আবেগ! আবেগ! তোমার বাজার নাই বাংলা ভাষা?
Bengali Language

বাঁচান বাঁচি, মারেন মরি

উচ্চ সংস্কৃতির বাংলা বিপন্ন, তেমন কথা বলা মুশকিল। বলতেই পারেন যে, আগে সাহিত্য বা কবিতায় বাংলা ভাষার যে গুণগত মান ছিল, এখন তার পতন ঘটেছে।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৮
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

বা‌ংলা ভাষা যদি বাঁচে, তাকে বাঁচিয়ে রাখবে কে? প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির এই আকুল প্রশ্নের উত্তর খুঁজব বটে, কিন্তু তার আগে একটা অন্য প্রশ্ন করি— কোন বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে চাই আমরা? প্রাত্যহিক সংযোগের বাংলা— দোকান-বাজারে, পথেঘাটে পরস্পরের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলি? না কি, হাই কালচার বা উচ্চ সংস্কৃতির বাংলা— অর্থাৎ, সাহিত্য সঙ্গীত চলচ্চিত্রের বাংলা; এবং লোকসংস্কৃতি? বাংলাচর্চা বলতে কোন বাংলাকে বুঝব?

Advertisement

উচ্চ সংস্কৃতির বাংলা বিপন্ন, তেমন কথা বলা মুশকিল। বলতেই পারেন যে, আগে সাহিত্য বা কবিতায় বাংলা ভাষার যে গুণগত মান ছিল, এখন তার পতন ঘটেছে। এ কথাটাকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে প্রমাণ করা মুশকিল, কারণ গুণগত মানের সর্বজনমান্য কোনও নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠি নেই। আপনার কমলকুমার মজুরদার ভাল লাগতে পারে, আমার স্মরণজিৎ চক্রবর্তী— কিন্তু তার কোনটা ভাল কোনটা খারাপ, এবং ভাষার গুণগত মানের অভিমুখ কোন দিকে, কোনওটাই নিষ্পক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বলা যাবে না। এখানে একটাই মাপকাঠি হতে পারে— আগে এই উচ্চ সংস্কৃতির বাংলায় মোট যত বই ছাপা হচ্ছিল, যত নতুন গান প্রকাশিত হচ্ছিল, যত সিনেমা তৈরি হচ্ছিল, এখন তার চেয়ে কম হয়, না বেশি? সংশয়হীন উত্তর— মোট উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কেন বেড়েছে, বেড়ে ভাল হয়েছে না মন্দ, এখানে সেই তর্কের প্রয়োজন নেই; বেড়েছে, সেটাই প্রমাণ করছে যে, উচ্চ সংস্কৃতির বাংলা বিপন্ন নয়, ফলে তাকে ‘বাঁচানো’র প্রয়োজন নেই। ‘উচ্চতর মার্গ’-এর লিটল ম্যাগাজ়িনের উৎপাদনের পরিমাণও বলছে যে, এই মুহূর্তে তা বিপন্ন নয়। চাহিদার দিকেও ছবিটি একই রকম— বাংলা বই, সিনেমা থেকে লিটল ম্যাগ, কোনওটির ক্ষেত্রেই বিক্রি আগের চেয়ে কমেছে কি?

লোকসংস্কৃতি বিপন্ন কি না, সেটা বোঝার মাপকাঠি কী? কত লোক সেই সংস্কৃতির কনজ়িউমার বা উপভোক্তা, সেটাই প্রধান মাপকাঠি। কারণ, এই সংস্কৃতির উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রেই বাজারব্যবস্থার বাইরে থাকে। তবে, কোন সাংস্কৃতিক উৎপাদনের কত উপভোক্তা আছে, তারও কোনও পাকাপোক্ত হিসাব আছে বলে জানি না। লোকসংস্কৃতির প্রধানতম উদ্দেশ্য মানুষের মনোরঞ্জন। অতএব, কোনও লোকসংস্কৃতি যদি ‘বিপন্ন’ হয়, অর্থাৎ তার উপভোক্তার সংখ্যা এমন একটা চৌকাঠের নীচে নেমে যায়, যেখানে তার প্রসারের আর সম্ভাবনা থাকে না, তা হলে বুঝতে হবে যে, সেই নির্দিষ্ট সংস্কৃতিটি তার প্রধানতম উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছে— অর্থাৎ, সেই সংস্কৃতি থেকে একটা ন্যূনতম সংখ্যক মানুষেরও মনোরঞ্জন হচ্ছে না।

Advertisement

কেন, সে প্রশ্নের উত্তর এখানে খোঁজার প্রয়োজন নেই— মানুষের রুচির অবনতি হতে পারে, প্রযুক্তির দৌলতে নতুনতর মনোরঞ্জনের পণ্য হাতের নাগালে আসতে পারে, সেই নির্দিষ্ট লোকসংস্কৃতির গুণগত পতন (গুণগত পতন ঘটছে কি না, নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তা অবশ্য মাপা কঠিন, কার্যত অসম্ভব) ঘটতে পারে— মোট কথা, এই নির্দিষ্ট লোকসংস্কৃতি তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। তাকে রক্ষা করা প্রয়োজন হতেই পারে— যে ভাবে সুতো কাটার চরকা রক্ষা করা প্রয়োজন, দোয়াতের কালি ও কলম রক্ষা করা প্রয়োজন, এমনকি পাতে-আরশোলাসমেত-খাবার পরিবেশন করা ‘নস্ট্যালজিক’ রেস্তরাঁও রক্ষা করা প্রয়োজন— কিন্তু, সেটা শুধুমাত্র অতীতকে রক্ষা করার স্বার্থে। তার প্রায়োগিক উপযোগিতা, যদি আদৌ কিছু থাকে, অতি সামান্য।

অন্য দিকে, কিছু লোকসংস্কৃতি আছে, যা নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে নিয়েছে। যেমন, বাউল গান। ইদানীং তার ভাল বাজার আছে। যেমন, যাত্রাপালা। এক দশক আগেও নাকি পশ্চিমবঙ্গে যাত্রাপালার বার্ষিক বাজারের আয়তন ছিল দু’কোটি ডলারের চেয়ে বেশি। যেমন, এখন বিভিন্ন রিসর্টে সন্ধের ঝোঁকে আদিবাসী নাচ-গানের আসর বসে। এই ভাবে টিকে থাকতে গিয়ে এই সংস্কৃতির কতখানি ক্ষতি হচ্ছে, বা আদৌ ক্ষতি হচ্ছে কি না, সেগুলো আলাদা তর্ক। কিন্তু, আপাতত এই সংস্কৃতিকে ‘বাঁচানো’র জন্যও হন্যে হওয়ার প্রয়োজন নেই।

পড়ে রইল সংযোগের ভাষা হিসাবে বাংলার প্রশ্ন। শহর এবং মফস্‌সলের বাইরে যে পশ্চিমবঙ্গ, তার বাংলাভাষী অঞ্চলে সংযোগের ভাষা হিসাবে বাংলা এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শহর ও মফস্‌সলে ঘটনাটা আলাদা— উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণির মধ্যে ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে ইংরেজির ব্যবহার ক্রমবর্ধমান; তার বাইরের জনগোষ্ঠী ক্রমে হিন্দিতে স্থিত হচ্ছে। দুই প্রবণতার পিছনেই যে কারণটি কাজ করছে, তার নাম বাজার। এলিট শ্রেণির কর্মক্ষেত্র ক্রমেই বিশ্বায়িত, ফলে সেখানে ইংরেজিই একমাত্র ভাষা। সে ভাষায় তাঁরা যত সড়গড় হচ্ছেন, প্রাত্যহিক ক্ষেত্রেও তার ব্যবহার ততই বাড়ছে। শ্রমজীবী শ্রেণির কর্মক্ষেত্র ক্রমে হিন্দির দাপটে আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ, কলকাতা বা অন্য বড় শহরে, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রের কাজে, বহু ক্ষেত্রেই নিয়োগকর্তা হিন্দিভাষী— অথবা, সহকর্মীরা হিন্দিভাষী, বা কাজের প্রয়োজনে যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, তাঁরা হিন্দিভাষী। রাজ্যে তেমন কাজ নেই, ফলে ভিন রাজ্যে কাজ খুঁজতে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে মাথায় রাখতে হয়। তার জন্যও হিন্দি প্রয়োজন।

এই হিন্দি বা ইংরেজির প্রসার না ঠেকালে শহর ও মফস্‌সলে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলার গুরুত্ব কমবেই। শুধু সদিচ্ছার জোরে সেই গুরুত্ব বাড়ানোর উপায় নেই; বিহারি রিকশাওয়ালাকে দু’ঘা দিয়েও বিশেষ লাভ হবে না। সব সরকারি দফতরে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার কথা শোনা যায় মাঝেমধ্যেই— হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু ভেবে দেখা ভাল, এক জন গড়পড়তা নাগরিককে জীবনে মোট কত বার সরকারি ফাইল ঘাঁটতে হয়? রূপালী গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাকে বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞানের পরিভাষার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন (‘ভাবার দায়টা আমাদেরই’, আবাপ পৃ ৪, ২১-২)। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু, বাংলায় বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা করার পর তার প্রয়োগ হবে কোথায়, এই রাজ্যের স্কুল-কলেজে পড়ানো ছাড়া সেই শিক্ষা কোনখানে কাজের সংস্থান করবে? কাজের সেই বড় বাজারটি তো ইংরেজি-চালিত। উনিশ শতকে অক্ষয়কুমার দত্তের মতো মানুষরা যখন বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার কথা ভাবছিলেন, তখন তাঁদের মাথায় এক সূত্রে গাঁথা বিশ্ববাজারের কথা ছিল কি না, সেটা ভেবে দেখা যায়। এবং, একই সঙ্গে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা প্রয়োজন, বনিয়াদি ও মাধ্যমিক স্তরের বইপত্রের বাংলাকে কী ভাবে ছাত্রছাত্রীদের বোধগম্য করে তোলা যায়। বাংলাকে ব্যবহারের ভাষা হিসাবে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তো তাকে ব্যবহারের যোগ্যও রাখতে হবে। অমর্ত্য সেনের একটা কথা মন্ত্রের মতো মনে রাখা প্রয়োজন— অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে কোনটা সবচেয়ে জরুরি, তা ভুললে চলবে না। সেই জরুরিতম কাজটা সবার আগে করতে হবে, বাকিগুলো অপেক্ষা করবে নাহয়।

হিন্দি সিনেমার আগ্রাসনকে দোষ দিলেও তা কার্যকারণ সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলা হবে। হিন্দি সিনেমা দেখে বাঙালি হিন্দিতে কথা বলছে না; বরং, বাঙালিদের একটা বড় অংশের কাছে হিন্দির অ্যাস্পিরেশনাল ভ্যালু বেড়েছে, অর্থাৎ হিন্দি ভাষা শেখার সঙ্গে জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাজারের কারণে— এবং, তাতেই হিন্দি সিনেমার সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে হিন্দিভাষী দুনিয়ার সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতাও। ইদানীং কার্যত সব শহুরে হিন্দু বাঙালি বিয়েতেই ‘সঙ্গীত’ আর ‘মেহেন্দি’ হয় (মুসলমান বাঙালিদের ক্ষেত্রে ‘মেহেন্দি’ একটা দীর্ঘ প্রচলিত প্রথা) হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা মূল্যের কারণেই। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা মূল্যজনিত হিন্দি প্রেমকে কাজে লাগিয়েই হিন্দুত্ব রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে তার ডালপালা ছড়াচ্ছে।

হিন্দির এই বিস্তার এবং আগ্রাসনকে ঠেকানোর জন্য দরকার পুঁজির জোর। তাতেও ইংরেজির সঙ্গে পেরে ওঠা যাবে না, কিন্তু হিন্দির মোকাবিলা করা যেতে পারে— এমন জোর, যাতে বাংলার মাটিতে কাজ পাওয়ার জন্য বাংলা ভাষা জানতেই হবে, এবং বাংলা ভাষা জানলেই চলবে। প্রশ্ন হল, পুঁজির সেই জোর কি বাঙালির আছে? থাকলেও, কত দিন লাগবে বাজারে বাংলার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে, বিশেষত যখন কেন্দ্র থেকে সক্রিয় ভাবে হিন্দির প্রসারের উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে? ভাষা দিবসের আবেগ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। কিন্তু, লেখার গোড়ায় যে প্রশ্নটা করেছিলাম, তার স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন উত্তর এখানে দিয়ে রাখি— বাংলা ভাষাকে যদি বাঁচাতে হয়, তবে বাঁচাতে পারে কেবলমাত্র পুঁজি; বাজারের চলনকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো পুঁজি। প্রশ্ন করতেই পারেন, স্থানীয় পুঁজিকে বাংলা-নির্ভর করলেই বাংলা ভাষার আধিপত্য ফিরবে? ক্যাবচালক থেকে ডেলিভারি বয়, টেলিকলার থেকে রেস্তোরাঁর বেয়ারা সবাই বাংলায় কথা বলতে আরম্ভ করবেন? তার বেশির ভাগটাই তো স্থানীয় পুঁজির নাগালের বাইরে। করবেন। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের শহরাঞ্চলে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে সরে যাওয়া যাবে হিন্দি-আধিপত্যের ইক্যুইলিব্রিয়াম বা স্থিতাবস্থা থেকে বাংলায়। তখন ভাষার অর্থনীতির চলন নতুন হতে বাধ্য।

বাজারের বাইরে কি কিছুই বাঁচে না? এই যে ঘরে ঘরে লোকে গান শেখে, সেতার বাজায়, তার ক’জনই বা সেই দক্ষতাকে বাজারজাত করতে পারে? সে ভাবেই কি বাংলার চর্চা চলতে পারে না? অবশ্যই পারে। কিন্তু, যদি গিটার বাজাতে শিখলেই বাজারে তার দাম পাওয়া যায়, ক’জন সেতার বাজাবেন? যদি চাকরি পেতে গেলে আবৃত্তি জানতেই হয়,তবে ক’জনই বা সেই চর্চা ছেড়ে নাচ শিখবেন? ইংরেজি বা হিন্দির সঙ্গে শৌখিন বাংলার ফারাক এখানেই।

বাজারকে অস্বীকার করা বন্ধ না-করতে পারলে বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে কেঁদে লাভ হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement