতলা থেকে ‘পতন’-এর ফলে মারা গিয়েছে। মিডিয়া এই ঘটনাকে ‘রহস্যমৃত্যু’ আখ্যা দিয়েছে। কেউ কেউ একে ‘আত্মহনন’ বা ‘সুইসাইড’ বলেছেন। আমি বলব এটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা।’’

অকালমৃত ছাত্রটির মতোই সায়নেরও বাড়ি নদিয়া জেলায়। যাদবপুরের হস্টেলে র‌্যাগিংয়ের যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তা শুধু পড়লেই গা গুলিয়ে ওঠে। ভিতরে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। সহ্য করা তো অনেক দূরের কথা!

‘‘প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় ষান্মাসিকে ইন পার্সন ক্লাস শুরু হওয়ার পর প্রায় দেড় মাস ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে আমি যাদবপুরের হস্টেল পাই। ও (মৃত পড়ুয়া) ঠিক যে ব্লকটিতে ছিল, সেই ব্লকেই। ৯ এপ্রিল, ২০২২-এ আমি ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ সেরে লটবহর নিয়ে ছাত্রাবাসে উঠি। আমি যে ঘরটি পেয়েছিলাম (যেটি সুপার বা অন্য কোনও আধিকারিক নন, ঠিক করে দিয়েছিল হস্টেলের মেস কমিটি), সেখানে ঢোকার পর ক্রমে জনা কুড়ি ছাত্র একে একে আসে, শিস দিয়ে উঁকি মারে এবং জিজ্ঞাসা করে, ‘নতুন?’, ‘আজ?’ কিংবা ‘তোর হস্টেলের বাবা কে?’”

“‘হস্টেলের বাবা’ শব্দবন্ধটি আমার কাছে নতুন ছিল। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, ছাত্রাবাসের বেশির ভাগ ছাত্রই আসে মেস কমিটির বিভিন্ন সিনিয়রের সুপারিশে। এই সিনিয়রটিই হলেন উক্ত নতুন ছাত্রটির ‘হস্টেলের বাবা’। এখন খুব অল্প সংখ্যক যে সকল ছাত্রের সিনিয়রদের সুপারিশ ছাড়াই স্থান হয়, আমি তার মধ্যে এক জন ছিলাম। ফলে, আমার কোনও হস্টেল-পিতা ছিল না। এর পর খাওয়াদাওয়া মিটলে, আমার রুমমেট তথা এক বছরের সিনিয়র এক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দাদার ওপর নির্দেশ আসে আমাকে ‘ইন্ট্রো’ সম্পর্কে বুঝিয়ে দিতে।

“‘ইন্ট্রো’ সে যা বোঝায়, সেই অনুযায়ী, প্রতি দিন রাত ১১টা বা ১২টার পর অত্যন্ত স্বল্পবসনে বিল্ডিংয়ের একটি একটি করে দরজা নক্ করতে হবে আমায়। তার পর সেই ঘরের সিনিয়রেরা দরজা খুললে সাবধান পজিশনে দাঁড়িয়ে একটি ফর্ম্যাট মুখস্থ বলতে হবে। সেটি শুরু হবে আমার নাম, পিতার নাম, মাতার নাম দিয়ে। তার পর জন্মদিবস। তার পর ‘আনুমানিক প্রতিষ্ঠাদিবস’ (আমার জন্মের সময়ের ন’মাস দশ দিন আগের দিনটি হল এই দিনটি; আশা করি সবাই ইঙ্গিতটি বুঝতে পারছেন)। তার পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর মাধ্যমিকের গোটা সিভি। এই ফর্ম্যাটটি শেষ হবে শারীরিক বর্ণনায়।

“গোটা বক্তব্যে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলে হয় ওঠবোস, নয় খিলের আঘাত সহ্য করতে হবে হাঁটুর পিছনে। এই ‘ইন্ট্রো’টি চলবে রাত আড়াইটে অবধি। ‘ইন্ট্রো’ কত দিন দিতে হবে? হস্টেলের জনৈক সিনিয়রের কথায়, যত দিন না আমার পুরুষাঙ্গের দৈর্ঘ্যটি পর্যন্ত সমস্ত আবাসিক ছাত্রের মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত। এ ছাড়া সপ্তাহে এক দিন সব ঘরের সব সিনিয়রের জলের বোতলে জল ভরে দিতে হবে। চুলে থাকবে মিলিটারি ছাঁট। সন্ধ্যে ৬টার মধ্যে হস্টেলে ঢুকে যেতে হবে। এবং ক্লাসের সমস্ত ‘মামণির’ গল্প তাদের বলতে হবে।”

“পর দিন সন্ধ্যেবেলা আমি হস্টেল ছাড়ি এই বুঝে যে, এ সব আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না। বাবার আর্থিক সঙ্গতি বিশেষ না থাকলেও যে করে হোক, যত কষ্টেই হোক, একটি মেস/পিজি খুঁজতে হবে আমায়। কসবায় একটি পিজিতে এখন থাকি আমি।”

সায়নের বর্ণিত দ্বিতীয় ঘটনা—

“১৩ই জানুয়ারি, ২০২৩। সেম ব্রেক চলছে। ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে পাই, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ হচ্ছে গান্ধীভবনের ভিতরে। প্রবেশ নিয়ে কড়াকড়ি ছিল না। তাই ঢুকি অনুষ্ঠান দেখতে। সঙ্গে দু’চার জন সহপাঠী এবং জুনিয়রও ছিল। গান, নাচ, হুল্লোড় ভালই চলছিল। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হয়, এ বার ‘ইন্ট্রো’ হবে। সেই ‘ইন্ট্রো’য় জনা পনেরো ছাত্রকে মঞ্চে তোলা হয়। তার পর একটি লম্বা বেলুন এবং তার পাশে বাঁধা দুটি গোল বেলুন (প্রতীকী পুরুষাঙ্গ) তাদের দিয়ে বলা হয় তলপেটের নীচে ধরে থাকতে। তার পর একটি গান চালিয়ে কুৎসিত নাচতে বাধ্য করা হয় তাদের। তার পর আগে যে ফর্ম্যাটটি বললাম, সেই ফর্ম্যাটে ‘ইন্ট্রো’ দিতে হয় তাদের।”

এমন সমস্ত ঘটনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে অধুনা ক্রন্দনরত শিক্ষক বা অশিক্ষক কর্মচারীরা জানতেন না? কোনও দিন শোনেননি? তাঁরা ইউজিসি-র গাইডলাইন জানতেন না যে, প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের সিনিয়রদের সঙ্গে একই ছাত্রাবাসে রাখা যাবে না? ক্যাম্পাসে সিসিটিভি ক্যামেরা রাখতে হবে? তাঁরা জানতেন না, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে পড়ুয়াদের অ্যান্টি র‌্যাগিং ফর্ম ভর্তি করতে হবে— এ নিয়েও একটা সময়ে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ হয়েছিল? জানতেন না যে, পরিচয়পত্র দেখিয়ে পড়ুয়াদের কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে হবে, তা নিয়েও একসময়ে আন্দোলন হয়েছিল?

শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একটা সময়ে এই ধরনের ভয়াবহ র‌্যাগিং হত। কিন্তু সেখানেও এখন আর র‌্যাগিং হয় না। কেন হয় না? কারণ, সেখানে ইউজিসি-র গাইডলাইন মেনে নতুন পড়ুয়াদের সিনিয়রদের সঙ্গে একই হস্টেলে রাখা হয় না। কারণ, সেখানে কারও বিরুদ্ধে র‌্যাগিং করার অভিযোগ প্রমাণিত হলেই তাকে সটান বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কলকাতার আরও কিছু কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসেও যে র‌্যাগিং হয় না, তা নয়। কিন্তু তা কখনও এমন পর্যায়ে গিয়েছে বলে শুনিনি। কখনও শুনিনি, র‌্যাগিংয়ের মতো একটি ধর্ষকামী সুখকে ‘ঐতিহ্য’ বলে বছরের পর বছর চালানো হচ্ছে। এবং যে ‘ঐতিহ্য’ সম্পর্কে আগাপাশতলা অবহিত থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠান সেটিকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনছে না। চোখ বুজে থাকছে। সাধে প্রাক্তন ছাত্র সায়ন লেখেননি, ‘‘গ্রাম, মফস্‌সল বা শহরতলি থেকে এই পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের, যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, তাদের এই পরিস্থিতিতে দুটি রাস্তা খোলা থাকে। এক, আত্মরক্ষার্থে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করা। যা অনেকের দ্বারাই সম্ভব হয় না। আর দুই, আত্মহত্যা। ঠিক এই কারণেই আমি বা আরও অনেকে ওই পড়ুয়ার চলে যাওয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা বলতে চাই।’’

