ছবি: রৌদ্র মিত্র।
পশ্চিমাকাশ থেকে অস্তগামী সূর্যের অন্তিম আভা আপাত শান্ত সমুদ্রের বুকে ডুবে যাওয়ার উপক্রম করছে। সন্ধ্যা আগত। শান্ত বাতাস নিভৃত কূজনের মতো চঞ্চল ঊর্মিমালার সঙ্গে খেলায় মত্ত। বেলাভূমির এই দিকটায় মানুষের যাতায়াত বিরল। অপরাহ্ণের পরে একেবারেই নির্জন। শুধু বেলাভূমির বুকে দূর থেকে ধেয়ে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ শোনা যায়। তার সঙ্গে মিশে থাকে বাতাসের গুঞ্জন।
এমন নির্জন স্থানে অস্তগামী সূর্যের দিকে অপলকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘদেহী, উন্নতশির এক যুবা পুরুষ। তাঁর পরনে রাজকর্মচারীর বেশ। মাথায় পাগড়ি। পাগড়ির একটি খুঁট সামনের দিকে এনে নাক ও মুখের নিম্নাংশ ঢেকে রেখেছেন। যাতে পরিচিত কোনও মানুষের মুখোমুখি হলেও আত্মপরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হন।
যুবাপুরুষটির মন আজ বড়ই বিক্ষিপ্ত। এক বার ঘাড় ফিরিয়ে চার পাশে তাকালেন। চরাচর কেমন যেন শান্ত থমথমে হয়ে আছে। মনে মনে ভাবলেন, এ যেন এক ঝড়ের পূর্বসঙ্কেত।
সত্যিই তাই। উৎকল, গৌড়, বিহার কোথাও যেন শান্তি নেই। তার মধ্যে উৎকল তবু কিছুটা শান্ত। কিন্তু কত দিন এই শান্তি থাকবে কে জানে! কারণ প্রতিবেশী গৌড়ের অবস্থা ভীষণ উন্মত্ত। গৌড়েশ্বর সুলতান হুসেন শাহের শাসনে সারা বাংলার পরিস্থিতি অস্থির। বঙ্গদেশে হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সুলতান হুসেন শাহ ক্রমশই যুদ্ধোন্মাদ হয়ে উঠছেন। নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহে তাঁর ক্লান্তি নেই। হাবসি ক্রীতদাসদের উৎপাটন করে সারা বাংলায় নিরঙ্কুশ অধিকার কায়েমের নেশায় তিনি উন্মত্ত। কামরূপ অভিযানে গিয়ে তিনি ধ্বংস করেছেন কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির। কিন্তু তিনি অসম বিজয়ে সক্ষম হননি। তাঁর সেই পরাজয়ের আক্ষেপ মাত্রাহীন ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী কোনও রাজ্যজয় করতে পারলে তবে তাঁর ক্রোধের আগুন নির্বাপিত হবে। ফলে পররাজ্য বিজয়ের চিন্তাতেই তিনি বিভোর।
তখন খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকের শেষ লগ্ন। বৈশাখ মাসের সন্ধ্যা। যুবাপুরুষ এক বার কপালে হাত ঠেকালেন। চোখদু’টি মুদিত করে ভক্তিভরে কয়েক পঙ্ক্তি মন্ত্রোচ্চারণ করলেন। শেষে বললেন, “বিশ্বেশ্বর তুমিই সহায়।”
বহু দূর থেকে তখন সন্ধ্যারতির কাঁসর-ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। সেই শব্দের আড়ালে পা টিপে টিপে এক ন্যুব্জ চেহারা ছায়ার মতো সেই যুবাপুরুষের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। অন্ধকারে তাঁকে চেনা যায় না। তাঁর পোশাক জগন্নাথ মন্দিরের সেবায়েতের মতো। মুণ্ডিত মস্তকে পাগড়ি। পাগড়ির খুঁটে মুখমণ্ডল আবৃত। কেবল জ্বলজ্বলে চোখ দু’টি দেখা যায়। দীর্ঘ শরীরের ভারে তিনি যেন নুয়ে পড়েছেন। শরীর শুষ্ক পাটরজ্জুর মতো পাকানো। ফলে তাঁর বয়সের পরিচয় অনুমানেও ব্যর্থ হতে হয়।
ন্যুব্জ ব্যক্তি এক বার গলাখাঁকারি দিলেন।
যুবাপুরুষটি সতর্ক ছিলেন, তবুও যেন সহসা চমকে উঠলেন। ঘাড় ফিরিয়ে অন্ধকারে ঠাহর করলেন পিছনের ব্যক্তিকে। তার পর মৃদু শান্ত স্বরে বললেন, “এসেছ? কী সংবাদ, মাধব?”
“সংবাদ সুখের নয়, আর্য। অসির ঝঙ্কার, মানুষের হাহাকার কি আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?”
যুবাপুরুষ বললেন, “পাচ্ছি...” একটু থেমে বললেন, “চলো মাধব, আপাতত আমরা রত্নাকর-প্রণাম সেরে আসি।”
গোপন পরামর্শকারীর মতো মৃদু আলোচনারত তাঁরা ধীর পায়ে অন্ধকার সমুদ্রের দিকে চললেন।
মাধব মিশ্র যখন হাঁটেন, মনে হয় মাটিতে যেন তাঁর পা পড়ে না। শব্দহীন ছায়ার মতো তাঁর ভঙ্গি। তিনি যেন ছায়াজগতের মানুষ। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় তাঁকে জগন্নাথদেবের মন্দিরের আশপাশে দেখা যায়। নিজেকে ছায়ার আড়ালে রেখে অতীব সন্তর্পণে ঘুরে বেড়ান। কেউ তাঁকে দেখে হয়তো ভাবে ভিক্ষুক কিংবা মন্দিরের দুঃস্থ সেবায়েত। শুধুমাত্র উচ্চপদস্থ দু’-এক জন রাজকর্মচারী জানেন তাঁর আসল পরিচয়।
হাঁটতে হাঁটতে মাধব মিশ্র বললেন, “ইসমাইল গাজী সৈন্যসামন্ত নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন।”
যুবাপুরুষ ঘাড় না ফিরিয়েই বললেন, “আমিও তা-ই অনুমান করেছি। সুলতান হুসেন শাহ এই সুযোগ কখনওই হাতছাড়া করবেন না। তা, তাদের উৎকল সীমান্তে পৌঁছতে কত দিন লাগবে?”
“কত দিন কী বলছেন আর্য! তারা অনেক আগে থেকেই বাংলা-ওড়িশা সীমান্তে মান্দারন দুর্গে ঘাঁটি পেতে বসেছিল। সেখান থেকে ওড়িশা সীমান্ত মাত্র ক্রোশ খানেক।”
যুবাপুরুষ যেন অবাক হলেন। বিস্ময়ভরা চোখে মাধব মিশ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সে কী! সে খবর তো রাজপুরীতে কারও কাছে নেই!”
“তবে আর বলছি কী আর্যপুত্র! শিয়রে শমন।”
তাঁরা বেলাভূমি পেরিয়ে একেবারে সমুদ্রের কিনারায় এসে উপস্থিত হয়েছেন। জলে পা ঠেকানোর আগে এক বার অনন্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে করজোড়ে বিপুল জলরাশির উদ্দেশে প্রণাম নিবেদন করে ভক্তিভরে মনে মনে মন্ত্রোচ্চারণ করলেন আর্যপুত্র নৃসিংহ উপরায়। সমুদ্র প্রণাম সমাপন করে মাধব মিশ্রকে বললেন, “তুমি প্রণাম করলে না!”
তাঁর ওষ্ঠের কিনারায় এক বঙ্কিম হাসি। দেখে মাধব যেন কিছুটা লজ্জা পেলেন। এক বার জোড়হাত করে দুই চোখ মুদিত করলেন মাত্র। সমুদ্রদেবতাকে নয়, বরং এক বিপুল রহস্যময় অনন্তের উদ্দেশে তিনি তাঁর প্রণাম নিবেদন করলেন। এই অসীম অনন্তই তাঁর দেবতা।
নৃসিংহ বললেন, “অনুমান করেছিলাম, এমনই একটা কিছু হবে। মহারাজ এই সময় বিজয়নগরের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত। তিনি আছেন দাক্ষিণাত্যে কৃষ্ণা নদীর তীরে। ফলে রাজকর্মচারীদের সমস্ত মনোযোগ এখন সেই দিকে। বাংলার সীমান্ত সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এই সুযোগ কি হুসেন শাহের মতো যুদ্ধবাজ ধূর্ত সুলতান ছাড়তে পারে!”
কিয়ৎক্ষণ থেমে তিনি আবার বললেন, “আজ রাতেই মহারাজের কাছে দূত পাঠাতে হবে।”
নৃসিংহ উপরায় যেন ক্ষণকাল আনমনা হয়ে কিছু ভাবছিলেন। পায়ের কাছে চঞ্চল ঢেউ ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে বার বার।
মাধব বললেন, “যা খবর পাওয়া গেছে, তাতে আগামী প্রভাতেই ওরা ওড়িশায় ঢুকে পড়বে।”
নৃসিংহ আনমনে এক বার ঘাড় নাড়লেন। তার পরে চিন্তিত গলায় বললেন, “আর কোনও গুরুতর সংবাদ আছে?”
“আছে আর্য। তবে তা আমি আগামী কাল নিশ্চিত হয়ে আপনাকে জানাব।”
“কেন? এই আক্রমণের পিছনে কি অন্য কোনও অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে?”
“সম্ভবত তা-ই, আর্য। তবে আমি নিশ্চিত নই। আজ রাতেই আমি নিশ্চিত হয়ে যাব। মান্দারন দুর্গ থেকে এক অশ্বারোহী রওনা হয়ে গিয়েছে। আশা করি পথে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটলে আজ শেষ রাতের দিকেই সে এখানে পৌঁছে যাবে।”
যুবাপুরুষ যেন তাঁর কথায় সন্তুষ্ট হলেন। আশ্বস্ত হলেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত গলায় বললেন, “তুমি যথার্থ ব্যবস্থা করেছ। তবে গুপ্ত সংবাদ পাওয়া মাত্রই আমাকে খবর দেবে, তা সে যত রাত্রি হোক না কেন! বিলম্ব করবে না। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।”
“আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আর্য।”
নৃসিংহের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাধব মিশ্র যেন অন্ধকার চরাচরের ভিতরে মিলিয়ে গেলেন।
নৃসিংহ আরও কিছু ক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আকাশে চাঁদ নেই। অমাবস্যা তিথি। তবে পরিষ্কার আকাশে যত দূর দেখা যায়, অজস্র তারা ফুটে আছে। এত সহস্র তারার ভিতরে একটি তারাকে তিনি খুঁজতে লাগলেন। তাঁর পিতা।
হঠাৎ মনে পড়ল, গত কয়েক দিন ধরেই তিনি একটাই স্বপ্ন বার বার দেখছেন। একটি বীভৎস সাপের স্বপ্ন। কী একটা অন্ধ ভয় যেন স্বপ্নের মধ্যেই বারবার গ্রাস করছে তাঁকে। অথচ তিনি ভয় পাওয়ার মানুষ নন।
সমুদ্রের দিক থেকে তিনি ফিরে চললেন। এক বার পণ্ডিতচূড়ামণি সার্বভৌম ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে যেতে হবে। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছ থেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যাটা তাঁকে জানতে হবে।
তিনি দ্রুতপায়ে মন্দিরের পথ ধরলেন।
ক্রমশ