Swami Vivekananda

অধ্যাপক হিসেবেও বিদেশে জনপ্রিয় হয়েছিলেন স্বামীজি

তৃতীয় বারের লন্ডন সফর তিনি কাটিয়েছিলেন ‘ভিজ়িটিং প্রফেসর’ হিসেবে বক্তৃতা দিয়ে। সঙ্গে বেদান্তের প্রচার তো ছিলই। জনমানসে মুগ্ধতা এবং প্রশংসার বন্যা বয়ে গিয়েছিল তাঁকে ঘিরে।

Advertisement

বাপ্পাদিত্য গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫ ০৭:২৭
Share:

স্বামী বিবেকানন্দ। নিজস্ব চিত্র।

দিনটি ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬। সেভিয়ার দম্পতি, ক্যাপ্টেন জন হেনরি সেভিয়ার আর মিসেস শার্লট এলিজ়াবেথ সেভিয়ারের সঙ্গে মাস দুয়েক সুইৎজ়ারল্যান্ডের আল্পসে গরমের ছুটি কাটিয়ে জার্মানি-হল্যান্ড ঘুরে উনি ইংল্যান্ডে ফিরলেন। লন্ডনে এসে উঠলেন মিস মুলারের উইম্বলডনের বাড়ি এয়ারলি লজ-এ।

Advertisement

লন্ডনে এই নিয়ে তিন বার এলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আগেও উনি হেনরিয়েটা মুলারের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। ধর্মতাত্ত্বিক হেনরিয়েটা মুলার ১৮৯৩-এর শিকাগো ধর্মমহাসভায় প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন; সেখানে মুখ-চেনা হলেও প্রথম আলাপ আগের বছর, মানে ১৮৯৫ সালে। ওই বছরেই ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর, আড়াই মাস, স্বামীজি ইংল্যান্ডে ছিলেন। সেই পর্বেই, সাউথ বেলগ্রেভিয়ার এক বাড়িতে, আলাপ হয় মিস মার্গারেট নোবেলের সঙ্গে।

লন্ডনে দ্বিতীয় বার স্বামীজির থাকা ১৮৯৬-তেই। তিনটি মাস পুরোটাই ছিলেন বেলগ্রেভিয়ার মার্গেসন দম্পতি— মর্টিমার রেজিনল্ড আর লেডি ইসাবেল মার্গেসনের বাড়িতে। সহোদর মহেন্দ্রনাথ তো তখন লন্ডনেই, আইন পড়তে এসেছেন; সঙ্গে লন্ডনে ডেকে নিয়েছিলেন গুরুভাই শরৎকেও। এই দু’ভাইকে নিয়ে মে মাসের লন্ডনে বসন্তটা ভারী সুন্দর কেটেছিল।

Advertisement

তবে, গত দু’বারের তুলনায় লন্ডনে এই তৃতীয় সফরের তফাত অনেক। ১৭ সেপ্টেম্বর হেনরিয়েটা মুলারের বাড়ি ঢুকেই দুই বোন, হ্যারিয়েট আর মেরি হেলকে দুটো চিঠি লিখলেন স্বামীজি। মেরিকে লেখা চিঠির শেষ লাইনে জানালেন, “শ্যাল ওয়ার্ক ফর আ ফিউ উইকস, অ্যান্ড দেন গো ব্যাক টু ইন্ডিয়া।” এ বারে আর ঠিক বেড়াতে নয়, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন ‘ভিজ়িটিং প্রফেসর’-এর চাকরি করতেই লন্ডনে এসেছেন। স্টার্ডির তত্ত্বাবধানে একটা গোটা টার্ম ধরে লন্ডনে পড়াবেন; টার্ম শেষ হলেই বাড়ি ফিরবেন। অনেক দিন হল দেশ-ছাড়া, মন উচাটন।

গত দু’বছর ধরেই স্বামীজি খেয়াল করেছেন, আমেরিকার তুলনায় ইংল্যান্ডের অধ্যাপকরা ক্লাসরুমে অনেক কম সময় পড়ান, লেকচারের সংখ্যা তাই বেশ কম। আমেরিকাতে সিমেস্টার-প্রথা চালু হয়েছে অনেক আগেই। শরতে পাতা-ঝরার মরসুমের এই সিমেস্টারটাকে ও দেশে বলে ফল-সিমেস্টার; অগস্টের মাঝামাঝি শুরু হয়ে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শেষ। তুলনায় এই দেশে, অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে মাত্র আট সপ্তাহ পড়ানো হয়।

১৮৯৫ সালে টেমস নদীর ধারে স্ট্র্যান্ড সংলগ্ন জন অ্যাডাম স্ট্রিটের এক বাড়িতে মাত্র তিনটে ঘর নিয়ে একটা নতুন ইনস্টিটিউট খোলা হয়েছে; নাম ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স’, সংক্ষেপে, এলএসই। এখানে শুধু অর্থনীতি, সংখ্যাতত্ত্ব আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানো হয়। প্রথম বছরেই তিনশো জন ছাত্র মিলেছে। নতুন এই বিষয়গুলো যে এত জনপ্রিয় হবে, তা হয়তো সংগঠকরাও ভাবেননি। অগত্যা, এ বছর তাঁরা বড় বাড়ি নিয়েছেন। টেমস নদীর ধারেই অ্যাডেলফি টেরাস-এ। এলএসই-তে কিন্তু অক্টোবরের এই শরৎকালীন টার্মে দশ সপ্তাহ ধরে পড়ানো হবে স্থির হয়েছে।

এডওয়ার্ড স্টার্ডি ঠিক করেছেন, এ ভাবে এলএসই-র আদলেই দশ সপ্তাহের একটা লেকচার কোর্স পড়ানো হবে। এ বছরের প্রথম সপ্তাহ শুরু হবে ৫ অক্টোবর আর দশম সপ্তাহ ৭ ডিসেম্বর থেকে। একটা বড় হলের খোঁজ শুরু করলেন যাতে অন্তত শ’দেড়েকের স্থান অনুকূল হয়। তবে, এলএসই-তে তিনশো জন গেছে বলেই এখানেও অত জন ছাত্র কি এক ভারতীয়ের কাছে নিয়মিত পড়তে আসবে? স্টার্ডি ভাবলেন, সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়িতে তো অনেকে স্বামীজির ক্লাস শুনতে আসতেন। দশ সপ্তাহে নিয়ম করে পঠনপাঠন হলে হয়তো ছাত্র জুটবে। একটা ফাটকা খেললেন স্টার্ডি।

স্থির হল, এই কোর্সে প্রতি সপ্তাহে ওঁর তিনটি করে লেকচার থাকবে। এ ছাড়া, উনি চাইলে অন্যত্র লেকচার দিতেই পারেন। মিস মুলারের বাড়ি এয়ারলি লজেই উনি মাঝেসাঝে ক্লাস নেন, পাড়া-পড়শি শুনতে আসেন।

স্টার্ডি ভাড়া নিলেন ৩৯, ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের উঁচু বাড়িটার সাত তলায়, তিনটে ঘর। তিনটে ঘর পাশাপাশি। ঘরের মাঝের দেওয়াল নেই, পার্টিশন দেওয়া। প্রয়োজনে পার্টিশন সরিয়ে ঘর তিনটে জুড়ে নিলেই একটা বড় হলঘরের আকার নেয়, তাতে দু’শো জনের বসার জায়গা সহজেই হতে পারে।

প্রথম দিন, ৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় ক্লাস শুরুর আগেই ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে সাত তলার তিনটে ঘর জুড়ে স্বামীজিকে অভ্যর্থনা করা হল। পরদিন লেকচারের পর আমেরিকার সাংবাদিক মিসেস ওলি বুলকে চিঠি লিখলেন, “থিংস আর ওয়ার্কিং ভেরি ফেভারেবলি হিয়ার ইন ইংল্যান্ড। দ্য ওয়ার্ক ইজ় নট ওনলি পপুলার বাট অ্যাপ্রিশিয়েটেড।”

লেকচার ছাড়া আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল স্বামীজির, পশ্চিমে বেদান্ত প্রচার। তাই গত এপ্রিলে বছর তিনেকের ছোট শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে উনি বিশেষ কারণেই ইংল্যান্ডে টেনে আনেন। ২৭ জুন, গুডউইনের সঙ্গে শরৎকে আমেরিকা চলে যেতে বলেন; ২ জুলাই দু’জনে নিউ ইয়র্কে পৌঁছন। ৭ জুলাই থেকে স্বামী সারদানন্দ পশ্চিমে লেকচার দিতে শুরু করেন, নিউ ইয়র্কে তাঁর প্রথম বক্তৃতা— ‘দ্য বেদান্ত ফিলসফি’।

শরৎ তো একা পারবেন না, তাই আর এক ছোট গুরুভাই কালীপ্রসাদকে স্বামীজি তলব করলেন। উইম্বলডন থেকে সপ্তাহে তিন দিন ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে যাতায়াত করা অসুবিধে হওয়ায় তিন মাসের জন্য ভাড়া নেওয়া হল গ্রে কোর্ট গার্ডেনসের এক অ্যাপার্টমেন্ট। ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটের লেকচার হল থেকে ঢিল-ছোড়া দূরত্বে। কালীপ্রসাদকে নিয়ে উনি এই অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এলেন। দশ দিন পরে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন তৃতীয় ব্যক্তি, আমেরিকা-ফেরত গুডউইন।

কালীকে হাতে ধরে বক্তৃতা শিখিয়েছিলেন স্বামীজি। তিনি চান, তিন-চার সপ্তাহ পর ওঁর কোর্সেই কালীপ্রসাদ দু’-একটা লেকচার দিন, ‘গেস্ট লেকচারার’ হিসেবে। কালী সাহস পাচ্ছিলেন না। এক দিন স্বামীজি রেগে গিয়ে বলেই ফেললেন, “কালী তোকে আমি এ বারে জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেব।”

কালীপ্রসাদ ইংল্যান্ডে প্রথম বক্তৃতা দিলেন ২৭ অক্টোবর, খ্রিস্টোথিয়োসফিক্যাল সোসাইটিতে। ১১ নভেম্বর কোর্সের ষষ্ঠ সপ্তাহে লেকচার হলে ক্লাস নিলেন স্বামী অভেদানন্দ। দশ সপ্তাহ ধরে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে কোর্স চলল। প্রতি ক্লাসে দুশোর বেশি শ্রোতা আসতেন। খেটে গেল স্টার্ডির ফাটকা

তবে গ্রে কোর্ট গার্ডেনসে চলে আসার পরেও হেনরিয়েটা মুলারের বাড়ি এয়ারলি লজে ক্লাস নেওয়া কিন্তু বন্ধ করেননি স্বামীজি। এই দুই নিয়মিত ক্লাস ছাড়াও আরও লেকচার স্বামীজিকে দিতে হল এই টার্মে। সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়ির মালিক লেডি ইসাবেল মার্গেসন ছিলেন ‘সেসমি ক্লাব’ নামক একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। লেডি মার্গেসনের অনুরোধে উনি এই ক্লাবেও নিয়মিত লেকচার দিতে রাজি হলেন। নিয়মিত লেকচার দিয়েছেন ইউনিটারিয়ান অ্যান্ড ফ্রি ক্রিশ্চিয়ান চার্চে। এ ছাড়াও দিয়েছেন অনেক খুচরো লেকচার।

১৩ ডিসেম্বর, শরৎকালীন টার্ম শেষ হলে স্টার্ডি সকল শ্রোতা ও ছাত্রের তরফে ওঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন, ইনস্টিটিউট অব পেন্টারস অ্যান্ড ওয়াটার কালারস-এর হলে। পাঁচশো জন জমায়েত হয়েছিলেন। সে দিন বাড়ি ফিরে এক আমেরিকান ভক্ত মহিলাকে চিঠিতে তিনি লিখলেন “ডুয়িং দ্য ডিউটি অব দ্য টাইম ইজ় দ্য বেস্ট ওয়ে, অ্যান্ড ইফ ইট ইজ় ডান ওনলি অ্যাজ় এ ডিউটি, ইট ডাজ় নট মেক আস অ্যাটাচড।”

তথ্যসূত্র: ‘ক্রোনোলজি অব স্বামী বিবেকানন্দ ইন দ্য ওয়েস্ট’— টেরান্স হোনার এবং ক্যারোলিন কেনি সঙ্কলিত, প্রানা প্রেস (পোর্টল্যান্ড, অরেগন, ইউএসএ); ‘লেটারস অব স্বামী বিবেকানন্দ’— অদ্বৈত আশ্রম, মায়াবতী (মুদ্রণ: কলকাতা)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement