একমাত্র সিনেমা বানানো ছাড়া আমি আর কোনও কিছুই করতে পারি না এবং করতে চাই-ও না,” বলেছিলেন ইরানীয় চলচ্চিত্রের নতুন ধারার অন্যতম পরিচালক জাফর পানাহি (ছবিতে)। ১৯৯৫ সালে আব্বাস কিয়ারোস্তামির লেখা একটি চিত্রনাট্য থেকে পানাহি তৈরি করেন তাঁর প্রথম ছবি দ্য হোয়াইট বেলুন। একটি বাচ্চা মেয়ের রঙিন মাছ কিনতে যাওয়ার গল্প সারা পৃথিবীর সিনেমাদর্শকের কাছে এক বিশেষ মুগ্ধতার আসনে বসিয়ে দেয় পরিচালককে। ছবিটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ক্যামেরা ডি-অর’-এ ভূষিত হয়। ১৯৯৭ সালে পানাহির দ্য মিরর-এর মূল-কেন্দ্রে আবারও দেখতে পাওয়া যায় একটি বাচ্চা মেয়েকে, যে স্কুল থেকে নিজের বাড়িতে ফেরার রাস্তা খুঁজছে। লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি লাভ করে ‘গোল্ডেন লেপার্ড’ সম্মান।
এর পরই বদলে যায় তাঁর ছবির বিষয়-জগৎ। ইরানে মেয়েদের প্রতি সমাজের নিপীড়নমূলক মনোভাবকে সামনে রেখে ২০০০ সালে পানাহি তৈরি করেন দ্য সার্ক্ল। রাষ্ট্রক্ষমতার ধর্মান্ধ মুখচ্ছবি বেরিয়ে পড়ায় ইরান সরকার ছবিটিকে নিষিদ্ধ করলেও সে-বছর আন্তর্জাতিক ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি ‘গোল্ডেন লায়ন’ পুরস্কার পায়। তাঁর পরবর্তী ছবি ক্রিমসন গোল্ড-কে ‘ডার্ক’ অভিধায় রিলিজ়ই করতে দেয়নি ইরান। কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ছবিটি ‘পিক্স ডু জুরি’ সম্মান লাভ করে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের পর খেলার ম্যাচে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের মতে, খেলার মাঠে মেয়েরা উপস্থিত থাকলে তাদের দিকে ছুটে আসতে পারে নানা রকমের কটূক্তি, এমনকি যৌন-হিংসাও। জাফর পানাহির নিজের মেয়েকেও একটি খেলার ম্যাচে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এই অসাম্যমূলক আচরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ২০০৬ সালে পানাহি তৈরি করেন অফসাইড ছবিটি। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অফসাইড ‘সিলভার বেয়ার’ পুরস্কার পায়, এবং ইরানে ছবিটি নিষিদ্ধ হয়।
দ্য সার্ক্ল তৈরির পর থেকেই ইরান সরকার নানা অজুহাতে বেশ কয়েক বার গ্রেফতার করেছিল তাঁকে। শেষ পর্যন্ত, ২০১০ সালে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে ইরানের ইসলামিক কোর্ট তাঁকে ছ’বছরের কারাদণ্ড দেয়, কুড়ি বছরের জন্য তাঁর ছবি তৈরি, চিত্রনাট্য লেখা, দেশের বাইরে যাওয়া, এমনকি সাক্ষাৎকার প্রদানের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
জেলে না পাঠালেও পরিচালকের উপর বাকি নিষেধাজ্ঞাগুলি বহাল রাখে রাষ্ট্র। “ইফ উই কুড টেল আ ফিল্ম, দেন হোয়াই মেক আ ফিল্ম?” বলেছিলেন পানাহি। এই চিন্তার কাছেই আশ্রয় নিলেন তিনি। পরিচালক মোজতবা মিরতাহমসবের সঙ্গে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে তাঁর গৃহবন্দি অবস্থাকে ক্যামেরায় তুলে রাখতে আরম্ভ করলেন। নিজের বন্দি-জীবন ও চার পাশের সময়কে মিলিয়ে কথা বলে চললেন নিজের সিনেমাচিন্তা সম্পর্কে। নজরদারির বদলে চাইলেন প্রত্যক্ষ কারাবাস। রাষ্ট্রের দ্বারা নিষিদ্ধ হওয়ার পর এ ভাবেই তিনি নিজেই নিজের জীবনের উপর তৈরি করলেন একটি ছিয়াত্তর মিনিটের তথ্যচিত্র, দিস ইজ় নট আ ফিল্ম। সেই ছবিটিকে জন্মদিনের কেকের ভিতরে লুকিয়ে ফ্ল্যাশ ড্রাইভে ইরান থেকে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠিয়ে দিলেন। পরে নিউইয়র্ক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও দেখানো হয় ছবিটি। ২০১২ সালের অস্কারের শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি ফিচার বিভাগে তা মনোনয়ন লাভ করে।
এর পরেও তিনি গোপনে বানিয়েছেন ক্লোজ়ড কার্টেন, থ্রি ফেসেস-এর মতো ছবি। ২০১৫ সালে তৈরি করেছেন ট্যাক্সি। ছবিটিতে দেখা যায়, জাফর পানাহি এক জন ট্যাক্সিচালক হিসাবে গোটা দেশ ঘুরে বিভিন্ন যাত্রীর কাছ থেকে শুনছেন দেশের দারিদ্র, লিঙ্গবৈষম্য ও মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে তাঁদের স্বাধীন মতামত। ছবিটি সে বছর বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গোল্ডেন বেয়ার’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়।
গত ১১ জুলাই আবারও গ্রেফতার হয়েছেন পানাহি। এ বছর ২৩ মে দক্ষিণ-পশ্চিম ইরানের আবাদনে একটি দশতলা বাড়ি ধসে পড়ে। আহত ও নিহত হন বহু মানুষ। অনেকেই মনে করছেন, বহুতলটি নির্মাণের পিছনে সরকারের যথেষ্ট দুর্নীতি ছিল। ছ’তলার অনুমতি থাকা সত্ত্বেও আরও চার তলা বাড়ানো হয়। এই ঘটনায় ইরান সরকারের নিরাপত্তার মান বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় দেশের রাস্তায় শুরু হয় প্রতিবাদ। প্রতিবাদীদের পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে, ছোড়ে কাঁদানে গ্যাস। সরকারের এই হিংসার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন মহম্মদ রাসুলফ, মুস্তাফা আল-ই আহমেদ-সহ ইরানের সত্তর জন পরিচালক। সামাজিক অস্থিরতাকে উস্কে দেওয়ার অপরাধে কারারুদ্ধ হন মহম্মদ রাসুলফ ও মুস্তাফা আল-ই আহমেদ। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করলে পানাহিকে জেলে পোরে ইরান সরকার। পানাহির স্ত্রী তাহেরেহ সাইদি জানিয়েছেন, ২০১০ সালে পানাহির উপরে জারি হওয়া ছ’বছরের কারাদণ্ডকে গ্রেফতারির অজুহাত হিসাবে দেখিয়ে তাঁর স্বামীকে কার্যত অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ।
সর্বাধিপত্যকামী, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এ ভাবেই খর্ব করে প্রতিবাদকে। শিল্পের ভাষা যদি সমালোচনায় প্রখর হয়ে ওঠে, শিল্পীর উপর নেমে আসে রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন। শুধু ইরান নয়, পৃথিবীর ইতিহাস আরও বহু যুগে, বহু দেশে একই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। কোনও পাঠকের যদি মনে পড়তে থাকে এই সময়ের, এই দেশের কথা, তাঁকে দোষ দেওয়ার কোনও কারণ নেই।