প্রতীকী ছবি।
সমীক্ষাটা হয়েছে ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ নিয়ে। ইংরাজিতে বলে নন কমিউনিকেবল ডিজ়িজ় বা এনসিডি। আর এই নিয়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামেই নয়, বিশ্ব জুড়ে নীতি নির্ধারক ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলির দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারতে আজ এই এনসিডি মহামারি হয়ে দেখা দিয়েছে এবং এর থেকে মৃত্যুর সংখ্যাতেও ভারত অন্যান্য দেশের থেকে রয়েছে এগিয়ে। সমস্যা হল জাতীয় উৎপাদনের নিরিখে ভারত বিশ্বের প্রথম পাঁচটির মধ্যে জায়গা করে নিলেও, মাথাপিছু আয়ের অঙ্কে ভারত এখনও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলির একটি। আর্থ-সামাজিক সমীক্ষাগুলি বলছে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া এই মহামারির পিছনে রয়েছে সামাজিক ও আর্থিক সুরক্ষা নিয়ে বাড়তে থাকা উৎকণ্ঠা। এক কথায় এনসিডি মহামারিকে বাড়তে থাকা আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের সূচক হিসাবেও ধরতে চাইছেন অনেকেই।
যে সমীক্ষা নিয়ে এই প্রসঙ্গের উত্থাপন, সেটি করেছিল ভারতের অন্যতম চিকিৎসা গবেষণা সংক্রান্ত শীর্ষ কেন্দ্রীয় সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ বা আইসিএমআর। কোভিড-উত্তর সময়ে এই সংস্থাটির নাম আর আমাদের কাছে অপরিচিত নয়। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু এ নিয়ে আগেই দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছিল। এবং হাতে হাত রেখে এর মোকাবিলার জন্য টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের অংশ হিসাবে এই লড়াইকেও অংশীদার করে নেওয়া হয়েছে, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সমস্যার প্রতিবিধান করা যায়।
আর একটু এগোনোর আগে দেখে নেওয়া যাক কেন এত দুশ্চিন্তা। সমীক্ষা বলছে, এনসিডি গোটা বিশ্বে প্রতি বছর চার কোটি ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। বিশ্ব জুড়ে প্রতি ১০টি মৃত্যুর মধ্যে সাতটি মৃত্যুর কারণ এনসিডি। আরও ভয়ানক হল এই চার কোটি ১০ লক্ষের মধ্যে এক কোটি ৫০ লক্ষের হয় অকালমৃত্যু।
আর এই সংখ্যায় আমাদের অবদান? এই রোগের কারণে অকালমৃত্যুর ৮৫ শতাংশই হয় ভারতের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশগুলিতে! ভারতের ক্ষেত্রে অঙ্কটা দাঁড়ায় এই রকম। প্রতি বছর আমাদের দেশে ৫০ লক্ষ ৮৭ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী যে রোগগুলি তার সবক’টিই এনসিডি। এই সংখ্যাটি কত মারাত্মক তা বুঝতে শুধু গড় মৃত্যুর সংখ্যায় চোখ রাখাই যথেষ্ট। ভারতে প্রতি বছর মারা যান ৮০ লক্ষের কিছু বেশি মানুষ। আর তার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশই হলেন এনসিডি-র বলি।
ফেরা যাক আইসিএমআর সমীক্ষায়। এই সমীক্ষা বলছে ভারতে ডায়াবিটিস আক্রান্তের সংখ্যা জনসংখ্যার ১১.৪ শতাংশ, প্রিডায়াবিটিসে ১৫.৩ শতাংশ, রক্তচাপে ৩৫.৫ শতাংশ, কোলেস্টরলে ৮১.২ শতাংশ। মাথায় রাখতে হবে দুশ্চিন্তা এবং অন্যান্য মানসিক চাপও এই রোগের তালিকায় একটা বড় জায়গায় আছে। আর এই দুশ্চিন্তার কারণেই কিন্তু উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা থেকে ডায়াবিটিস— সবই নাকি হতে পারে।
আর গল্পের শুরু এইখানেই। সরকারি সংস্থার এই সমীক্ষা বলছে ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এই সমস্যার কারণে হৃদরোগের শিকার অথবা যকৃৎ, লিভার বা কিডনির সমস্যার শিকার হচ্ছে। এই সংখ্যাটা বাড়ছে। মাথায় রাখতে হবে শহরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে উৎকণ্ঠা গ্রামের মানুষের থেকে অনেক বেশি বলেই ধারণা ছিল সবার, এবং সেই কারণেই এই সমস্যাকে শহুরে জীবনের উৎপাত বলে মনে করা হত। কিন্তু এই সমীক্ষা বলছে জীবন নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে গ্রামাঞ্চলেও। এবং এই সমীক্ষা বলছে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এই মুহূর্তে ঢেলে নতুন করে না সাজালে ভারতের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হবে সাংঘাতিক। ভারতের বড় অংশ একই সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার। তাই এখন শুরু হয়েছে এই দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগের অনুসন্ধান।
অনেকেই বলবেন, আসলে এই রোগের ব্যাপ্তি প্রমাণ করে ভারতের বৈভব বাড়ছে আর তার ফল ভোগ করছেন সাধারণ মানুষেরা আর তাই এই এনসিডি-র উৎপাতও বাড়ছে। কারণ, বৈভব বাড়লে মানুষের শারীরিক পরিশ্রম কমে যায় বলেই এটা হয়।
এত দিন এ নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। সম্প্রতি শুরু হওয়া কয়েকটি সমীক্ষার প্রাথমিক নির্দেশ কিন্তু আর্থ-সামাজিক বিভেদই। অর্থাৎ, সাধারণ অনুমান আর বাস্তবের মধ্যে একটা ফারাক এই সমীক্ষাগুলোতে উঠে আসছে।
লানসেটে প্রকাশিত অন্যান্য গবেষণাপত্র, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার, বিশ্বব্যাঙ্ক-সহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির প্রাথমিক নির্দেশ কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশগুলি বিশেষ করে ভারতেও বাড়তে থাকা বৈষম্যের দিকে। জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন জীবনযাত্রার সমস্যায় এই সব রোগ বেশি হত তখন তা ছিল বিত্তের উৎপাত। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে দেখা যাচ্ছে বিত্তের সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতার সংযোগ বাড়ছে। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যে খরচ, তা করতে বিত্তবানেরা সক্ষম। এবং নতুন যুগে তাঁরা তা করছেনও।
উল্টো দিকে সমস্যাটা খুব জটিল। এক দিকে হল পুষ্টিকর খাদ্যের উপর অধিকারের অভাব। আর্থিক কারণে বৈষম্যের বৃহত্তর মেরুতে যাঁদের অবস্থান, তাঁদের পক্ষে যে ধরনের খাবার খেলে এই রোগের হাত থেকে বাঁচা যায় তা তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাশাপাশি, অপুষ্টিকর কিন্তু রসনা তৃপ্ত করে এমন খাবারের প্রতি বাড়তে থাকা টান। কিন্তু এটা একটা ত্রিভুজের মতো। যাঁরা আর্থিক ভাবে বলবান এবং ত্রিভুজের শীর্ষে তাঁদের জীবনযাত্রায় স্বাস্থ্যরক্ষা একটা বড় অংশ। মধ্যে যাঁরা, তাঁরা একদম তলায় যাঁরা আছেন তাঁদের থেকে তুলনায় ভাল কিন্তু এত ভাল নয় যে জীবনযাত্রার নানান সমস্যা থেকে মুক্ত। এঁদের মধ্যে আর্থিক উন্নতি করার উচ্চাশা এবং তা পূরণ করার অক্ষমতা মানসিক অবসাদ তৈরি করছে। আর তার থেকে তৈরি হচ্ছে নানান ছোঁয়াচে নয় এমন রোগ। আর এই আবর্ত প্রস্থে বেড়ে গ্রামীণ সমাজকেও গ্রাস করতে শুরু করেছে।
এই রোগের আরও বড় সমস্যা হল তার চিকিৎসার খরচ। মাথায় রাখতে হবে যে কোলেস্টেরলের সমস্যায় ভুগছেন ভারতের ৮১ শতাংশ মানুষ। তার দোসর হল উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করা। এদের সামলাতে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন। ভারতে চিকিৎসার খরচ বাড়ছে বছরে ১৪ শতাংশ হারে। অর্থাৎ, বৈষম্যের বিস্তৃত মেরুতে যাঁদের বাস তাঁদের কিন্তু ওষুধ বাবদ খরচের বহর বাড়ছে আয়ের বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি হারে। আর এর থেকেও বাড়ছে আর্থিক বৈষম্য।
একটা যুক্তি এখন মাথাচাড়া দিচ্ছে। আর তা হল আগে দেশ বড়লোক হোক তার পর না হয় কল্যাণকামী হওয়া যাবে! কিন্তু সমীক্ষা বলছে স্বাস্থ্যরক্ষায় প্রতি এক টাকা খরচে দেশের লাভ সাত টাকা! অথচ ব্রাজিল যখন তার জাতীয় উৎপাদনের ৮.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে, ভারতে সেই অনুপাত মাত্র ৪.২ শতাংশ!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু খুব পরিষ্কার করে বলছে যে এই মুহূর্তে দারিদ্র্যই এনসিডি মহামারির মূল কারণ। এবং তা তৈরি করছে একটা দারিদ্র্য বাড়ানোর দুষ্ট চক্র। আইসিএমআর-ও তার সমীক্ষায় বলেছে এর আশু সমাধানের পথ খুঁজে বার না করতে পারলে দেশের ভয়ানক বিপদ। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বাড়ছে আর তা নানান ভাবে গ্রাস করছে আমাদের সমাজকে। যার মধ্যে এনসিডি একটি। একে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের প্রমাণ হিসাবে নেব, না বৈষম্য দূর করে তার সমাধান করব সেটা কিন্তু উন্নয়নের নীতির প্রশ্ন। এর উত্তর নিয়ে যত দিন বিরোধ থাকবে তত দিন এই বৈষম্য চলবেই। বর্ধিত হারেই। আর এর বলি হবে সাধারণ মানুষই।