Mandarmani

জল আর জীবিকার গল্প

মন্দারমণির উপকূলে গজিয়ে ওঠা ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেলগুলোকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত।

Advertisement

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:১৫
Share:

বা‌ংলায় বুলডোজ়ার চলবে না, সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্দারমণির উপকূলে গজিয়ে ওঠা ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেলগুলোকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। সেই নির্দেশের ভিত্তি কিন্তু ছিল রাজ্যেরই উপকূল অঞ্চলের ব্যবস্থাপনার ভারপ্রাপ্ত সংস্থার (কোস্টাল রেগুলেশন জ়োন ম্যানেজমেন্ট অথরিটি, বা সিআরজ়েড) হলফনামা। জাতীয় পরিবেশ আদালতে হলফনামা দিয়ে ওই সংস্থা জানিয়েছিল যে, মন্দারমণির বেশির ভাগ হোটেল যে জমিতে গড়ে উঠেছে, তা উপকূলের এমন অঞ্চলের অধীন (কোস্টাল রেগুলেশন জ়োন ১ এবং ৩), যেখানে নির্মাণ নিষিদ্ধ। সেই হলফনামার ভিত্তিতে আদালত হোটেলগুলি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল ২ মে, ২০২২। বছর দুই পার করে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক (যিনি সিআরজ়েড-এর জেলা কমিটির সভাপতিও বটে) একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন ১১ নভেম্বর, ২০২৪। ১৪০টি অবৈধ হোটেল ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয় সেই বিজ্ঞপ্তিতে। অতঃপর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজেরই প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তি খারিজ করে দিয়ে জানালেন, হোটেলগুলি ভাঙতে দেওয়া যাবে না। হোটেল মালিকরাও জেলা প্রশাসনের ওই বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে কলকাতা হাই কোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন। তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে আপাতত হোটেল ভাঙার বিজ্ঞপ্তির উপরে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিয়েছে আদালত।

Advertisement

আজ যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে হোটেলগুলি, দু’দশক আগে মন্দারমণির সেই উপকূল ছিল মৎস্যজীবীদের দখলে। শুঁটকি মাছের গন্ধ নিয়ে নালিশ করতেন পর্যটকরা। উপকূল বরাবর ছিল ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের ‘খটি’ (সামুদ্রিক মাছ শুকোনোর স্থান)। তাঁরা নৌকা করে মাছ ধরে এনে, সেগুলিকে ঝাড়াই-বাছাই করে শুকোতে দিতেন। বাকি সময়টা এই জায়গাটি তাঁরা ব্যবহার করতেন নৌকা রাখতে, জাল সারাই করতে। খটিগুলোতে বহু মহিলা কাজ করতেন ‘শুকুনি’( মাছ শুকোনোর কাজে নিযুক্ত) ও ‘বাছুনি’(শুকনো মাছ বাছাইয়ের কাজে নিযুক্ত) হিসাবে। বহু পুরুষ ধরে ব্যবহৃত এলাকা হোটেল মালিকদের হাতে ছেড়ে দিতে গোড়ায় অর্থাৎ ২০০০ সালের দিকে আগ্রহী ছিলেন না ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা। পরিস্থিতির চাপে তাঁরা আর সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। গভীর সমুদ্রে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় বড় ট্রলারগুলো অগভীর সমুদ্রে এসে হানা দিচ্ছে। অল্প কিছু ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী বড় ট্রলারের সঙ্গে লড়াই করে টিকে রয়েছেন। তাঁরাই এখনও পর্যন্ত খটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন।

পর্যটনের প্রসারের ফলে মন্দারমণির ভূবৈচিত্র পাল্টে গেল আমূল। ‘কাজির মোহনা’ নামে সমুদ্রে মেশা বড় একটা খাঁড়ি ছিল, হারিয়ে গিয়েছে। আগে লবণ তৈরির কারখানা ছিল, এখন বন্ধ। প্রচুর বালিয়াড়ি ছিল, বালি কাটতে কাটতে সেগুলো এখন সমতল এলাকায় পরিণত হয়েছে। নানা বর্জ্য সমুদ্রে মেশায় দূষণ বাড়ছে। প্লাস্টিক দূষণও বাড়ছে।

Advertisement

প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রেখে, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে, গড়ে উঠবে পর্যটন কেন্দ্র— এমন ভাবনা রয়েছে ‘ইকো-টুরিজ়্‌ম’এর ধারণার কেন্দ্রে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ জায়গাতেই পর্যটনের জন্য প্রকৃতির নিজস্ব রূপ, এবং স্থানীয় মানুষের সাবেক পেশাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মন্দারমণিও তার ব্যতিক্রম নয়। এক সময়ে যাঁরা মাছ ধরতেন, তাঁরা এখন পান-বিড়ি বা চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। নতুন প্রজন্ম সাবেক পেশাকে ধরে রাখতে চাইছে না, দুঃখ করলেন প্রবীণ মৎস্যজীবী শ্রীকান্ত দাস।

এই সঙ্কট এক দিনে তৈরি হয়নি। শঙ্করপুর মন্দারমণি হয়ে দাদনপাত্রবার পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলে ভাঙন ক্রমশ বেড়েছে। পাঁচ দশকে আড়াই হাজার হেক্টর ভূমিক্ষয়ের ফলে হারিয়ে গিয়েছে, বলছে ২০১৩ সালের একটি গবেষণাপত্র। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এই বিপদের দিকে বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ১৯৮৯ সালে বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বই) ও সুন্দরবনের বাসন্তী থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত উপকূল ভাগের সমস্ত মৎস্যজীবী গণ আন্দোলন শুরু করেন ‘ন্যাশনাল ফিশ ওয়ার্কার্স ফোরাম’-এর ছাতার তলায় এসে। দাবি উঠেছিল ‘জল বাঁচাও-তট বাঁচাও-উপকূলের লোক বাঁচাও’। তাতে এই অঞ্চলের মৎস্যজীবীরাও অংশগ্রহণ করেন। এর পরে কোস্টাল রেগুলেশন জ়োন নোটিফিকেশন জারি হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১। মন্দারমণির মৎস্যজীবীরা ভেবেছিলেন ‘নিয়ন্ত্রিত তটাঞ্চল’ ঘোষিত হওয়ায় হোটেল, পর্যটন কেন্দ্র, ভেড়ি ইত্যাদি হবে না। সুরক্ষিত থাকবে তাঁদের জীবন ও জীবিকা। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে হোটেল তৈরি শুরু হয়, বাড়তে থাকে ভূমিক্ষয়। সঙ্কুচিত হতে থাকে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের এলাকা।

পুরনো পেশা গিয়ে নতুন পেশা তৈরি হওয়াই কি প্রত্যাশিত নয়? কথাটা ঠিক, তবে কোনও কোনও জীবিকার সঙ্গে প্রকৃতির সুরক্ষার একটা নিবিড় সম্পর্ক থাকে। নদী, সমুদ্রে যাঁরা মাছ ধরেন, সেই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা জলকে ব্যবহার করলেও জলকে দূষিত করেন না। কারণ তাঁরা জানেন যে, জল ভাল থাকলে তবেই সেখানে মাছ পাওয়া যায়। আবার, যে জলে মাছ পাওয়া যায়, সেই জল ভাল। জল বা উপকূলে মৎস্যজীবীর কাজের পরিসর করে দেওয়ার মধ্যে তাই জল, বালি, জলজ প্রাণীদের বাঁচানোর ব্যবস্থাও লুকিয়ে রয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement