যন্ত্রের কারিকুরিই পুজোগুলিকে পুরস্কার এনে দিচ্ছে। ফাইল চিত্র ।
কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলের একটি পুজো এবার যে বিষয়টি থিম হিসেবে তুলে ধরেছে, এই লেখার শিরোনাম তার থেকে ধার করা। তবে সেখানে দুর্গাপুজোর কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে। মোদ্দা কথাটা হল, যন্ত্রের কাছে মানুষ যে ভাবে আত্মসমর্পণ করছে, তাতে হাসি-কান্না, মায়া-মমতা, সুখ-দুঃখের মতো মানবিক অনুভূতিগুলি দিনকে দিন পিছু হটছে। মানুষ বড় নির্মম হয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রের মতো।
যাঁরা এখন পুজো করেন, তাঁরা অনেকেই বিষয়টি হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। কিন্তু তাঁদের পিছিয়ে আসার রাস্তা নেই। যন্ত্রের কারিকুরিই পুজোগুলিকে পুরস্কার এনে দিচ্ছে। ভাবনা নয়। মস্তিষ্ক আর যন্ত্রকে শাসন করে না, যন্ত্রই যেন শাসন করছে মস্তিষ্ককে। তাই পুরস্কার পেলেও পুজোর উদ্যোক্তাদের প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই স্বতঃস্ফূর্ত নয়।
আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে অন্তত ২০ বছর কলকাতার পুজোর তত্ত্বতালাশ করেছি। অনেক বিবর্তন চোখের সামনে দেখেছি। ভালমন্দ মিলিয়ে। তবে নিঃসন্দেহে ভালর পাল্লাটাই ভারী। খারাপের মধ্যে পুজোর নামে এলাকার মানুষকে এক পক্ষকাল গৃহবন্দি করে রাখা, দেদার বিদ্যুৎ খরচ করে বায়ু দূষণ বাড়ানো, ‘ডিজে’ বাজিয়ে শব্দদূষণ ঘটিয়ে বিসর্জনের শোভাযাত্রা আর পুজোর দিনে দিনে অতিমাত্রায় যান্ত্রিক হয়ে যাওয়াটা। অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়েছে, যাঁরা কোনওদিন পুজোর মধ্যে থাকেন না, তিলে তিলে কী ভাবে একটা মন্ডপ তৈরি হয়, প্রতিমা তৈরি হয় তার খোঁজ রাখেন না, পুজোর জন্য যাঁরা সর্বস্ব বাজি রাখেন তাঁদের খবর নেন না, সর্বোপরি এই শিল্পের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই, পুজোয় তাঁদের গুরুত্বই ক্রমশ বাড়ছে।
আর ততই নিজের রিপোর্টিংয়ের দিনগুলি ততই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছি। যে সব উদ্যোক্তা নিজের স্ত্রী-র গয়না বন্ধক দিয়ে, নিজের জমি বিক্রি করে, কিংবা পুজোর টাকা যোগাড় করতে বেশি বেতনের টানে পান্ডববর্জিত স্থানে স্বেচ্ছায় বদলি নিয়েছেন, তাঁদের মুখগুলো ভেসে উঠছে। পুজোর রাতে (তখন পুজো অবশ্য চারদিনের ছিল) মন্ডপে যখন মানুষের ঢল নামত, ওই মানুষগুলোর মুখে দেখতাম পরিতৃপ্তির হাসি। মনে হত, আমিও ওঁদের একজন। কারণ, তখন লেখার জন্য পুজোর ছ’মাস আগে থেকে ঘোরা শুরু হত পুজো কমিটির দরজায় দরজায়, শিল্পীর ডেরায়, সহশিল্পীর গ্রামের আটপৌরে স্টুডিতেও।
দক্ষিণ দিনাজপুরের মুখোশশিল্পীর, মেদিনীপুরের (তখন একটাই জেলা ছিল) সবংয়ের মাদুরশিল্পী, পিংলার পটচিত্রশিল্পী, হাওড়ার পার্বতীপুরের চুলশিল্পী (পাট থেকে প্রতিমার চুল তৈরি করেন ওঁরা), পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের শোলাশিল্পী, বর্ধমানের কেতুগ্রাম ও আদি সপ্তগ্রামের কাঠের কারিগর, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্পীদের নাম-ঠিকানা মুখস্থ থাকত। ওঁরা আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন!
ঝুলনের প্যান্ডেল থেকে থিমের বিবর্তন আমার নিজের চোখে দেখা। ‘থিম’ শব্দটা আনন্দবাজার পত্রিকারই সৃষ্টি। সস্তায় পুষ্টিকর একটা কিছু। এক বা একাধিক শিল্পী একটা ভাবনার ভিত্তিতে মন্ডপ তৈরি করবেন, মন্ডপের সঙ্গে সাজুয্য রেখে প্রতিমা, আলোকসজ্জা এমনকি, আবহসঙ্গীত তৈরি করবেন— এটাই থিম। এর টানে কত যে নতুন নতুন শিল্পী পুজোর সঙ্গে যুক্ত হলেন, তার পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। থিমপুজোর আলোকসজ্জার জন্য চন্দননগর নির্ভরতা কমে দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা ও হাওড়ায় নতুন এক ধরনের কারিগর তৈরি হলেন।
এই শতকের গোড়ায় বেহালার সখেরবাজারের একটি পুজো থেকেই সম্ভবত থিমের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তৈরি হয়েছিল ‘থিম সং’। এখনকার এক নামী শিল্পী তাতে কন্ঠ দিয়েছিলেন। গত বেশ কয়েক বছরে দেখেছি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী থিম সং লিখছেন। কলকাতা ছেড়ে দিন, মুম্বইয়ের সুরকার, শিল্পীরা সেই গান গাইছেন। আমাদের ছোটোবেলায় পুজোর গানের অ্যালবাম বেরোত। বাংলা আধুনিক গানের সেই স্বর্ণযুগে যে সব গান তৈরি হয়েছে, তার জনপ্রিয়তা এখনও অমলিন। থিম সং পুজোর গানের জায়গা হয়তো নিতে পারেনি, কিন্তু এখনকার শিল্পী-সুরকারদের একটা পুনর্বাসনের জায়গা অবশ্যই করে দিয়েছে। কিন্তু এই থিম সংয়ের মধ্যে সুর ও কথার বৈচিত্র্য এখন আর পেরে উঠছে না যন্ত্রের ঝনঝনানির সঙ্গে। এখানেও এগিয়ে সেই যন্ত্রই। তার ঢক্কানিনাদে ভক্তি-আনন্দ অনেক ক্ষেত্রেই কিছুটা কোণঠাসা।
আমার মতো পুরনো ও অপেক্ষাকৃত নবীন প্রজন্মের অনেকেরই দেখেছি পুজো থেকে মন উঠে গিয়েছে। ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বলছে, এর পিছনে রয়েছে মূলত তিনটি কারণ— ১. নেতাদের পুজো অধিগ্রহণ, ২. পুজোর আনন্দটা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে পুরস্কারে এবং ৩. যন্ত্রের কাছে শিল্পীসত্তার আত্মসমর্পণ।
কলকাতার ভবানীপুরে বড় রাস্তার উপরে আমার মামাবাড়ি ছিল। একদিকে সঙ্ঘশ্রী, অন্যদিকে সঙ্ঘমিত্র, সহযাত্রীর মতো পুজো। পিছনে মুক্তদল। ট্রামের তার এড়িয়ে ট্রেলারে চেপে সঙ্ঘশ্রীর ঠাকুর মন্ডপে আসত। রাস্তার দু’ধারে মানুষের ঢল নামত। সঙ্ঘশ্রীর দৃশ্যপট, মুক্তদলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড আর সহযাত্রী এবং সঙ্ঘমিত্রের বিষয়ভাবনা পুজোর চারদিন আমাদের ভবানীপুরেই আটকে রাখার চেষ্টা করত।
সেই পুজোগুলির মতো সত্তর, আশি, নব্বই দশকের অনেক বিখ্যাত পুজোই এখন নতুন প্রজন্মের সদস্যদের অভাবে কোনও ভাবে টিঁকে আছে। স্পনসর, বাজেটের চাপ অনেক পুজো কমিটি নিতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে পুজোর ‘প্রাণ’টাই যে চলে যাচ্ছে। প্রকৃত ‘পুজোপাগল’দের তাই বড় অভাব। রাজ্য সরকারের দেওয়া ৬০ হাজার টাকাতেও প্রাণপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে না।
একটা বিষয় আমাকে খুবই নাড়া দিত। পুজোর বিচারকদের মন্ডপে ঢোকানোর জন্য ‘বাউন্সার’ দিয়ে দর্শক আটকে রাখা। তবে গত বছর থেকে সরকারি ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ষষ্ঠীর মধ্যে পুজোর বিচারপদ্ধতি শেষ করে ফেলতে হবে। সেলিব্রেটি সমন্বয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার কর্তারা যে ভাবে বাউন্সার, কমিটি সদস্য ১০-১২টি গাড়ির কনভয় নিয়ে শহরময় দাপাদাপি করে বেড়াতেন, তাতে যানবাহন চলাচলে ব্যাপক সমস্যা হত। সেই সমস্যা সমাধানে রাজ্য সরকারের এ হেন সিদ্ধান্ত হলেও সাধারণ দর্শকদের আর বিচারসভার কাজের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দড়ির ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।
এ বছর সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় ফোন করে বলতেন, ‘‘যতই থিমপুজো নিয়ে মাতামাতি করো, আমার পুজোয় ভিড় সবাইকে টেক্কা দেবে। আমার পুজোয় দর্শকরাই বিচারক। তাই অন্য কোনও প্রতিযোগিতায় আমার নাম দেওয়ার দরকার নেই।’’ পুজো প্রস্তুতির সময়ে একদিন গড়িয়াহাট দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখেছিলাম একডালিয়ায় বাঁশ বাঁধা হচ্ছে। মনটা হু-হু করে উঠল। মানুষটা পুজো করতেন আমজনতাকে আনন্দ দিতে। সেই পথ থেকে বিচ্যুত হননি কখনও। সুব্রত নেই। কিন্তু এখনও লেবুতলার প্রদীপ ঘোষ, শ্রীভূমির সুজিত বসুরা আছেন। তাঁদের কাছে বরাবর মন্ডপে মানুষের ভিড়টাই আসল পুরস্কার। অন্য পুরস্কারের লড়াইয়ে ওঁরা নেই।
কলকাতায় এখন থিমের পুজোর বাজেট কোটি টাকা ছাড়িয়ে উর্ধ্বমুখী। কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না। ভয় হয়, এই লড়াইয়ে পুজোয় প্রাণের আনন্দটা ক্রমে নষ্ট হয়ে যাবে না তো!