সায়নের মতোই বিভিন্ন প্রাক্তনী এখন ফেসবুকে পোস্ট করছেন তাঁদের বিবিধ অভিজ্ঞতার কথা। সে সব পড়লে, শুনলে মাথা ঝিমঝিম করে। অবসাদগ্রস্তের মতো লাগে। পাশাপাশিই মনে হয়, তাঁরা কি সেই বিভীষিকার পর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ নথিভুক্ত করেছিলেন? আর অবধারিত ভাবে মনে হয়— এত দিন ধরে প্রতিষ্ঠান কিছু করল না!

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানছি, যাদবপুরের ঘটনাটির পর একাধিক প্রাক্তনী এখন এমন আত্মগ্লানিতে ভুগছেন যে, অভিজিৎ চক্রবর্তী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে চেয়েছিলেন, যখন শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিলেন, তখন কেন তাঁকে ঘেরাও করে, আন্দোলন করে যাদবপুরকে ‘মুক্তাঞ্চল’ বানাতে চেয়েছিলেন!

তখন ‘কলরব’ হয়েছিল। অভিজিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডেকেছিলেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ ডাকা অনভিপ্রেত। কিন্তু পুলিশ ডাকতেই বা হবে কেন? সেই ‘মুক্তাঞ্চল’ তৈরি করার সাফল্যের মধ্যে দিয়েই কি এই বিশৃঙ্খল মানসিকতার বৈধতা রচিত হয়ে গিয়েছিল আরও বেশি বেশি করে? এই সত্য আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করলে চলে যেতে হবে? যে কথা অভিজিৎ আনন্দবাজার অনলাইনে নিজে লিখেছেন? সে জন্যই কি বাকি অধ্যাপক, শিক্ষক, উপাচার্যদের এতটা ‘চলছে চলুক’ বা ‘মুক্তাঞ্চল থাকছে থাকুক’ ভাব? সে কি এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি বলে?

ভিন্‌রাজ্যের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক প্রাক্তন সহকর্মী বলছিলেন, ‘‘আমি যেখানে পড়াই, সেখানে এমন কোনও ঘটনা ঘটলে এত ক্ষণে তো অধ্যাপকেরা জেলে!’’

অপসারিত উপাচার্য অভিজিৎ বলেছেন, ‘‘শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। পড়ুয়াদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকতে হবে। বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। কঠোর প্রশাসক প্রয়োজন। যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, রাজ্যপাল, পুলিশ কমিশনার— সকলে সাহায্য করবেন। তা হলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’’

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল ভাগ্যিস ছোটবেলার হস্টেলজীবন ওই কড়া অনুশাসন আর শৃঙ্খলায় কেটেছিল! ভাগ্যিস কোনও ‘মুক্তাঞ্চল’ বানাতে দেওয়া হয়নি। ভাগ্যিস প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলারক্ষায় কঠোর ছিলেন মাস্টারমশাই, ওয়ার্ডেন এবং সন্ন্যাসীরা। সবচেয়ে পাজি ছেলেটি তাঁদের যেমন ভয় পেত, তেমনই সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রটি সকলের চেয়ে বেশি ভরসা করত। তাঁরা এক হাতে দুর্বলকে রক্ষা করতেন। অন্য হাতে শাস্তি দিতেন দুর্জনদের। প্রতাপ আর স্নেহের একটা মিলমিশ ছিল। তাঁদের দায় ছিল। দায়িত্ববোধ ছিল। শিক্ষাদানের পাশাপাশি অভিভাবকত্ব ছিল। ভাগ্যিস!

যাদবপুর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি তোলপাড় হওয়ার কারণ আছে। হোক তোলপাড়!

(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement