শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের (বসিরহাট ১) চার কিশোরকে কিছু দিন আগে বাড়ি ফিরিয়েছে তামিলনাড়ুর পুলিশ। ফাইল চিত্র।
পাকা বাড়িতে বাহারি গেট। এক হাতে জলের নল, অন্য হাতে কাঠির ঝাঁটা দিয়ে উঠোন ধুচ্ছিলেন শামিমা বিবি। চটি পায়ে অতিথিদের দেখে অপ্রসন্ন মুখে বললেন, “ছেলে চুল কাটতে গিয়েছে।” এই শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামের (বসিরহাট ১) চার কিশোরকে কিছু দিন আগে বাড়ি ফিরিয়েছে তামিলনাড়ুর পুলিশ। চেন্নাইয়ের একটি সোনার কারখানা থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাইশ জন কিশোর-তরুণকে ‘বন্ডেড লেবার’ বা দাসশ্রমিক অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয়। যদিও চোদ্দো বছরের পরে ‘শিশুশ্রমিক’ থাকে না, তবু তাদের সপ্তাহখানেক হোমে রেখে, বিশেষ বগিতে ফেরত পাঠানো হয়। চুলে মাশরুম ছাঁট দিয়ে খানিক পরে যে ছেলেটি এল, সেই রোহনও (সব নাম পরিবর্তিত) ছিল বগিতে। তার সঙ্গীরাও এল একে একে। স্কুলে থাকলে এরা এ বার মাধ্যমিক দিত।
তরতরে মুখ, ছিপছিপে দেহ, দৃষ্টি কখনও লাজুক, কখনও প্রখর— এই ছেলেরা ‘নিয়মহারা, হিসাবহীন’-এর দলে। সরকারি নথি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে স্কুলছুট নেই, শিশুশ্রমিক নেই, দাসশ্রমও নেই। বাংলা শিক্ষা পোর্টাল-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রায় একশো শতাংশ শিশুর নাম তোলা হয়। তার পর জেলান্তরি-রাজ্যান্তরি, এমনকি মৃত শিশুরও নাম ক্লাস থেকে ক্লাসে উঠতে থাকে, যত দিন না মাধ্যমিকের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, দশ জনে চার জনই গায়েব। শিশুশ্রমিক চোখ খুললে অগুনতি, খাতা খুললে নেই। শ্রম দফতরের এক আধিকারিক এর যে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিলেন, তার সার কথা দাঁড়াল এই যে, যত ক্ষণ না ইটভাটা, ধাবা, বিড়ি কারখানা, বাজি কারখানা বা খাদানের মালিক ‘অনূর্ধ্ব-চোদ্দো বৎসর বয়সিকে নিয়োগ করিয়াছি’ লিখে সই করে দিচ্ছেন, তত ক্ষণ সরকার কাউকে ‘শিশুশ্রমিক’ বলতে রাজি নয়।
সরকারি বিধির এমনই মহিমা। ১৭ মার্চ, ২০২২ শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্না বিধানসভায় জানিয়েছিলেন, জাতীয় শিশুশ্রমিক প্রকল্পের রাজ্যে ৩৬৩টি শিক্ষা কেন্দ্র চলছে, পড়ুয়া সাড়ে ষোলো হাজার। এক বছর পরে পরিস্থিতি কী, শিশুশ্রমিক বাড়ল না কমল, তা জানার উপায় নেই। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার শিশুশ্রমিক প্রকল্প উঠিয়ে দিয়েছে, সর্বশিক্ষা মিশনের অধীনে নাবালক মজুরদের আনার নির্দেশ জারি করেছে। উত্তর দিনাজপুরের এক অসরকারি সংস্থার কর্মীর দাবি, “এদের কাছে পৌঁছবে মূলস্রোতের স্কুল, সে আশা কম।” চোদ্দো থেকে আঠারো বছর বয়সিদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, তা-ও বন্ধ হয়েছে। শিশুশ্রমিক খোঁজার সমীক্ষা স্থগিত। শিশু-মজুরদের স্কুল উঠিয়ে দিয়ে সরকার দিব্যি পাশ করে গেল।
কেন স্কুল ছাড়ছে শিশু-কিশোররা? কিসের অভাব? রোহনের বাবা গেস্ট হাউস মালিক, রোহন হস্টেলে থাকতে ক্লাসে সেকেন্ড হত, অঙ্ক ভালবাসত। অথচ, মায়ের আগ্রহ সত্ত্বেও (আমি কোনও দিন স্কুলে যাইনি, চেয়েছিলাম ছেলেটা পড়ুক, বললেন বছর বত্রিশের শামিমা) লকডাউনের পরে স্কুলে ফেরেনি। হস্টেলের জীবনের চাইতে সোনার গয়নার কারখানায়, শ্রীকৃষ্ণপুরের আশপাশের গ্রামের আট জন সমবয়সি ছেলের সঙ্গে থাকতে, কাজ করতে ভাল লাগত। নিজেকে বন্দি মনে হয়েছিল কেবল হোমে। তার বন্ধু হারুন তো পুলিশের উপর রীতিমতো বিরক্ত। “আঠারো বছর হয়নি বলে আমাকে জোর করে ফিরিয়ে আনল। না হলে আমি থেকে যেতাম।”
রোহন, হারুন কাজে যোগ দেওয়ার মাস দেড়েকের মাথায় পুলিশ হানা দেয়। ফারুখের অভিজ্ঞতা কিছু বেশি— চোদ্দো বছর না-হতেই সে চেন্নাইয়ের সোনার দোকানে গিয়েছিল। কাজের সময় ছিল সকাল দশটা থেকে রাত দশটা, সপ্তাহে ছ’দিন। কেবল রবিবার শেঠ (মালিক) কারখানার কারিগরের সঙ্গে পাশের চৌপট্টিতে যেতে দিত। “ওরা বাইরে বেরোতে দেয় না, যা লাগে এনে দেয়,” দাসশ্রম নিয়ে আয়োজিত একটি সভায় বলছিল মৈপীঠের প্রসেনজিৎ। সে উদ্ধার হয়েছিল ২০১৯ সালে, ষোলো বছর বয়সে। “যখন ট্রেনে করে আসছি, খুব আনন্দ, যেন জেলখানা থেকে মুক্তি পেলাম।” সোনার দোকানে তার কাজের সময় ছিল সকাল ন’টা থেকে রাত দুটো। তিন মাস কাজ করে এক পয়সা মেলেনি, কারণ চুক্তি ছিল ছ’মাসের। প্রাপ্তি বলতে হাতে রাসায়নিকের ক্ষত।
বিনা পয়সার শ্রম, চলাফেরার স্বাধীনতায় ছেদ, দীর্ঘ সময় কাজ, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জায়গা, কোনও এক জন ব্যক্তিকে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য থাকা— এমন নানা শর্ত দিয়ে দাসশ্রম চিহ্নিত হয়। এর অনেকগুলির চিহ্ন দেহে-মনে ধারণ করছে এই নাবালকরা। তবু ওরা স্কুলে ফিরতে চায় না। কারণটা কেবল টাকার অভাব নয়। ‘বন্ডেড লেবার’ উদ্ধার হলে সরকার তিরিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়, সে টাকা এরা পেয়ে গিয়েছে। তা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করতে চায় ওরা। মাধ্যমিক দেবে না? “পড়াশোনা ভাল লাগে না।”
প্রসেনজিতের সঙ্গে উদ্ধার হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার পঁচিশ জন কিশোর। একটি অসরকারি সংস্থার কর্মীরা জানালেন, চব্বিশ জনই আঠারো বছর হতে না-হতে ফিরে গিয়েছে চেন্নাইয়ের সোনার কারখানায়, বিস্কুট কারখানায়, নইলে অন্ধ্রের মাছের ভেড়িতে। যেখানে কাজের চেহারাটা সম্পূর্ণত, বা প্রধানত, দাসশ্রমের। এ কথাগুলো ‘বন্দিত্ব’, ‘দাসত্ব,’ ‘শৈশব’, ‘শিক্ষা’— এমন সব শব্দের চার পাশে গড়ে-রাখা অর্থের বেড়া ভেঙে তছনছ করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রদের কাছে তাদের স্কুল তা হলে ঠিক কেমন জায়গা? কবে থেকে ভাটা, ভেড়ি, কারখানার চাইতেও নিরানন্দ, নিপীড়নকারী হয়ে উঠল আমাদের স্কুলগুলো? কী করেই বা?
স্কুলে যেতে যে ভালবাসে, বাপ-মা স্কুল ছাড়তে বললে সে অনর্থ করে। যখন শিশুমন পড়াশোনায় তৃপ্তি পায় না, তখন সাইকেল, জামা-জুতো, কোনও প্রলোভনই তাকে স্কুলে ধরে রাখতে পারে না। শিশুর মনের খিদে যেন তার পেটের খিদের মতোই— তখনই চাই যখন দরকার, ততটা চাই যতটা দরকার। লাভের খাতার হিসাব করে বাঁচা শৈশবের ধর্ম নয়। আবার, স্কুল ছেড়ে তড়িঘড়ি রোজগারের পথ ধরাও পরিণত মনের পরিচয় নয়, মনে করালেন অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী। “হাই স্কুলের প্রতিটি বছরের সঙ্গে আরও ভাল কাজ পাওয়ার, বেশি রোজগার করার সম্ভাবনা বাড়ে, বিভিন্ন গবেষণায় তা প্রমাণিত,” বলেন তিনি। দরিদ্র স্কুলপড়ুয়াদের সান্ধ্য ক্লাসে পড়িয়ে তিনি দেখেছেন, বইয়ের পাঠ যখন সে বুঝছে, আনন্দ পাচ্ছে, আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে আসছে।
আলাউদ্দিন শ্রীকৃষ্ণপুরের চেন্নাই-ফেরত চার ছেলের এক জন। বাঁশ, দরমা আর টিনের চালার ঘরে ঢাকার চেয়ে ফাঁকা বেশি। তার মা বললেন, “মিছে বলব না, আমিই ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম। বড় অভাবের সংসার!” ছেলেকে কোনও দিন লুচি খাওয়াতে পারেননি, ছেলের গায়ে বোনপোর পুরনো জামা, বলতে গিয়ে ভাঙা গালে জল বইল। সেই ছেলে দু’শো টাকার স্কুলে-ভর্তির রসিদটা দেখাল। “সরকার যখন টাকাটা দিলই, তখন পড়ব।” চেন্নাই থেকে ফিরে স্কুলে যেতেই মাস্টারমশাইরা আলাউদ্দিনকে ডেকে নবম শ্রেণিতে নাম লিখে নিয়েছেন, সস্তায় সহায়িকা পাইয়ে দেওয়ার ভরসা দিয়েছেন এক জন স্যর, বলতে গিয়ে গালে টোল পড়ল ছেলের।
শিশুর মুক্তির সন্ধান বার বার শিক্ষকের কাছে এসেই শেষ হয়।