গ্রাম বা শহর, সর্বত্র দড়িতে বাঁধা বানরের নাচ হত। ছবি: শাটারস্টক।
ছেলেবেলার বহু স্মৃতির মধ্যে ডুগডুগির আওয়াজটা এখনও আমার কাছে তাজা। ওই বাজনা শুনে দৌড়ে ঘরের বাইরে গিয়েই দেখা পেতাম বানর বা ভালুকের। দড়িতে বাঁধা বানর আর ভালুকের নাচ দেখে আমরা অনেকেই বড় হয়েছি। ভালুকনাচ, বানরখেলা বা সাপখেলা গ্রাম বা শহর— সর্বত্র হত। বন্যপ্রাণদের এই নাচ তখন এক ধরনের বিনোদন ছিল। আবার সার্কাসেও বন্যপ্রাণদের খেলা দেখেছি। বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ কেমন মানুষের আজ্ঞাবহ ক্রীতদাসে বদলে যেত। লাঠি আর চাবুকের বশে বনের পশুরাজ আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত। থাবা তুলে অভিবাদন জানাত সমবেত দর্শককে। হাতি নারকেল ভেঙে পুজো করত। ঘণ্টা দুলিয়ে নাচত। ভালুক মোটরসাইকেল চালাত। টিয়াপাখি কামান দাগত। বানর ঘোড়ায় চড়ত। আরও কত কী! খাঁচায় পাখি পোষাটাকে একটা সময়ে যেমন স্বাভাবিক হিসাবে ধরে নিয়েছিলাম আমরা, সে রকম এই ধরনের বিনোদনেও অভ্যস্ত ছিলাম। খুব কম সংখ্যক মানুষ ভাবতেন, আমাদের বিনোদনের জন্য অন্য একটা প্রাণী কষ্ট পাচ্ছে বা নির্যাতিত হচ্ছে কি না!
যখন ছোট ছিলাম, মানুষের অধীনে বন্যপ্রাণদের এই ধরনের আচরণ স্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নগুলি উঁকি দিতে থাকল। বনের পশুরাজ শহরের তাঁবুর মধ্যে মানুষের মনোরঞ্জন করছে কেন? মানুষের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে কেন বনের প্রাণী? এই রকম একটা সময়ে সার্কাসের পশুপাখির উপর অসাধু মানুষের নির্যাতন বন্ধ করতে প্রথম আইন আনা হল। সেটা ১৯৯৮ সাল। ধীরে ধীরে মানুষের মনে এই ধারণা সঞ্চারিত হল যে, সার্কাস বা শহরে এই সব বন্যপ্রাণদের অপব্যবহার শুধু তাদের উপর বিকৃত অত্যাচারই নয়, মানুষের সুস্থ চেতনার পক্ষেও ক্ষতিকারক।
রিসাস ম্যাকাক (ম্যাকাকা মুলাটা) প্রজাতির বানর হত্যা, শিকার, খাঁচায় বন্দি করে রাখা বা এদের নিয়ে খেলা দেখানো— এ সবই আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ এবং অপরাধযোগ্য ছিল। ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।
কিন্তু পুরনো প্রশ্নগুলি আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে। কয়েক দিন আগেই ক্যামাক স্ট্রিট, শেক্সপিয়র সরণি অঞ্চলের একটি নাইট ক্লাবে বেশ কয়েকটি বানরকে দিয়ে বিনোদনের চেষ্টা চলছিল। কিছু মানুষ প্রতিবাদ করায়, বিষয়টি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তিনটি বানরকে কলকাতা পুলিশ উদ্ধার করে বন দফতরের হাতে তুলে দেয়। বানরগুলি সল্টলেকের বন দফতরের বন্যপ্রাণ পুনর্বাসন কেন্দ্রে রয়েছে আপাতত। তার পর থেকেই আবার ভাবছি। নিজেকে প্রশ্ন করছি। পরিচিতেরাও অনেকে জানতে চাইছেন। একটা মন্থন হচ্ছে যেন!
প্রথমে আইনের কথায় আসি। বানরগুলি রিসাস ম্যাকাক (ম্যাকাকা মুলাটা) প্রজাতির বলেই আমার মনে হচ্ছে। এই প্রজাতির বানর ১৯৭২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন (ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৭২)-এর দ্বিতীয় তফসিলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যত দিন এই বানর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের অন্তর্গত ছিল, তত দিন তাদের রক্ষণাবেক্ষণ আইনগত ভাবে বলিষ্ঠ ছিল। এই প্রজাতির বানর হত্যা, শিকার, খাঁচায় বন্দি করে রাখা বা এদের নিয়ে খেলা দেখানো— এ সবই আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ এবং অপরাধযোগ্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন (ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট) ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সংশোধিত হয়। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে তা কার্যকরী হওয়ার পর এই প্রজাতির বানর আর এই আইনের আওতায় পড়ে না। সুতরাং, কলকাতার নাইট ক্লাবের মতো অন্যত্রও যদি এই প্রজাতির বানরের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে সেই নিষ্ঠুরতা রোধ করা আগের থেকে বেশি কঠিন।
মানুষের আজ্ঞাবহ ক্রীতদাসের মতন ভালুক মোটরসাইকেল চালাত সার্কাসে। ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।
ব্যাপারটা শুধুমাত্র কলকাতার একটি নাইট ক্লাবে বানর নাচানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আর। দিল্লি ও গুরুগ্রামেও রিসাস বানরের সঙ্গে মানুষের সংঘাত প্রতিনিয়ত চলছে। দিল্লি মেট্রোয় ট্রেনের কামরাতেও বানর ঢুকে পড়তে দেখা গিয়েছে। বানরের সঙ্গে মানুষের সংঘাত উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডেও গুরুতর আকার নিয়েছে। এই সব ক্ষেত্রে যেটা প্রথমেই মনে আসে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সংঘাত ঘটলে আমরা যে রকম মানবিক ভাবে বিষয়টা সামলানোর চেষ্টা করি, সে রকম করে এগুলোও কি করা যায় না? এতে মানুষ ও পশুপাখি, উভয় পক্ষেরই কল্যাণ। পাশাপাশি, আইনের যথাযথ উপযোগ এ ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন।
কলকাতার নাইট ক্লাবের বানরদের বাঁচানোর চেষ্টায় পশুপাখিদের উপর নির্যাতন প্রতিরোধ আইন (প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েল্টি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট, ১৯৬০)-এর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ভারতীয় দণ্ডবিধির কিছু ধারাতেও অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন সংশোধিত হওয়ার পর এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, কোনও প্রাণীকে যদি তার আইনি সংরক্ষণের জায়গা থেকে সরিয়ে আনা হয়, তা হলে আখেরে সেই প্রজাতির প্রাণীর উপর অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যা কলকাতায় হয়েছে। এমনিতেই আমাদের দেশে ‘প্রিভেনশন অব ক্রুয়েল্টি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট, ১৯৬০’ খুবই দুর্বল আইন। এই আইন লঙ্ঘন করার শাস্তি খুবই লঘু। শাস্তির উদাহরণও খুব বেশি নেই।
সার্কাসে বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ কেমন মানুষের আজ্ঞাবহ ক্রীতদাসে বদলে যেত। লাঠি আর চাবুকের বশে বনের পশুরাজ আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত। ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে।
রিসাস বানর একটা সময়ে ভারত থেকে প্রচুর রফতানি হত। কারণ, এই বানরের উপর বিভিন্ন বিদেশি গবেষণাগারগুলিতে প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা হত। এখনও হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের উদ্যোগে এই রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এর পর অনেক জল গড়িয়েছে গঙ্গা দিয়ে। বানর, বনমানুষ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণ নিয়ে অনেক গভীর ও যুগান্তকারী গবেষণা জীববিজ্ঞানের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু চোরাগোপ্তা শিকার ও রাস্তায় বানর নাচানো বা নাইট ক্লাবে বানরের বিনোদন এখনও চলছে।
কলকাতার নাইট ক্লাবের এই ঘটনার পর ভাবার সময় এসেছে, সংশোধিত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন যদি বানরের মতো বন্যপ্রাণ রক্ষা না করতে পারে, তা হলে সংশোধনের উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে কি? সংশোধিত আইন অসাধু বন্যপ্রাণ কারবারি বা বিনোদন সংস্থা— যারা বন্যপ্রাণ দেখিয়ে বা কেনাবেচার মাধ্যমে পয়সা উপার্জন করে, তাদের রাস্তা প্রশস্ত করে দিচ্ছে না তো? সংশোধিত বন্যপ্রাণ আইনের সুবিধা নিয়ে কেউ রিসাস বানর হত্যাও তো করে ফেলতে পারে! কলকাতার নাইট ক্লাবের ঘটনাটি হয়তো অগ্রিম সেই সঙ্কেত দিল। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের সংশোধনের ফল নিয়ে যদি এখনও আমরা সতর্ক না হই, তা হলে ভবিষ্যতে হয়তো রিসাস বানর এবং অন্য আরও প্রজাতির বন্যপ্রাণের দুর্দিন আসন্ন।
মানুষ ও বানরের নৈতিকতার একটা গল্প মনে পড়ছে। বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনাকার কার্ল সাগান ও তাঁর স্ত্রী অ্যান ড্রুয়ান ‘শ্যাডোস অফ ফরগটেন অ্যানসেস্টরস’ বলে ১৯৯৩ সালে একটি বই লিখেছিলেন। বিষয়, মানুষের বিবর্তন। সেই বইতে বানরদের উপর একটি পরীক্ষার কথা উল্লেখ ছিল। যেখানে কিছু বানরকে দু’দলে বিভক্ত করা হয়। এক দল বানরের জন্য এমন ব্যবস্থা ছিল যে, তারা যদি একটা ঘরে অন্য একদল বানরদের ইলেকট্রিক শক দিত, তা হলে খাবার পেত পুরস্কার হিসাবে। ওই পরীক্ষায় দেখা যায়, শতকরা ৯০ ভাগ বানর তাদের স্বগোত্রীয়দের ইলেকট্রিক শক দিতে অস্বীকার করে। নিজেরা অভুক্ত থেকেছে, তা-ও স্বগোত্রীয়দের সঙ্গে খারাপ কাজ করেনি। ওই পরীক্ষার বিষয়ে সাগান ও ড্রুয়ান লেখেন, ‘‘এই বানরগুলি তো কোনও দিন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নীতিকথার শিক্ষা পায়নি। কিন্তু অন্যদের ক্ষতিসাধন করাটা যে অনুচিত, সে বোধ তাদের ছিল। আছে। বানরগুলির জায়গায় মানুষ থাকলে কত শতাংশ অন্যের ক্ষতি করত না, নিজেদের খাবার পরিত্যাগ করে?’’ কলকাতার নাইট ক্লাবের বানরদের দিয়ে বিনোদনের ঘটনাটা এই গল্পটা মনে পড়িয়ে দিল।
আবার বোধহয় মানুষ ও বন্যপ্রাণ সম্পর্কের মূল্যবোধ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। আমাদের মাথায় গেঁথে নিতে হবে, বন্যেরা আসলে বনে সুন্দর।
(লেখক ‘ওয়ার্ল্ড অ্যানিমাল প্রোটেকশন’-এর ওয়াইল্ড লাইফ রিসার্চ ম্যানেজার। মতামত নিজস্ব)