Pilgrimage

মিলে গেল শেষে

কাশীর সব থেকে বড় শিবমন্দির ভাঙার নির্দেশের আগে-পরে জঙ্গমবাড়ি মঠকে অনুদান দিচ্ছেন মোগল বাদশা। বুঝতে সমস্যা হয় না, মন্দির ধ্বংস করলেও তীর্থক্ষেত্রে যাতে প্রভাব না পড়ে তা নিয়ে সচেতন তিনি।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:৫০
Share:

জেমস প্রিন্সেপের লিথোগ্রাফে সে কালের বারাণসী।

যুধিষ্ঠির তীর্থযাত্রায় ইচ্ছুক। লোমশ মুনি তাঁকে বললেন, “তুমি লঘু হও, লঘু হলে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারবে।” মহাভারত বলছে, তীর্থযাত্রীর জীবনে কৃচ্ছ্রসাধন ও কষ্টসহিষ্ণুতা অপরিহার্য। ভীষ্মকে উপদেশ দিতে গিয়ে ঋষি পুলস্ত্যও মনে করিয়েছেন, তীর্থযাত্রীর জীবনে লঘু আহার, উপবাস, আত্মসংযম আবশ্যক। শুনে মনে হতে পারে, কষ্ট সয়ে তীর্থযাত্রাই ভারতীয় সংস্কৃতি, আর তীর্থক্ষেত্র মানেই সমাজবিচ্ছিন্ন নিরালা স্থান। এই ধারণা ধাক্কা খায় ইতিহাসের দিকে তাকালে। দেখা যায়, তীর্থ ও তীর্থযাত্রার বিষয়টি ক্রমে বদলেছে। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে তীর্থস্থান নিয়ে যা দেখছি যা শুনছি তা আসলে কালের প্রবাহে ক্রমপরিবর্তনশীল এক সংস্কৃতির রূপমাত্র।

Advertisement

সংস্কৃত অভিধানে ‘তীর্থ’ বলতে বোঝায় পারাপারের স্থান, পাপক্ষালনের স্থান, পবিত্র জায়গা। ‘পারাপারের স্থান’ অর্থাৎ মর্ত ও স্বর্গের মাঝে থাকা নদীর ঘাট। আবার নদীর অগভীর স্থান, যেখানে পাপ ধুয়ে ফেলা যায়। বৈদিক সাহিত্যে তাই ‘তীর্থ’-এর সঙ্গে নদী বা জলধারার অনুষঙ্গ। সেখানে সশরীরে তীর্থে যাওয়ার থেকেও নদীতীরে বিভিন্ন বৈদিক যজ্ঞপালনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্কন্দপুরাণে তিন ধরনের তীর্থযাত্রার উল্লেখ আছে, জঙ্গম তীর্থ অর্থাৎ সাধু সন্ত ঋষিরা; স্থাবর তীর্থ অর্থাৎ বিভিন্ন মন্দির বা ভৌগোলিক স্থান, এবং মানস তীর্থ: আধ্যাত্মিক ভাবে পুণ্যলাভ। অর্থাৎ তীর্থযাত্রা করতে হলেই লটবহর নিয়ে বিরাট পথ পাড়ি দিতে হবে, এমন কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। তবে সেই নিয়ম কেন বদলে গেল, কেন মানস তীর্থের বদলে স্থাবর তীর্থ ও তীর্থযাত্রা পুণ্যলাভের প্রধান উপায় হয়ে উঠল, তা বুঝতে ভারতের ইতিহাসে ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শের উত্থানকেও বোঝা জরুরি।

গত সহস্রাব্দের গোড়ার কয়েক শতক থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মন্দির নির্মাণ ও তীর্থযাত্রার সম্পর্ক জোরালো হয়। আধ্যাত্মিক উন্নতির চেয়ে সশরীরে তীর্থযাত্রা ও বস্তুগত ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। জোর পায় নানা জায়গায় মন্দির নির্মাণ। মধ্যপ্রদেশে তা দেখা যায় চতুর্থ শতক থেকেই। পাশাপাশি শুরু হয় মন্দিরে জমিদানের রীতি। ওই সময়ের তাম্রশাসনে দেখা যায়, মন্দিরে জমিজমা দান করছেন গুপ্তরাজারা। তবে সব মন্দিরই তীর্থ হয়ে উঠছে না। মধ্যপ্রদেশে তীর্থ বলতে উদয়গিরি, মহেশ্বর, উজ্জয়িনী, সবই নদীর পাড়ে। চতুর্থ শতকেও বাগ তাম্রশাসনে মন্দিরের অবস্থান বোঝাতে বলা হচ্ছে ‘নর্মদা পরকূলে’। বারাণসী বা কাশীর ক্ষেত্রেওএকই ভাবে।

Advertisement

শুধু নদীর পাড়ই শেষ কথা বলে না। ভৌগোলিক অবস্থান, বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, বিদিশার অদূরে উদয়গিরি। পাহাড় ঘিরে নানা মন্দিরে বরাহ অবতার, অনন্তশয়ানে শায়িত বিষ্ণু যেমন আছেন, তেমনই আছে শিবের ও শাক্ত মন্দিরও। বিদিশাতে নানা দেশের বণিক আসতেন, তীর্থক্ষেত্র হিসাবে জনপ্রিয় হতে তাই অসুবিধা হয়নি। মাইকেল উইলিস দেখিয়েছেন, কী ভাবে তীর্থকে ব্যবহার করে ভাবমূর্তি ও আদর্শের বিস্তার করতেন বৈষ্ণব গুপ্তরাজারা। কয়েক শতক পরে প্রতিহার রাজাদের আমলে বিদিশা থেকে অল্প দূরেও একটি তীর্থক্ষেত্র তৈরি হয়। সেখানে মালাদেবী মন্দিরে চোখে পড়বে বৈষ্ণব দেবীর গর্ভগৃহে জৈন তীর্থঙ্করদেরও। একটু দূরে আটখাম্বা শৈব মন্দির, বৌদ্ধ মঠ। নানা ধারার দেবতার উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয় তীর্থক্ষেত্রে ভিন্ন মত ও ধর্মে বিশ্বাসীদের সমান উপস্থিতি।

প্রথম সহস্রাব্দের শেষ থেকেই তীর্থক্ষেত্র হিসাবে খ্যাত সোমনাথ। ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র সে। ১০২৫ সাল নাগাদ সুলতান মামুদের আক্রমণে এই তীর্থ যে নিশ্চিহ্ন হয়নি তার প্রমাণ মেলে, ১০৩৮-এ গোয়ার কদম্ববংশীয় শাসক দ্বিতীয় ষষ্ঠদেবের সমুদ্রযাত্রা করে সোমনাথে তীর্থযাত্রার বিবরণে। পরে কদম্বশাসক গুহল্লদেবও সোমনাথে তীর্থ করতে আসেন। জাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ে পৌঁছন কি না জানা যায় না, তবে বিপদ থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন নৌবিত্তকাধিমান আলীয়, সম্ভবত আলি নামের কোনও আরব জাহাজি।

সোমনাথে মুসলিম বণিকদের প্রভাব নিয়ে রণবীর চক্রবর্তীর গবেষণায় পাই এক দ্বিভাষিক শিলালেখর কথা যেখানে বলা হচ্ছে, হরমুজ় বন্দর থেকে আসা নুরুদ্দিন ফিরোজ় সোমনাথে এসেছেন, শহরের বাইরে জমি কিনে মসজিদ তৈরি করেছেন। মসজিদের ব্যয়ভার নির্বাহে সোমনাথ শহরে দুই পুরোহিতের কাছ থেকে শ্রীবকুলেশ্বরদেব মন্দিরের জমি কিনলেন, দান করলেন মসজিদকে। মন্দিরের জমি কিনে মসজিদ তৈরি হল। একই ‘সেক্রেড স্পেস’-এ ভিন্ন ধর্মের এই সহাবস্থানের পিছনে কারণ কী, বুঝতে সেই বাণিজ্যেই ফিরতে হয়। সমুদ্রবন্দর হিসাবে গড়ে ওঠা সোমনাথে আসতেন আরব জাহাজিরা। বোঝা কঠিন নয়, বাণিজ্য না থাকলে শুধু তীর্থ হিসাবে সোমনাথের টিকে থাকা মুশকিল।

হিন্দুধর্মে কাশী বা বারাণসীর স্থানমাহাত্ম্য বিরাট। তবে তার বাণিজ্যিক গুরুত্বও ছিল। অষ্টম শতকে দামোদর গুপ্তের ‘কুট্টোনিমত্তম’-এ বারাণসীর সোনার জরি দেওয়া বস্ত্রখণ্ডের কথা পাওয়া যায়। সেই শিল্প আরও ফুলেফেঁপে ওঠে একাদশ শতকে সাতটি মুসলিম কারিগর পরিবারের আগমনে। আজও ওই কারিগরদের পরিচয় ‘সাত ঘরিয়া’। মুসলিম কারিগররা বারাণসী পৌঁছনোর আগে বস্ত্রব্যবসা ছিল হিন্দু ক্ষত্রিদের হাতে। নতুন জায়গায় থিতু হতে কম মজুরিতে কাজ শুরু করল ‘সাত ঘরিয়া’রা, সস্তায় শ্রমিক পেয়ে কাপড় বোনার কাজ তাঁদের দিয়ে ক্ষত্রিরা মন দিল বিপণনে। মধ্যযুগে বাংলা থেকে কাঁচামাল যাওয়া, বস্ত্রসম্ভারের খোঁজে আসা দেশ-বিদেশের বণিক, স্থানীয় শ্রমিক— সব মিলিয়ে তীর্থক্ষেত্র বারাণসীর অন্দরে তৈরি হল বাণিজ্যকেন্দ্র। আবুল ফজ়লের লেখাতেও আছে, বাণিজ্যিক লেনদেনের কথা ভেবেই মোগল আমলে বারাণসীতে তামার মুদ্রা তৈরির টাঁকশাল তৈরি হয়।

বাণিজ্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বারাণসীতে ছোট-বড় মন্দির তৈরি ও রাজনৈতিক আবর্তনও চোখে পড়ার মতো। কাশীতে প্রথম হামলার কথা শোনা যায় সুলতান মামুদের সেনাপতি আহমেদ নিয়ালতিগিনের সময়, পরে কুতুব-উদ-দিন আইবক ও রাজিয়া সুলতানের সময়েও। একাধিক মন্দির ধ্বংসের কথাও মেলে। কিন্তু শুধু মন্দির ধ্বংস করতে দিল্লি থেকে তাদের এত দূর পাড়ি মেনে নেওয়া কঠিন। তাতেও বারাণসী নিশ্চিহ্ন হয়নি, প্রমাণ করে মোগল আমলে বিশ্বনাথ মন্দির নির্মাণের তথ্য। আকবরের আমলে অম্বরের রাজা মানসিংহ এবং টোডর মলের আনুকূল্যে গড়ে ওঠে এই মন্দির।

সপ্তদশ শতক থেকে কাশীতে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে শৈব মঠ, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ও মসজিদও। ১৬৫৯-এ ঔরঙ্গজ়েব ফরমান জারি করে মোগল আধিকারিকদের কাশীর মন্দিরের ব্রাহ্মণদের বিরক্ত করতে নিষেধ করছেন, তার দশ বছরের মাথায় বিশ্বনাথ মন্দির ভাঙার নির্দেশ দিচ্ছেন। গড়ে উঠছে জ্ঞানবাপী মসজিদ। অড্রে ট্রুশকের মতো ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, মন্দির ভাঙার পিছনে ধর্মান্ধতা নয়, রাজনৈতিক কারণই দায়ী। কারণ, কাশীর সব থেকে বড় শিবমন্দির ভাঙার নির্দেশের আগে-পরে শৈব সম্প্রদায়ের জঙ্গমবাড়ি মঠকে একের পর এক অনুদান দিচ্ছেন মোগল বাদশা। বুঝতে সমস্যা হয় না, মন্দির ধ্বংস করলেও তীর্থক্ষেত্রে যাতে প্রভাব না পড়ে তা নিয়ে সচেতন ছিলেন দিল্লির বাদশা। বারাণসী তীর্থক্ষেত্রের সঙ্গে বাণিজ্যের সম্পর্কের জন্যই কি?

আঠারো শতকেও বারাণসী স্বমহিমায়। ১৭৮০-তে অহল্যাবাই বর্তমান বিশ্বনাথ মন্দির তৈরি করছেন, পাঁচ বছরের মধ্যেই ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে মন্দিরের সামনে নহবতখানা তৈরি করাচ্ছেন রাজস্ব আধিকারিক। তৈরি হয়েছিল মসজিদও। ১৮২২-এ জেমস প্রিন্সেপ বারাণসীতে এক হাজার মন্দিরের পাশাপাশি প্রায় ৩০০টি মসজিদের কথা বলছেন। ১৮২৫-এ রেজিনাল্ড হেবার লিখছেন, তীর্থযাত্রীরা আসছেন নেপাল, তিব্বত, বর্মা থেকেও। ১৮৩০-৩১’এ তেলুগু পণ্ডিত এনুগুলা বীরস্বামী কাশী যাত্রা চরিত্র বইয়ে বারাণসীর অলিগলিতে বহু শিবমন্দির গড়ে ওঠার কথা লিখছেন।

সেই বারাণসী থেকেই আজ ভোটে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। তাকে ঢেলে সাজিয়ে ভোটে হাওয়া কাড়তে চান। বিপক্ষের কেউ ধর্ম নিয়ে, তীর্থক্ষেত্র নিয়ে রাজনীতির প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু ইতিহাসের তথ্য বলে, এ দেশে ধর্মস্থান কখনওই শুধু ধর্মের গণ্ডিতে বদ্ধ থাকেনি, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তীর্থক্ষেত্র, ‘সেক্রেড স্পেস’। সেই ‘স্পেস’-এ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে, সমাজ নতুন পথের সন্ধান পেয়েছে। আজকের মতো ধর্মান্ধতার বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement