জলবায়ু সঙ্কট, বিশ্ব উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস এফেক্ট, কার্বন নিঃসরণ ইত্যাদি শব্দগুলোকে এত দিন যাঁরা কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলে উড়িয়ে দিয়ে এসেছেন, গত শীতের ঠান্ডা না পড়া আর এপ্রিলের দীর্ঘ তাপপ্রবাহের পর তাঁদেরও স্বর কিছুটা নেমে এসেছে। বিজ্ঞানীরা যা-যা হবে বলে এত দিন ‘ভয় দেখিয়েছেন’, এখন সে সব একটু-একটু করে সত্যি বলে মালুম হচ্ছে।
ভারতীয় সংবিধানের ৫১এ ধারায় নাগরিকের মৌলিক কর্তব্যের কথা উল্লেখ করা আছে। সেই ধারা অনুসারে বনভূমি, জলসম্পদ, বন্যপ্রাণী ইত্যাদি যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা নাগরিকের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু এই দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে আমরা ছোটবেলা থেকে কতটুকু শিক্ষা পাই? এক যুগ আগে পর্যন্তও এই শিক্ষা পাওয়ার কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। পরিবেশকর্মী ও জনস্বার্থ আইনজীবী মহেশচন্দ্র মেহতার আবেদনে ১৯৯১ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্নাতক স্তরে পরিবেশবিজ্ঞানের একটি বাধ্যতামূলক কার্যক্রম চালু করবার জন্য জাতীয় শিক্ষা সংস্থাগুলিকে (এনসিইআরটি, ইউজিসি) নির্দেশ দেয়। প্রায় পনেরো বছর পার হয়ে অবশেষে ২০০৬-০৭ সাল থেকে ইস্কুলে আর ২০১৩-১৪ সালে কলেজে পরিবেশবিদ্যা পাঠক্রমের অন্তর্গত হয়। তাই মোটের উপর গত দশ-বারো বছর ধরে ইস্কুল এবং কলেজের ছেলেমেয়েরা পরিবেশবিদ্যার পাঠ নিচ্ছে। এখন মাধ্যমিক পাশ ছেলেমেয়েরা গ্রিনহাউস এফেক্ট, ওজ়োন স্তরে ফুটো হওয়ার কথা জানে; স্নাতক স্তরে পদার্থবিদ্যা-ইতিহাস-হিসাবশাস্ত্রের ছাত্ররা এক সঙ্গে বসে বিশ্ব-উষ্ণায়ন আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথা পড়ে।
আমরা যারা ছাত্রাবস্থায় পরিবেশবিদ্যা পড়িনি, তারাই এখন বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থার, শিল্প সংস্থার শীর্ষে; মাঝে মাঝে মনে হয় পরিবেশ রক্ষার মৌলিক বিষয়গুলি না জানাই কি আমাদের নির্দ্বিধায় পরিবেশ ধ্বংসের পথে চালনা করেছে। তা না হলে নির্বিচারে গাছ কাটা, পুকুর বুজিয়ে বহুতল গড়া, বাতাসে নিরন্তর কলো ধোঁয়া ছেড়ে যাওয়ার সাহস আমরা পেলাম কোথা থেকে। সংবিধানের কথা যদি ছেড়েও দিই, আমাদের সাধারণ বুদ্ধি কেন আমাদের নিজেদের সম্পদগুলো সংরক্ষণ করার, এমনকি নিজের খরচ বাঁচাবার কথাও ভাবাল না? গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ যেখানে অপরিমেয় রোদ্দুর (আলো) আর বছরে অন্তত চার মাস বর্ষার ধারাজলের সম্পদে সমৃদ্ধ, সেখানে জলসঞ্চয় না করে ভূগর্ভের জল তুলে নেওয়া, সূর্যের আলোর দিকে দেওয়াল তুলে সারা দিন কৃত্রিম আলো জ্বালানো, হাওয়া চলাচল নেই এমন বাড়ির নকশা করার বুদ্ধিই বা আমাদের হল কোথা থেকে।
পাঠ্যবিষয় হিসাবে যারা পরিবেশবিদ্যা পড়ছে, তারাও কি পরিবেশ-সচেতন হয়ে উঠছে? ঘরের সমস্ত আলো-পাখা চালু রেখে বেরিয়ে আসা ছাত্রদের দেখলে, মহার্ঘ খাবার পাতে ফেলে নষ্ট করা তরুণ-তরুণীদের দেখলে খুব একটা ভরসা হয় না। তার একটা কারণ হল, পরিবেশবিদ্যার পরিবেশনটা বোধ হয় ভুল ভাবে হচ্ছে। যে বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল বোধমূলক বা সচেতনতামূলক, সেটা হয়েছে জ্ঞানমূলক। ইউজিসি-র নির্দেশিত পরিবেশবিদ্যার পাঠ্যক্রমে চোখ রাখলে দেখা যাবে বাস্তুতন্ত্রের (ইকোসিস্টেম) রকমফের, জীববৈচিত্র, নানা রকম চক্রের বর্ণনা বিচিত্র সংজ্ঞা, প্রতিশব্দইত্যাদির ঘনঘটা। সে সব পড়া, জানা ভাল, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই বিষয়কে সর্বজনীন পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তার জন্য এত কিছু না জানলেও হয়তো চলে। পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল, প্রাকৃতিক সম্পদের যথোচিত ব্যবহার ও সংরক্ষণ এবং এই বিষয়ে আমাদের দায় ও দায়িত্বের কথা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে জানা দরকার। সেই জানাকেই বার বার দাগা বুলিয়ে মনের মধ্যে গভীর ভাবে গেঁথে দেওয়া দরকার। কারণ, অনেক সত্যি কথাই বারংবার উচ্চারণ করেই সত্য করে তুলতে হয়। আমাদের কোন কোন কার্যকলাপথেকে কতখানি দূষণ ঘটে, তার তুলনামূলক বিচার ও সেই সব দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী কী করাউচিত, তাই নিয়েও নিয়মিত ও ব্যাপক চর্চার প্রয়োজন আছে।
