ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করেছিলেন মীনা দাস। “আমাদের কিশোরী বাহিনীর মেয়েরা বলে বেড়াচ্ছে, নতুন আইনে নাকি রেপ করলে সাত দিনের মধ্যে ফাঁসি হয়ে যাবে? এমন কি হতে পারে? আইনটা দেখেছেন?” বারুইপুরের এই কিশোরীরা ‘অসভ্য ছেলে’দের মাঝেমাঝেই পিটিয়ে দেয়, পুলিশ গড়িমসি করলে থানা ঘেরাও করে। কুস্পর্শ, কুকথার সঙ্গে নিত্য লড়াই করছে এরা, যেখানে একটু আশ্বাস, একটু আশার খোঁজ পায়, অমনি তা মুঠো করে ধরতে যায়। ‘অপরাজিতা বিল’ এসেছে শুনে থেকে তারা নেট খুঁজছে— সাত দিনে ধর্ষক নিকেশ, এমন কি সত্যিই হবে?
এই আকুলতা বিলক্ষণ বোঝেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই প্রকাশ্য সভায় বলেছেন, “আমাদের হাতে আইনের ক্ষমতা নেই। থাকলে সাত দিনে ফাঁসি করতাম।” হয়তো রাজ্যের ক্ষমতা দেখাতেই তড়িঘড়ি অপরাজিতা বিল পাশ করালেন, বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে। পোড়খাওয়া সংসারীরা জানেন, বিয়েবাড়িতে কিছু অতিথি ফাঁকা বাক্স মুড়ে আনে ঝকমকে কাগজে। উপহার দেওয়ার ভান করেই যদি ভরপেট খেয়ে পানটি মুখে পোরা যায়, তা হলে আবার টাকা খসানো কেন? মমতার বিল-ও তাই। সাত দিনের অসম্ভব সময়সীমা আইনে থাকার কথা নয়, নেইও। আছে কিছু ফাঁপা কথা। এমন দেখনদারি এ রাজ্যের প্রশাসনকে বহু দিনই গ্রাস করেছে। নানা দফতরের রিপোর্ট থেকে শুরু করে বাজেট, সব কিছু হয়ে উঠেছে মোড়ক-সর্বস্ব। প্রাণপণে খুঁজেও তা থেকে সত্যকে উদ্ধার করা যায় না। নেতার মুখের দিকে চেয়ে-থাকা মানুষকে মিথ্যা বলার, ভুল বোঝানোর এই অভ্যাস এ বার এল আইনসভায়।
বিল-এর হুলটি আছে লেজে। শেষ বাক্যটি হল, “দেয়ার ইজ় নো ফাইনানশিয়াল ইমপ্লিকেশন ইনভলভড ইন গিভিং এফেক্ট টু দ্য প্রভিশনস অব দ্য বিল।” যার মানে দাঁড়ায় এই যে, সরকার এই বিলকে কার্যে পরিণত করতে কোনও বাড়তি আর্থিক দায় গ্রহণ করছে না, বাড়তি বরাদ্দ দিচ্ছে না।
অথচ, এই বিলের প্রধান প্রস্তাব হল নারীহিংসার দ্রুত তদন্তের জন্য স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, আর দ্রুত বিচারের জন্য স্পেশাল কোর্ট তৈরি করা। যদি বাড়তি পুলিশ না মেলে, জেলায় জেলায় ‘স্পেশাল টাস্ক ফোর্স’ তৈরি হবে কাদের দিয়ে? যদি বিচারক, মুহুরি, পেশকারের পদ ফাঁকা থাকে, স্পেশাল কোর্ট চালাবেন কারা? যদি অনলাইনে সাক্ষ্য গ্রহণ ও ডিজিটাল নথি সুরক্ষিত রাখার পরিকাঠামো তৈরি না হয় (বহু আদালতে ওয়াইফাই-ও নেই), তা হলে দ্রুত বিচার হবে কী করে?
রাজ্যে ১২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট করতে বলেছিল কেন্দ্র, রাজ্য মাত্র সতেরোটি তৈরি করতে রাজি হয়েছে, এবং চালু করেছে কেবল ছ’টি (পকসো)। কেন্দ্র এই তথ্য ফাঁস করেছে সম্প্রতি। তাতে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন সমাজমাধ্যমে বলেছেন, এ রাজ্যে ৮৮টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু রয়েছে, যা ভারতে তৃতীয়। কলকাতা পুলিশের ‘ক্রপ-করা’ ছবির মতো, এই পরিসংখ্যানও আংশিক ছবি। কেন্দ্রীয় পোর্টাল বলছে, ওই ৮৮টি কোর্টে ১৮৪০ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, ৮০,৫৬২ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
আইনজীবীরা জানালেন, পকসো স্পেশাল কোর্টেও শিশুর উপর যৌনহিংসার মামলা ঝোলে পাঁচ-ছ’বছর। বহু স্পেশাল কোর্টের দশা সাধারণ আদালতের চেয়েও খারাপ, বিচারকের অভাবে এক নাগাড়ে কয়েক মাস বসেই না অনেক স্পেশাল কোর্ট। ‘স্পেশাল কোর্ট’ একটা তকমা বই কিছু নয়, মনে করেন অনেক আইনজীবী।
তাড়ার খাঁড়া পড়েছে তদন্তের মেয়াদে। জাতীয় আইনে (ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ২০২৩) যেখানে ষাট দিনের মধ্যে ধর্ষণের তদন্ত শেষ করার কথা, সেখানে রাজ্য দিতে চায় একুশ দিন। এ এক অসম্ভব দাবি। “ডিএনএ রিপোর্ট আসতেই তো ছ’সাত মাস,” বললেন এক পাবলিক প্রসিকিউটর। সম্পূর্ণ ফরেন্সিক রিপোর্ট আসতে বছর ঘুরে যায়। ফরেন্সিক ল্যাবগুলির ঘাড়ে কাজের পাহাড়। তেমনই, মোবাইল ফোনের তথ্য এখন অত্যন্ত জরুরি, তার জন্য ‘ডিজিটাল অ্যানালিটিক্যাল ইউনিট’ চাই জেলায় জেলায়। যে সব ব্যবস্থা থাকলে দ্রুত দোষী শনাক্ত করা যায়, সেগুলি তৈরি না করেই দ্রুত তদন্ত শেষ করার চাপ তৈরি করা হচ্ছে। তাতে দুটো ভয় দেখা দেয়। এক, পুলিশ অভিযোগ নিতেই চাইবে না। দুই, নিজেদের কাজ দেখাতে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবে।
ধর্ষণের মামলায় সর্বাধিক প্রয়োজন, দ্রুত আক্রান্ত মেয়েটির কাছে পৌঁছে তার বয়ান নেওয়া, তার জামা-কাপড় ও অন্যান্য ফরেন্সিক সাক্ষ্য সংরক্ষণ করা, আক্রান্তের ও অভিযুক্তের মোবাইল ফোন সংগ্রহ করা, প্রভৃতি। স্থানীয় থানা যদি এ কাজগুলি তৎক্ষণাৎ না করে, যদি ডিএসপি-র অধীনে জেলার একটিমাত্র স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের দিকে ঠেলে দেয়, তাতে সময় নষ্ট হবে, প্রমাণ নষ্ট হবে, মনে করেন এক ডিএসপি। “এই সুযোগে বরং ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার নির্দেশ মেনে প্রতি জেলায় ফরেন্সিক সাক্ষ্য সংগ্রহে দক্ষ কর্মী নিয়োগ করতে পারত রাজ্য,” বললেন ওই পুলিশ আধিকারিক। তামিলনাড়ু ইতিমধ্যেই এই ব্যবস্থা কার্যকর করেছে। সেখানে ফরেন্সিক কর্মীরা থানার পুলিশের সঙ্গে প্রতিটি ধর্ষণের ‘স্পট’-এ যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গেও তার দরকার ছিল না কি?
এই বিল যৌনহিংসা প্রতিরোধ করতে চেয়েছে শাস্তির কঠোরতা বাড়িয়ে। ধর্ষণ ও হত্যার ন্যূনতম শাস্তি করা হয়েছে ফাঁসি (ধারা ৬৬)। অভিজ্ঞতা কিন্তু বলে, শাস্তি যত কঠোর হয়, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার তত কমে। আসল প্রয়োজন অপরাধের প্রতিরোধ, সহজে অভিযোগ দায়ের করা, এবং দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা। ধর্ষণের তদন্তে যত দেরি হয়, তত সাক্ষী বিরূপ হয়, ধর্ষিতার উপরেও চাপ বাড়ে।
আর জি কর-কাণ্ডের পর রাজ্যের সর্বত্র মেয়েরা নিজেদের অসুরক্ষিত মনে করছে। এ সময়ে সরকারের এমন বার্তা দেওয়ার দরকার ছিলে যে, এ বার যে কোনও যৌন হয়রানির মোকাবিলা হবে শক্ত হাতে, ধর্ষণের প্রতি রাজ্য ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ দেখাবে। ‘যা হয়েছে হয়েছে, আর হবে না’— এমন একটা বয়ান মমতার মুখে অনেক বার, অনেক সঙ্কটে শোনা গিয়েছে। এ বার তেমন কোনও বার্তা পাওয়া গেল না কেন? মমতা কি বুঝছেন না, রাত-জাগা মেয়েরা তাদের দেহ-মনের সব ক্ষতচিহ্নের বিচার চায়? নতুন আইন, নতুন অ্যাপ যথেষ্ট নয়। হেনস্থা-হয়রানি থেকে ধর্ষণ-হত্যা, যে কোনও সঙ্কটে পাশে পাওয়া যায়, এমন এক সদা-সক্রিয় ব্যবস্থা চায় মেয়েরা। এমন সুসংহত একটা ব্যবস্থা তৈরি করা কী এত কঠিন কাজ মমতার পক্ষে, যিনি নিজের সর্বশক্তিময়ী, সর্বসম্পদময়ী, সর্বমঙ্গলা ভাবমূর্তিটি এত ভালবাসেন?
এই অপারগতা সঙ্কীর্ণ রাজনীতি আর বৃহৎ রাজনীতির সংঘাত। এক দিন মমতার পরিবর্তনের ডাক শুধু শাসক দল নয়, ক্ষমতার স্থিতাবস্থা বদলে দিয়েছিল। আজ তিনি নিজেই স্থিতাবস্থার প্রধান রক্ষী। নিজের সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কলেজ অধ্যক্ষ, পুলিশ কমিশনারের বদল রুখছেন, যেমন চলছে তেমনই চালাতে চাইছেন। তাঁর দলের নেতারা হিংস্র বাক্যে ভয় দেখাচ্ছে, পুলিশ হয়রান করছে পথে-নামা কিশোরী-তরুণীদের। ক্ষমতাসীনের হীন মিথ্যাভাষণ অসহ্য হয়ে উঠেছে প্রবীণদের কাছে, তাই তাঁরাও পথে নামছেন।
এখন বিচার চাওয়া মানেই বদল চাওয়া, সেটা আঁচ করে বদলের বয়ান মমতা রাখতে চাইছেন নিজের হাতে। অপরাজিতা বিল বস্তুত অ-পরিবর্তনের প্রস্তাব। পাশ হওয়ার আগেই ফেল করে বসে আছে।