—প্রতীকী চিত্র।
সম্প্রতি প্রকাশিত হল পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস)-র পরিসংখ্যান। তার অন্তর্ভুক্ত একটি বিশেষ পরিসংখ্যান নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক, আলোচনা হচ্ছে। তথ্যটি হল, ভারতে স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন ১৩.৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ২০২২-এর জুলাই থেকে ২০২৩-এর জুন অবধি যাঁদের নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৩.৪ শতাংশ স্নাতক চাকরি পাননি। এ ধরনের সমীক্ষায় আরও অনেক তথ্য থাকে। সেগুলো নিয়ে অবশ্য বিশেষ আলোচনা চোখে পড়ল না। এই লেখায় তেমন কিছু প্রসঙ্গেই আলোচনা করব। কিন্তু, তার আগে বলি যে, পিএলএফএস একটি বিশ্বাসযোগ্য সমীক্ষা। যে কোনও সমীক্ষার জন্য তৈরি প্রশ্নপত্রে সমস্যা থাকতে পারে; যাঁদের উপর সমীক্ষা চালানো হচ্ছে, সেই স্যাম্পল বা নমুনা চয়ন নিখুঁত না হতে পারে— তেমন আপত্তি এই সমীক্ষাটি নিয়েও আছে, কিন্তু এর তথ্য থেকে মোটামুটি ভাবে বিশ্বাসযোগ্য একটা ছবি নিশ্চয় পাওয়া যায়।
এই সমীক্ষা পশ্চিমবঙ্গে বেকারত্ব (ও কর্মসংস্থান) বিষয়ে কী বলছে, সে বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনও প্রতিবেদন চোখে পড়ল না। অবশ্য, চোখে না পড়াই স্বাভাবিক। যে রাজ্যে তেমন শিল্প নেই, চাকরি-বাকরি নেই; যেখান থেকে উত্তরে-দক্ষিণে মেধা পলাতক; যেখানে দামি স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েদের জানার দরকারই হয় না যে, হুগলি আর বর্ধমানের মধ্যে কলকাতার বেশি কাছে কোনটা; বাংলা ভাষা লেখা বা বলার দক্ষতা আসলে কেরিয়ার না হওয়ার শামিল— সেখানে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ বেকার, একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে পথে-পথে ঘুরছেন। তাই হয়তো সেই রাজ্যটি নিয়ে লেখার তেমন প্রয়োজন নেই। তবু রিপোর্টটিতে চোখ বোলালাম। সংবাদমাধ্যম, এবং সেই সূত্রে সমাজের উদ্বেগ যে-হেতু স্নাতক স্তরের বেকারত্ব নিয়ে, তাই সেখানেই চোখ গেল প্রথমে।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বাদে বড় রাজ্যগুলির মধ্যে যে দু’টি রাজ্যে স্নাতক স্তরে মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে বেকারত্ব সবচেয়ে কম, সেই রাজ্য দু’টি হল গুজরাত এবং পশ্চিমবঙ্গ। গুজরাতে এই বিভাগে বেকারত্বের হার ৬ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ৭.৩ শতাংশ। জাতীয় স্তরে এই বিভাগে বেকারত্বের গড় হার ১৩.৪ শতাংশ। যে সব রাজ্যে চাকরির ছড়াছড়ি বলে শুনি, যেমন মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, সে সব জায়গায় এই হার অনেক বেশি। কেউ যদি স্নাতক হয়েই চাকরি খুঁজতে বেরোন, তা হলে তাঁর চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি গুজরাত এবং পশ্চিমবঙ্গে। স্নাতকোত্তর শ্রেণির ক্ষেত্রে ভারতে গড় বেকারত্বের হার ১২.১ শতাংশ— পশ্চিমবঙ্গে ৮.৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে এই সংখ্যা বেশ নীচের দিকে। সমস্ত ধরনের শিক্ষাস্তরের, অর্থাৎ প্রায় শূন্য শিক্ষা থেকে স্নাতকোত্তর অবধি সব মানুষকে নিয়ে ভারতে গড় বেকারত্ব ৩.২ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে ২.২ শতাংশ, গুজরাতে ১.৭ শতাংশ, কর্নাটকে ৭ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে ৩.১ শতাংশ। অর্থাৎ, শিক্ষাগত যোগ্যতার তারতম্য বিবেচনা না করে যদি সব ধরনের মানুষকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক বলে ভাবি, তা হলেও এই রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের, এবং গুজরাতের, আপেক্ষিক অবস্থান বেশ প্রশংসনীয়।
আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়— একেবারে নিচুতলার শিক্ষাশ্রেণিতে সারা ভারতেই বেকারত্ব প্রায় নেই বললে চলে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তা হলে ভারতের মাথাপিছু আয়ের এই অবস্থা কেন? একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে, অতি স্বল্পশিক্ষিত স্তরে যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেককেই প্রতি দিনের অন্নসংস্থানের জন্য প্রতি দিন কাজের জোগাড় করতে হয়। ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন শতকরা ৮০ ভাগের উপরে মানুষ। সেখানে বেকারত্ব সমস্যা নয়— সমস্যা মজুরির হারের। বড়লোক দেশের অর্থনীতিবিদরা মূলত বেকারত্বের হার নিয়ে চিন্তিত হন, কারণ সে সব দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন বেশ সীমিত। ভারতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে অনেক মানুষ ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য যে কোনও মজুরিতে কাজ করতে রাজি থাকেন, ফলে চাহিদা-জোগানের হিসাব মেনেই সেখানে মজুরি কম হয়। প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব, কম মজুরির আইন বহির্ভূত ঠিকা কাজ, শ্রমিক সুরক্ষায় নিয়মহীন কাজকর্ম— সবেতেই অসংগঠিত ক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়ায়। ফলে এ সব ক্ষেত্রে বেকারত্বের হারের চেয়ে মজুরির হারই দেখা উচিত। বেকারত্বের পরিসংখ্যান বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ তুলনায় অবস্থাপন্ন ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে।
কিছু দিন আগে জেনিভাতে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন (আইএলও) আয়োজিত একটি আলোচনাসভায় বিস্তর আলোচনা হল একটি বৈশ্বিক প্রবণতা নিয়ে— যুবসমাজের মধ্যে চাকরি পেলেও স্বেচ্ছায় চাকরি গ্রহণে খানিকটা গড়িমসি করে চাকরিটি না করার দিকে প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। যাকে বলা যেতে পারে ভলান্টারি আনএমপ্লয়মেন্ট বা স্বেচ্ছা-বেকারত্ব। সেখানে কলকাতার গবেষকদের লেখা একটি আমন্ত্রিত গবেষণাপত্রে জানা গেল যে, চাকরি সম্পর্কে উন্নাসিকতা এর একটি কারণ হতেই পারে। অর্থাৎ, বহুতল বাড়িতে দক্ষ বিদ্যুৎ কারিগরের ভীষণ অভাব, অথচ সদ্য পাশ করা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তেমন ভাল কাজ না পেয়ে বসে থাকেন, কিন্তু কারিগর হতে চান না। আমার বাড়ির সামনের চা দোকানের মালিকের আক্ষেপ যে, ছেলে খানিকটা লেখাপড়া শিখে ‘যেমন-তেমন’ কাজ করতে চাইছে না। একটু গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যাবে, সমাজে বিভিন্ন কারণে চাকরি-বাকরি নিয়ে উন্নাসিকতার সৃষ্টি হয়। শ্রমের প্রতি অসম্মান আমাদের দেশের একটি বৈশিষ্ট্য। অনেক জায়গায় জাতপাতের ভিত্তিতে কাজের বাছবিচার হয়, কোথাও কোথাও ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এ ধরনের সমস্যা হয়। কোথাও বাবা-মা-দাদা ধনবান, সম্পদশালী হলে চাকরি খোঁজার গতিতে তার প্রভাব পড়ে, কারণ চাকরি না করলে বেঁচে থাকার সমস্যা হয় না। ফলে, যখন আমরা শিক্ষিত বেকারত্বের হিসাব করি তখন আমাদের খেয়াল রাখা উচিত যে, তার মধ্যে স্বেচ্ছা-বেকারত্বের কোনও উপাদান আছে কি না।
সমাজে আর্থিক প্রগতির সঙ্গে এই সমস্যা বাড়তে পারে। বিত্তশালী পরিবার কাজ না পেলে সন্তানকে যে ভাবে সাহায্য করতে পারে, গরিব পরিবার সেটা পারে না। ফলে, সচ্ছল পরিবারে চাকরি খোঁজার গতি খানিকটা শ্লথ হতে পারে। তাই সমীক্ষা করার সময় যে প্রশ্নপত্র ব্যবহৃত হয়, তাতে অনেক অন্য ধরনের প্রশ্ন থাকা বাঞ্ছনীয়। যাতে বেকারত্বের আসল চেহারাটা বোঝা যায়।
স্বেচ্ছা-বেকারত্ব কথাটি কেমন যেন শোনায়। কে আর ইচ্ছে করে কাজ না করে বসে থাকতে চায়। এক বার গড়িয়াহাট চত্বরে এক জন ভিক্ষুক মানুষকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বাড়ির কাজ করার জন্য সে সময়ের হিসাব অনুযায়ী বেশ ভাল মাইনে। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ তাঁর ভিক্ষা থেকে রোজগার ছিল অনেক বেশি। এক জন শিক্ষিত যুবক তাঁর দক্ষতার চেয়ে কম দক্ষতার প্রয়োজন হয় এমন চাকরি কিছু দিনের জন্য হলেও করতে চান না, কারণ পরে ভাল চাকরি পেতে গেলে সেই ইন্টারভিউয়ে তিনি ওই কথাটা বলতে পারবেন না, তার অন্য মানে করা হতে পারে। এ সব সমস্যা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সচ্ছল পরিবারে যদি কাজ সম্পর্কে উন্নাসিকতা বৃদ্ধি পায় তা হলে আর্থিক প্রগতির সঙ্গে বেকারত্ব বাড়তে পারে।