তার বদলে পরিবেশবিদ্যার পাঠ্যক্রমে অনেক রকম জ্ঞানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকছে পরিবেশ-প্রকৃতি বিষয়ে সচেতনতার পাঠ। ছাত্ররা দরকার মতো পরীক্ষায় গুরুত্ব বিচার করে যা বেছে পড়ছে, তার মধ্যে থেকে হয়তো বাদই পড়ে যাচ্ছে সেই প্রকৃত দরকারি অংশটুকু। অর্থাৎ পরিবেশবিদ্যা একটা পরীক্ষার পড়া হয়ে থেকে যাচ্ছে, জীবনের অংশ হয়ে উঠছে না। তবে এর মধ্যেও যেটুকু পরিবেশ সচেতনতা গড়ে ওঠার সুযোগ আছে, সেটুকুও বন্ধ হতে চলেছে খুব শিগগির। কী ভাবে, সে কথায় আসার আগে পরিবেশবিদ্যা বিষয়ে দুটো কথা বলে নেওয়া যাক। সব কথা সকলেরই জানা। কিন্তু ওই যে বললাম, কিছু বিষয়কে বার বার আলোচনা করে সত্যি করে তুলতে হয়।
কথাগুলো হল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শক্তি নিয়ে। উৎস এবং চরিত্র বিচারে সম্পদকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত চিরস্থায়ী সম্পদ, যা নিরবচ্ছিন্ন ও অনিঃশেষ। যেমন সূর্যালোক, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, সমুদ্রের ঢেউ এবং এদের থেকে পাওয়া শক্তি। এই শক্তি সম্পূর্ণ ভাবে দূষণমুক্তও বটে। দ্বিতীয়ত, পুনর্নবীকরণযোগ্য সম্পদ যা খরচ হয়, আবার নিজে থেকেই পূর্ণ হয়ে ওঠে; যেমন পানীয় জল, ফল, শস্য, কিছু প্রাণিসম্পদ, জৈব গ্যাস, জৈব জ্বালানি ইত্যাদি।আর তৃতীয়ত, পুনর্নবীকরণ-অযোগ্য সম্পদ, যা ব্যবহার করতে করতে এক দিন শেষ হয়ে যাবে। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, খনিজ তেল), নিউক্লীয় জ্বালানি, বিভিন্ন ধাতু ইত্যাদি।এদের থেকে দূষণকারী কার্বন নিঃসরণও ঘটে অনেক ক্ষেত্রে। সুতরাং প্রথম ধরনের সম্পদকে যথাসম্ভব বেশি ব্যবহার করা, দ্বিতীয় ধরনের সম্পদকে আয় বুঝে ব্যয় করা, আর তৃতীয় ধরনের সম্পদের বিকল্প খুঁজে বার করাই হল পরিবেশবিদ্যার পাঠের মূলকথা। সে জন্য বিভিন্ন ধরনের সম্পদ, তাদের ব্যবহার পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানা ও বোঝা জরুরি।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ইস্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে যা যা বাদ গেছে, তার মধ্যে পরিবেশবিদ্যার একটা বড় অংশও রয়েছে। শক্তির উৎস ও শ্রেণিবিভাগ, সৌরশক্তি ও অন্যান্য নিরবচ্ছিন্ন সম্পদের কথা (উল্লিখিত), পুনর্নবীকরণের যোগ্য/অযোগ্য সম্পদ, এই সব কিছু একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, তাদের যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ, জল সংরক্ষণ, বড় বাঁধের উপকার-অপকার ইত্যাদি বিষয়কে ‘এলেবেলে’ করে রাখা হয়েছে, মানে এ সব থেকে পরীক্ষায় প্রশ্ন আসবে না। সুতরাং, পরিবেশবিদ্যার পাঠ কতখানি কাজের বিষয় হয়ে উঠবে তা বুঝতে অসুবিধা হবে না। দুঃখজনক এটাই যে, ডারউইন তত্ত্ব এবং মোগল আমল বাদ পড়া নিয়েই যত প্রতিবাদ হচ্ছে (হওয়াই উচিত), পরিবেশ উহ্যই থাকছে।
জলবায়ু সঙ্কট এতটাই বড় সমস্যা, যার সমাধানের মূল রয়েছে সাধারণ মানুষের সচেতনতায় এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপে। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, যতটা সম্ভব নিজেদের সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রশাসনের উপর প্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করা। তাই সচেতনতা ধ্বংস হওয়ার এই সরকারি উদ্যোগের বিরুদ্ধে এখনই রুখে দাঁড়ানো দরকার।