Chinese Economy

চিনের অর্থনীতিতে গতির অভাব স্পষ্ট, ক্ষমতার দুনিয়ায় কি কোনও বড় বদল আসতে চলেছে?

চলতি বছরে চিনের অর্থনীতিতে গতির অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ কি তার প্রতিপত্তি হারাতে চলেছে?

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ১১:০৯
Share:

চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। —ফাইল চিত্র।

সম্প্রতি চিনের অর্থনীতিতে ভাটার টান লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে যখন পণ্যমূল্যের বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, বেজিংয়ের ছবিটি তখন ঠিক তার বিপরীত। উৎপাদকের দিক থেকে পণ্যমূল্যে যে পরিমাণ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে, ভোক্তার দিক থেকে ঘটেছে তার উল্টো ঘটনা। যখন সর্বত্র কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার বাড়াচ্ছে, চিনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক তার আর্থিক নীতি শিথিল করছে। ভারতের মতো দেশে শেয়ার বাজারে যখন তেজি ভাব স্পষ্ট, তখন ‘সাংহাই কম্পোজিট সূচক’ ২০০৯-এর তুলনায় বেশ খানিকটা নিচু! বিশ্বে পণ্য উৎপাদনে অন্যতম অগ্রণী দেশে এই মুহূর্তে শিল্পোৎপাদনের হার চার বছর আগেকার, অর্থাৎ প্রাক্‌-অতিমারি পর্বের থেকেও বেশ খানিকটা কম। চিনে ঋণের চাহিদাতেও পতন দেখা দিয়েছে। আমেরিকান ডলারের তুলনায় ইউয়ানের মূল্যও হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালের মন্দাবস্থা কাটানোর পর সে দেশের অর্থনীতিতে যে পুনরুজ্জীবন দেখা গিয়েছিল, উপরোক্ত কারণে সেখানেও নড়বড়ে অবস্থা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

Advertisement

গত বছর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৫.৫ শতাংশ হবে আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কমে ৩ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০২০ সালে কোভিড অতিমারি শুরু হওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে সাম্প্রতিক কালে এটিই সব থেকে কম বলে মনে হয়। এ বছরের বৃদ্ধির সরকারি লক্ষ্য ৫ শতাংশ। কিন্তু প্রায় প্রতি মাসেই এই লক্ষ্য পুরণের বিষয়টি অনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টির পিছনে দেশজ চাহিদার হ্রাস এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগের অভাব কাজ করছে বলে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ব্যক্তিগত বিনিয়োগে গত এক দশকের মধ্যে প্রথম বার পতন দেখা গিয়েছে (কোভিড অতিমারি শুরুর প্রথম চার মাস বাদ দিলে)। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে শুরু হওয়া নতুন আবাসনক্ষেত্রে গত বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ পতন দেখা গিয়েছে। বাণিজ্যক্ষেত্রে গত আট মাসে ৬ শতাংশ পতন ঘটেছে। আমদানিও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে। সম্পত্তির বাজার এবং রফতানির উপর বিপুল ভাবে নির্ভর করে যে অর্থনীতি, তার উভয় ক্ষেত্রেই এমন পতন চিন্তার বিষয়। অর্থনীতির গতিছন্দে সার্বিক পতন ৩ শতাংশের মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা (কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেশের অর্থনীতির নিরিখে মুদ্রাস্ফীতির যে মাত্রা স্থির করে) পূরণ করতে পারবে বলে মনে হয় না।

চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। —ফাইল চিত্র।

বছরের গোড়ায় কোভিড সংক্রান্ত কড়াকড়ি উঠে যাওয়ায় বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি আশা করেছিলেন। বছরের প্রথম চার মাসে ৪.৫ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করাও গিয়েছিল। কিন্তু গত বছরের প্রথম চার মাসে কোভিড-জনিত লকডাউনের কারণে বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। বৃদ্ধির হার সে সময় ২.৬ শতাংশের বেশি পরিলক্ষিত হয়নি। ইতিমধ্যে, ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এ সব সত্ত্বেও চিনের শাসকদের তরফে আর্থিক উদ্দীপনা যোগানের ব্যাপারে কোনও রকম তৎপরতা দেখা যায়নি।

Advertisement

এই সব সমস্যার কিছু কিছু (সব নয়) ঘুরেফিরে আসে। তার মানে এই নয় যে, পরিকাঠামোগত ভাবে চিনের কোনও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা রয়েছে। সে দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা হ্রাস, সরকার এবং আধা-সরকারি ক্ষেত্রে বিপুল ঋণ, আবাসনক্ষেত্রে প্রয়োজনের থেকে বেশি মাত্রায় নির্মাণ— এ সব কিছুকে অর্থনীতির ভাঙনের পিছনে ক্রিয়াশীল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্বল ভাবে পরিকল্পিত সব প্রকল্প, যেগুলি থেকে বিনিয়োগের অর্থই উঠে আসেনি। তার উপর দূষণ উৎপাদক শিল্পগুলিও জানান দেয় যে, শিল্পক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত পরিবর্তন দ্রুত প্রয়োজন। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রাথমিক পরিচালন শক্তি হিসাবে পুঁজি বিনিয়োগের থেকে ব্যক্তিগত ভোক্তাজগতের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার বহুকথিত পরিবর্তনের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। ভোক্তা-চাহিদার ক্ষেত্রে দ্রুত পতন বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলে।

চিনা উৎপাদনের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পশ্চিমী বিশ্বও কিন্তু বিপদের ঝুঁকি এড়াতে পারবে না। মনে রাখা দরকার, চিন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। সেই সঙ্গে শিল্পোৎপাদনে সে বৃহত্তম এবং প্রধানতম রফতানিকারকও বটে। সে দিক থেকে দেখলে পশ্চিমী দেশগুলির পক্ষে চিনের সঙ্গ ত্যাগ করা সহজ হবে না। যদি তারা ঝুঁকি কমাতে চায়, তা হলে অন্য দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। চিনের দিক থেকে বিষয়টিকে দেখলে, পশ্চিমী প্রযুক্তির আমদানি বন্ধ হওয়াও তাকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে।

চিনের পতনের ব্যাপারে সাবধানবাণী গত দুই দশক ধরে ক্রমাগত উচ্চারিত হয়ে কিন্তু কোনও বারই তেমন কিছু ঘটেনি। এ বারও চিনের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বহু ভিন্‌দেশি বিশেষজ্ঞই বিশ্বাস করেন, ২০২৩ সালের জন্য স্থিরীকৃত ৫ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধির সরকারি লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবে। তেমন হলে এ বছরের বিশ্বের আর্থিক বৃদ্ধির হারের দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে চিনের বৃদ্ধির হার। মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেখলে চিনের স্তরের অর্থনীতির কোনও দেশই তার ধারেকাছে আসতে পারে না। তা সত্ত্বেও চিন যে আমেরিকার চাইতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হয়ে দাঁড়াবে এবং পশ্চিমের কৌশলগত আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে— এই সহজ ধারণাটি বদলানো প্রয়োজন। এই মুহূর্তে যা মনে হচ্ছে, তা ক্ষমতাগত দিক থেকে বিশ্বের পুনর্বিন্যাস, কিন্তু তা কখনই বিশ্বক্ষমতার ভরকেন্দ্রের কোনও উল্লেখযোগ্য বদল নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement